Table of Content

Shahina Rahman
NA
NA
2 articles

কৃষ্ণকলি

লেখক: শাহিনা রহমান Category: ছোট গল্প (Short Story) Edition: Dhaboman - Eid 2017

 

বাসা থেকে বের হতে দেরী হয়ে গেল। দোষটা ঠিক মিতালীর নয়। দেশ থেকে মা হঠাৎ ফোন করল। ক’দিন কথাবার্তা হয় নি। নানা আলাপে কখন ঘন্টা খানেক পেরিয়ে গেল খেয়ালও করে নি। তার কাজ এগারোটায়। মিনিট বিশেক বাকী থাকতে খেয়াল হল। কোন রকমে জামা কাপড় পরেই গাড়ী নিয়ে ছুটেছে। দশ মিনিটের পথ। রাস্তায় কোন কারণে ভীড় থাকলে আরেকটু বেশী লাগে। আজ কপালে খারাবী ছিল। সামনের মোড়েই এক্সিডেন্ট। ফাঁকা রাস্তায় দুই গাড়ী মুখোমুখি লাগিয়ে রাস্তা বন্ধ করে বসে আছে। খুব রাগ হল মিতালীর। ঘুরে যেতে আরও মিনিট দশেক বেশী গেল। স্কুলের পার্কিং লটে গাড়ী রেখে সে যখন হন্তদন্ত হয়ে ক্লাশ রুমে গিয়ে হাজির হল তখন এগারোটা দশ। ধ্যাত্তেরী! মনে মনে বিরক্ত হল ও। মাত্র এক ঘন্টার কাজ। লাঞ্চ মনিটর। শিক্ষকরা ঘন্টা খানেকের জন্য বিরতি নেয়। সেই সময়টুকু তার মত আরও অনেক মহিলারা বাচ্চাদের দেখাশোনা করে। পেইড কাজ, কিন্তু যারা করে তারা সবাই সময় কাটানোর জন্যই করে, একরকম ভলান্টারি কাজের মত। সারা মাসে আয় যা হয় সেটা বলার মত কিছু না। কিন্তু তারপরও কাজ কাজই। দেরী করে এলে কেউ কি ছেড়ে কথা বলবে?

            কিন্ডারগার্টেনে ডিউটি মিতালীর। দুই সেকশন। সব মিলিয়ে পঞ্চাশটার মত বাচ্চা। মিতালীর কাজ হচ্ছে ওদের লাঞ্চ খাওয়া হলে বাইরে নিয়ে যাওয়া। যতক্ষণ বাইরে খেলবে চোখে চোখে রাখা। এই সময়টুকু শিক্ষকদের লাঞ্চ টাইম। তারা চাতক পাখীর মত অপেক্ষা করে থাকে কখন লাঞ্চ মিনিটর আসবে। বয়েসী শিক্ষকরা যারা দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষকতা করছে তাদের ধৈর্য বেশী, ব্যবহার ভালো। তরুণ শিক্ষকদের কেউ কেউ অসহিষ্ণু। কিন্ডারগার্টেনের ECE (Early Childhood Educator) হচ্ছে সিন্থিয়া, মাস ছয়েক হল জয়েন করেছে। সব সময় একটু ভাব নিয়ে চলে লাঞ্চ মনিটরদের সামনে, কয়েক জনের সাথে ইতিমধ্যেই হাল্কা কথা কাটাকাটিও হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেরী হওয়া নিয়ে। শিক্ষকদের লাঞ্চটাইম ঘন্টাখানেক হলেও ECE দের মাত্র আধা ঘন্টা। দ্রুত লাঞ্চ সেরে তাদেরকে আবার বাচ্চাদের সাথে এসে সময় কাটাতে হয়। এই কারণেই সামান্য দেরী হলেও সে খুব তেতে ওঠে। পাকিস্থানী বুড়ী পারভিন, সত্তরের মত বয়েস, প্রায় পনের বছর ধরে এখানে লাঞ্চ মনিটরের কাজ করছে, তার সাথে একদিন লেগে গেল। সিন্থিয়া তাকে কি বলেছিল কে জানে, পারভিনের মেজাজ চড়া। সে গলা উঁচিয়ে এমন চীৎকার চেঁচামচি জুড়ে দিয়েছিল যে স্বয়ং প্রিন্সিপাল পর্যন্ত এসে হাজির। পারভীন এই স্কুলের সবচেয়ে পুরানো কর্মী, তাকে সবাই ভালোবাসে। সিন্থিয়াও ত্যাড়া। কেউ নিজের দোষ স্বীকার করবে না। প্রিন্সিপাল পরে পারভিনকে অন্য ক্লাশে দিয়ে মিতালীকে সিন্থিয়ার ক্লাশে দেয়। আর আজ মিতালী নিজেও দেরী করল। নির্ঘাত মেয়েটার সাথে ঝামেলা হবে আজকে।

