সব প্রেমের পরিনতি শুভ পরিণয় নয়। অনেক প্রেমই সমাপ্ত হয় চির বিচ্ছেদের অসীম পাথারে। আজ দ্বিতীয় ধারায় পড়ে এরকম এক প্রেম কাহিনি থেকে মজাদার কিছু তুলে ধরবো। ঘটনাস্থল কর্ণাটক ইউনিভার্সিটি। পি-এইচ,ডি, স্টুডেন্ট হিসেবে আমি সেখানে কর্মরত। রিসার্স ল্যাবে আমি ছাড়া আর ও দুজন পি-এইচ,ডি,স্কলার ছিল। একজন সুরেশ অন্যজন শান্তেরি। ওরা দুজন আমার যোগদানের আগে থেকেই কাজ করে যাচ্ছিল। আমি যোগদান করলাম, দেখতে থাকলাম এবং অল্প কদিনের মধ্যে বুঝলাম দুজনের প্রেমের চলছে মহাজাগতিক কাল। আমার কাছে বেশ ভালই লাগলো। দুজনই খুব মেধাবি এবং সুশ্রী। একসাথে দুজনকে দেখলে মনে হয় রুপনগর; একসাথে দুজনকে দেখলে আমার আরও মনে পড়তো প্রখ্যাত বাউল গায়ক গোপাল দাসের কন্ঠে লালনের সেই অত্যান্ত জনপ্রিয় গানের প্রথম কলি - " চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে আমরা ভেবে করবো কি!" । দুজনই রিসার্সেও বেশ মনোযোগি। বুঝেও ভালো। ল্যাবে সুন্দর একটা পরিবেশ। আমার বেশ ভাল লাগছিল। তবে তারা দুজন দুরকম প্রকৃতির মানুষ। সুরেশ জেদী, ডিটারমাইন্ড, আউটস্পোকেন। কালোকে শ্যামলা বলতে সে নারাজ। সে স্বপ্ন দেখে, তবে সে স্বপ্ন নিয়ে নিরন্তর বীণ বাজায়না। অপরদিকে শান্তেরি সহজ সরল খুব কম্প্রোমাইজড। জগত বিখ্যাত ফার্সি কবি, দার্শনিক ওমর খৈয়ামের সেই বিখ্যাত উক্তি, "দূরের বাদ্য কি লাভ শুনে মাঝখানে যে বেজায় ফাঁক", তে তার কোন রকম আস্থাই নাই। সে স্বপ্ন দেখে আর সে স্বপ্নের নির্যাস নিজে তৈরী করে অর্থহীন ভাবে পরিতৃপ্ত হয়। এই বিশাল প্রকৃতির সবকিছুতে যে আলো-আঁধারির বিরামহীন খেলা চলছে তা সে তার বোধের মধ্যে আনতে চায়না। এভারেস্টের চূড়ায় যারা উঠেছে তাদেরকে যে কৈলাশ, অন্নপূর্ণা, ধবলগিরি, আর কাঞ্চনঝংঘা ও অতিক্রান্ত করতে হয়েছে তাতো জানতে হবে। যাই হোক,এভাবে দিন যায় মাস যায়। এক সময় আমার মনে হতে থাকলো দুজনের মধ্যে সম্পর্ক আগের মত যাচ্ছেনা। বসন্তের মিস্টি ঝিরি ঝিরি হাওয়া আর বইতেছেনা; তার পরিবর্তে বইছে দুজনকে ঘিরে শুস্ক তপ্ত লু হাওয়া। ধীরে ধীরে লু হাওয়া ভয়ংকর মরু ঝড়ে রুপান্তরিত হলো। দুজনই বিপদগ্রস্থ। তবে এর মধ্যেও সুরেশ তার টান টান ভাব নিয়ে চলছে , কিন্তু শান্তেরি একেবারেই বিমূঢ় বিপর্যস্ত। ল্যাবে দুজনের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হতো প্র্থম দিকে। আমি কিছুই বুঝতামনা। কারণ ওরা কথা বলতো কানাড়া ভাষায়। শুধু বুঝতাম শান্তেরি কি যেন বুঝাতে চায়্, কিন্তু সুরেশ বুঝতে চায়না। আস্তে আস্তে দেখলাম শান্তেরি ক্লান্ত। শান্তেরি শুধু কাঁদে, সুরেশকে বুঝানোর আশা ছেড়ে দিয়েছে। ফলে শান্তেরির মধ্যে আর উত্তপ্ত ভাব নাই। শান্তেরি অতিশয় পরিশ্রান্ত। নাওয়া খাওয়া নাই। আশাহীনতা আর সীমাহীন মনোকস্টের অলঙ্ঘনীয় বেড়া ঘেরে শান্তেরি বন্দিনী। ওদের কি সমস্যা জানতে চেয়েছি , কিন্তু দুজনের কেউ আমাকে জানতে দেয়নি। সুরেশর যে কোন কস্ট নাই তা নয় ; কস্ট সুরেশেরও আছে। কিন্তু সুরেশের ভাবে বুঝা যায় এ কস্টের ভার বইতে সে ডিটারমাইন্ড। এবার পরিস্থিতি এমন হলো যে ল্যাবে দুজন আসে, কিন