            সিন্থিয়া আগের দিনের ঝামেলার কথা ভেবেই হোক, কিংবা মিতালীর প্রতি পারভিনের চেয়ে বেশী প্রসন্ন হবার কারণেই হোক, ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে গিয়েও না বলে মুখটা বাঁকিয়ে দ্রুত পায়ে ক্লাশ থেকে বেরিয়ে গেল। স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল মিতালী। সে পারভিনের মত নয়। ঝগড়া ঝাটি তার আসে না। স্বামীর সাথে তাও পারে, কিন্তু অন্য কারো সাথে ঝগড়া করতে গেলে তার গলা শুকিয়া যায়, দম বন্ধ হয়ে আসে, বুক ধড়ফড় করতে থাকে। পারভিন বোধহয় তার দেরী দেখে কিছু একটা আশংকা করছিল। সে গ্রেড ওয়ানে। একটু পর পর দেখছিল মিতালী এলো কিনা। তাকে ক্লাশে ঢুকতে দেখে সে নিজের ক্লাস ফেলে চলে এসেছিল। যদি সিন্থিয়া কিছু বলত তাহলে নির্ঘাত তার কপালে আজকে খারাবী ছিল। হতে পারে পারভিনকে আসতে দেখেই সে চুপচাপ ফুটে গেছে। পারভিন তার ক্লাশের ভেতরে মাথা বাড়িয়ে উঁকি দিয়ে মিতালীর দৃষ্টি আকর্ষন করল। মুখে কিছু বলল না, মাথা ঝাঁকিয়ে জানতে চাইল, সব ঠিক আছে তো?

মিতালী নিঃশব্দে ঠোঁট নেড়ে বলল, “ঠিক আছে।”

পারভিন এক হাত দেখিয়ে তাকে আশ্বস্ত করে চলে গেল। ভীষণ ঠোঁটকাটা। মিতালী ভয় পাচ্ছিল সিন্থিয়ার নামে আবার গলা উঁচিয়ে কিছু একটা না বলে বসে। খামাখা কোন ঝামেলায় সে জড়াতে চায় না। এক ঘন্টার জন্য আসে, সবার সাথে দেখা টেখা হয়, বাচ্চাদের সাথেও কিছু সময় কাটানো যায়, ভালোই লাগে।

ক্লাশের বাচ্চাদের অধিকাংশই মিতালীকে খুব পছন্দ করে। তাকে দেখলেই তারা খুব খুশী হয়। কয়েকটা আছে একেবারে ওর নেওটা। তাকে দেখলেই হল। মিসেস আলী, মিসেস আলী বলে চেচাতে চেচাতে তাকে এসে জড়িয়ে ধরবে। আলী মিতালীর লাস্ট নেম। আজও ব্যাতিক্রম হল না। ভারতীয় মেয়ে চুমকি, কালো মেয়ে মেলিসা এবং শ্রিলঙ্কান মেয়ে রীতা তাকে দেখেই দৌড়ে এল। একেবারে জড়িয়ে ধরে মহা আনন্দে হাসতে লাগল। মিতালী তাদেরকে জোর করে ডেস্কে পাঠাল। লাঞ্চ খেতে হবে। লাঞ্চ খাবার জন্য সময় বেশী দেয়া হয় না। সময় শেষ হলেই সবাই বাইরে যেতে পারবে খেলার জন্য। অনেক বাচ্চাই সব খায় না। কোন রকমে কিছু একটা খেয়ে খেলতে যাবার জন্য ব্যাস্ত হয়ে পড়ে।

            ক্লাশে বাচ্চাদের মধ্যে শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাজ্ঞ এবং ভারতীয় কিংবা বাদামী বাচ্চাদের সংখ্যা প্রায় সমান সমান। আগে শ্বেতাঙ্গ বাচ্চাদের সংখ্যা বেশী ছিল। ইদানীং এই এলাকায় মনে হয় ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষেরা বেশী আসছে। ক্লাশে শ্বেতাঙ্গ বাচ্চাদের সংখ্যা ছাপিয়ে তাদের সংখ্যা বাড়ছে। মিতালী শুনেছে  অনেক শ্বেতাঙ্গ পরিবার নাকি আরোও দূরের শহরে চলে যাচ্ছে, যেখানে শ্বেতাংদের সংখ্যা বেশী। তার ব্যাপারটা ভালো লাগে না। সব ধরণের বাচ্চাদের দেখলেই সে খুশী হয়। এই বাচ্চাগুলোই তো একদিন বড় হবে, এই দেশে একসাথে থাকবে, জীবন যাপন করবে।

            বাচ্চাদের অধিকাংশই খুব হাসি খুশী। কথাবার্তা বললে শোনে। তারা জানে লাঞ্চ মনিটর ঠিক শিক্ষকদের মত নয় কিন্তু তারপরও তারা লাঞ্চ মনিটরদেরকে শিক্ষকদের মতই দেখে। এই জন্য অবশ্য প্রিন্সিপাল এবং ভাইস প্রিন্সিপালের কৃতিত্ব আছে। তারা সব ছাত্র ছাত্রীকে সোজা সাপটা জানিয়েছে লাঞ্চ মনিটরদেরকে শিক্ষদের মত সম্মান করতে। তারপরও সবাই মানে না। বিশেষ করে উঁচু ক্লাশের বাচ্চাদের নিয়ে সমস্যা হয়। তাদের একটা কথা বললে এমন ভাব ভঙ্গী করতে থাকে যে মেজাজ ঠিক রাখা দায় হয়ে দাঁড়ায়। আবার কিছু বলারও উপায় নেই। অল্পতেই বেঁকে বসে। তখন আর কোন কথাই শুনতে চায় না। এই জন্য সবাই নীচু ক্লাশে থাকতে চায়।

            একটা ছেলেকে ক’ দিন ধরে খেয়াল করছে মিতালী। কৃষ্ণাজ্ঞ বাচ্চা। একটু বড় সড়, স্বাস্থ্যটাও ভালো। কয়েক মাস হল বাচ্চাটাকে এই স্কুলে দেখছে মালতি। বোধহয় অন্য কোথাও থেকে ইদানীং এই শহরে এসেছে। তার বাবাকে কখন না দেখলেও মাকে সে দু’ একবার দেখেছে। মনে হয় ফুল টাইম কাজ করে। বাচ্চাটাকে কোনরকমে গাড়ি থেকে সকালে নামিয়ে দিয়েই জোরে গাড়ি ছুটিয়ে চলে যায়। ছেলেটার নাম মালেক।  সে ঠিক অন্য বাচ্চাদের মত নয়। সবসময় মনে হয় খুব রেগে আছে। তাকে ক্লাশে সামলানো একটু সমস্যা হয় মাঝে মাঝে। হঠাৎ হঠাৎ একেবারে বেঁকে বসে। কারো কথাই শুনবে না। মুখ ফুলিয়ে ঘাড় বাঁকা করে বসে থাকবে। লাঞ্চ মনিটর তো দূরে থাক, সবচেয়ে মেজাজী শিক্ষকরাও তাকে নড়াতে পারে না। অন্যন্য বাচ্চাদের সাথেও তার খুব একটা ভালো সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না।  সবসময় হয় একা একা ঘুরছে, নয়ত অন্য বাচ্চাদেরকে অকারনে ধাক্কা ধাক্কি করছে। শরীর বড় হওয়ায় অধিকাংশ বাচ্চা তাকে এড়িয়ে চলে।

প্রথম দিকে সবাই ভাবত হয়ত বাচ্চাটার কোন সমস্যা আছে, কিন্তু পরে দেখা গেল শারীরিক এবং মানষিক দিক থেকে সে স্বাভাবিক। লাঞ্চ মনিটরদের মধ্যে মাঝে মাঝে ঝামেলার বাচ্চাগুলোকে নিয়ে কথাবার্তা হয়। তখন নানা ধরণের খবর পাওয়া যায়। এদিক থেকে পারভিন হচ্ছে সবার উপরে। কিভাবে যেন সে সব বাচ্চাদের ব্যাপারে খোঁজ খবর পেয়ে যায়। তার কাছ থেকেই জানা গেছে মালেকের বাব-মায়ের মধ্যে বনি বনা নেই। বাবা-মা একসাথে থাকলেও সব সময় নাকি ঝগড়া ঝাটি চলতে থাকে। পারভিনের পরিচিত কে নাকি তাদের বাসার কাছে থাকে। সে-ই বলেছে। ব্যাপারটা শোনার পর থেকেই ছেলেটার জন্য একটু মন খারাপ হয়েছিল মিতালীর। ছোট বাচ্চা। বাসায় সমস্যা থাকলে তার প্রভাব তো তার উপর পড়বেই। হয়ত বাসায় তাকে যথাযথ সময় দেয়া হচ্ছে না, বাচ্চারা অবহেলা বুঝতে পারে। ক্রমাগত অবহেলার মধ্যে থাকলে তাদের ব্যবহারে তার ছাপ তো পড়বেই। তার ইচ্ছে হয় ছেলেটাকে কোথাও বসিয়ে তার সাথে মন খুলে কথা বলে, তার বাবা মায়ের কথা জিজ্ঞেস করে, বাসার কথা জিজ্ঞেস করে। কিন্তু সেটা করার প্রশ্নই আসে না। একেবারে হুলস্থুল কাণ্ড হয়ে যাবে। স্কুলে বাচ্চাদের সাথে কথাবার্তা অনেক সাবধানে বলতে হয়। তারা বাসায় গিয়ে বাবা মাকে কি বলবে, দেখা যাবে বাবা মা ছুটে এসে পড়েছে নালিশ নিয়ে। অনেক ক্ষেত্রে আবার তারা ঝট কর খবরের কাগজে চলে যায়। স্কুলের অফিস থেকে সবাইকে এই কারণে সবসময় সতর্ক করে দেয়া হয়।

            লাঞ্চের টাইম শেষ হতে সবাইকে বাইরে যাবার জন্য তাড়া দিল মিতালী। খাবার দাবার ফেলে ছুটল সবাই। বাইরে খেলার জন্য পাগল সবগুলো। ঠান্ডা, গরম, বৃষ্টি – কোন কিছুতেই তাদেরকে আটকানো যায় না। যদিও আবহাওয়া বেশী খারাপ হলে তাদেরকে বাইরে নেয়া হয় না। আজকে অবশ্য বাইরে বেশ ভালো। বসন্তের শুরু। ঠান্ডা টা কেটে গিয়ে বেশ গরম আসছে। এখনও সামান্য ঠান্ডার রেশ থাকলেও জ্যাকেট না পরলেও চলে। অনশ্য সব দিন আবার সমান নয়। এখনও মাঝে মাঝে হঠাৎ করে বেশ শীত পড়ে, তখন আবার জ্যাকেট না পরলেই নয়।

            সবাই বাইরে গেলে মিতালীর কাজ হচ্ছে খেয়াল রাখা যেন ওর ক্লাশের বাচ্চারা চোখের আড়াল না হয় কিংবা উলোপাল্টা কিছু না করে। তারা নিজেরা যেমন ব্যাথা পেতে পারে, অন্যদেরকেও ব্যাথা দিতে পারে। তা ছাড়া নিরাপত্তার ব্যাপার আছে। স্কুলের মাঠটা আবার একটা পার্কের অংশ। মানুষ জন চলাফেরা করে। খেয়াল রাখতে হয়। আজকাল নানা দিকে অনেক খারাপ মানুষের আনাগোনা। কার মনে কি আছে কে জানে। সমস্যা দেখা দিল মালেককে নিয়ে। সে আজকে কিছুতেই বাইরে যাবে না। তার মেজাজ ভালো নেই। কেন যাবে না তাও বলছে না। নিজের সিটে সেই যে মুখ ফুলিয়ে চোখ মুখ পাকিয়ে বসে আছে, তো আছেই। মিতালী সুন্দর করে বলেছে, একটু কড়া করে বলেছে, যুক্তি দিয়ে বলেছে, কিছুতেই কিছু হল না। কি করবে বুঝতে পারছে না সে। এই জাতীয় ক্ষেত্রে শিক্ষকদের কাউকে ডাকাটাই নিয়ম। তারা সাধারণত বেশ শাষন করে থাকেন। বাচ্চারা তাদেরকে একটু ভয়ও পায়। কিন্তু আগের অভিজ্ঞতা থেকে মিতালী দেখেছে মালেক যেদিন বেঁকে বসে সেদিন শিক্ষকরাও কিছু করতে পারে না। সে নিজের আসন ছেড়ে নড়েও না, কোন কথাও বলে না। শিক্ষকরা সাধারণত হাল ছেড়ে দেয়। কোন বাচ্চাকে একা রাখা যায় না। ফলে কাউকে লাঞ্চ টাইম ফেলে তার সাথে থাকতে হয়।

            কি করবে ভাবছে মিতালী। বাকী বাচ্চারা সবাই বাইরে চলে গেছে। তাকেও যেতে হবে। বাচ্চাগুলো খুব দুষ্টু। একটু সুযোগ পেলেই একেকজন একেকদিকে ছূটে যায়। অসহায়ের মত মালেকের দিকে তাকাল সে। এইটুকু ছেলে এমন কেন করবে? তার নিজের বাচ্চারা এখন একটু বড় কিন্তু ছোটবেলায় তারা রাগ দেখালেও এমন ঘাড় ত্যাড়া করে ঘন্টার পর ঘন্টা তো বসে থাকত না। নিশ্চয় কিছু একটা হয়েছে ওর আজকে। শিক্ষকদের ডাকার আগে আরেকবার চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত নিল সে। বাইরে বেরিয়ে পারভিনকে ওর ক্লাশের বাচ্চাদের উপর একটু চোখ রাখতে বলে দ্রুত ভেতরে চলে এলো সে। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে মালেকের পাশে বসল। “মালেক, কি হয়েছে তোমার বল তো?” মিষ্টি করে বলল সে।

মালেক ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকাল। কোন উত্তর দিল না।

“বলবে না আমাকে?”

মালেক এবার মুখ বাঁকিয়ে এমন একটা ভাব করল যেন সে একটা খারাপ কিছু বলবে। কিন্তু বলল না। চোখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে বসে থাকল।

চুপি চুপি একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল মিতালী। “তোমার কি মন খারাপ? কেউ কিছু বলেছে?”

কোন উত্তর নেই। মালেক এখন আর তার দিকে তাকাচ্ছেও না।

কি বিপদ! সাধারণত একটু ভালো করে কথা বললেই অধিকাংশ ত্যাড়া বাচ্চারাই সোজা হয়ে যায়। বিশেষ করে এই বয়েসের বাচ্চাগুলো। কিন্তু জামাল একটু অন্য ধাঁচের। তাকে কোন ভাবেই কিছু করা যায় না। তাকে নিয়ে সবারই অল্প বিস্তর সমস্যা হয়। ঘড়ি দেখল মিতালী। সময় বয়ে যাচ্ছে। পারভিনের একার পক্ষে এতোগুলো বাচ্চাকে দেখা সম্ভব হবে না। যা করার খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে। সেই সময় মাথায় বুদ্ধিটা এলো।

            “জামাল, আমার কি মনে হয় জান? আমার মনে হয় তোমার দরকার একটা hug. কি? চাও?”

            তাকে অবাক করে দিয়ে জামালের গোমড়া মুখে বিশাল একটা হাসি ফুটল। “হ্যাঁ, চাই!”

নিজের চেয়ার ছেড়ে এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। মিতালী তাকে নীচু হয়ে একটা লম্বা hug দিল। তাতে যাদুর মত কাজ হল। মালেকের একটু আগের সমস্ত রাগ, ক্ষোভ যেন কোথায় উধাও হয়ে গেল। তার ঝকঝকে সাদা দাঁতের পাটি বেরিয়ে এসেছে। “আমি এবার বাইরে খেলতে যাবো।”

পরিত্রানের নিঃশ্বাস ছাড়ল মিতালী। যাক, বাঁচা গেল। এই ছেলেকে কোনভাবে যে ঠিক করা সম্ভব সে ভাবেই নি। বোঝাই যায়, বাসায় তাকে ঠিকমত ভালোবাসা দেয়া হচ্ছে না। বাবা-মা নিজেদের সমস্যা নিয়ে ব্যাস্ত, ছেলেটার অন্যান্য চাহিদার পাশাপাশি যে মানসিক চাহিদাও মেটানো প্রয়োজন তাদের হয়ত খেয়ালও নেই। অবশ্য, অনেকের আবার এতো ব্যস্ততা থাকে যে সময়ও হয়ত যথেষ্ট থাকে না। সব না জেনে সে কাউকে দোষারোপ করতে চায় না।

            সেদিনের মত আর কোন ঝামেলা করল না মালেক।

 

            পরদিন সময় মত ক্লাশে হাজিরা দিল মিতালী। তাকে দেখা মাত্র নিজের আসন ছেড়ে ছুটে এলো মালেক। “মিসেস আলী, আমাকে একটা hug করবে প্লিজ?”

মিতালী হেসে ফেলল। “নিশ্চয়। আজকে তুমি ক্লাশে ভালো হয়ে ছিলে তো?”

“হ্যাঁ, আমি কোন ঝামেলা করি নি। জিজ্ঞেস কর সবাইকে।” মালেক খুশি মনে বলল।

সিন্থিয়া মুচকি হাসল। চুপি চুপি বলল, “মনে হচ্ছে ওকে সামলানোর মোক্ষম অস্ত্র পেয়েছ। আজকে আসলেই কোন ঝামেলা করে নি। বাসায় মনে হয় আদর পায় না। দেখ বাচ্চাদেরকে, আমি লাঞ্চে গেলাম।”

তার কথার উত্তর দেবার সময় পেল না মিতালী। জামালের পেছনে ক্লাশের অর্ধেক ছেলেমেয়েরা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। তারা সবাই মিতালীকে hug করবে। তাদের সবার নাকি মন খারাপ।  সিন্থিয়া হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল। দুই মুহুর্ত পরে আবার ফিরে এল। মিতালীর কাছে এসে গলা নামিয়ে বলল, “মিসেস আলী, তোমাকে একটা কথা বলি। পারভিন মনে হয় আমার উপর খুব রেগে আছে। ওকে বল আমি ওর সাথে খারাপ ব্যবহার অরবার জন্য দু:খিত। আমারই ভুল হয়েছে।”

মিতালী বলল, “তুমি নিজে কেন বলছ না?”

সিন্থিয়া ঠোঁট কামড়াল। “যা মেজাজ তার। দেখা যাবে আবার ঝগড়া শুরু করেছে।”

হেসে ফেলল মিতালী। “ওকে গিয়ে একটা hug দাও। দেখ কি করে। তোমার জন্য জীবন দিয়ে দেবে।”

মুচকি হেসে বেরিয়ে গেল সিন্থিয়া। মালেক দুই হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মিতালী তাকে hug দিল। “সব সময় ভালো হয়ে থাকবে, ঠিক আছে?”

বড় করে মাথা নাড়ল মালেক। তার কৃষ্ণ মুখে আনন্দের প্রভা বিকশিত হয়ে উঠেছে। মিতালী মনে মনে ভাবল, “কৃষ্ণকলি!”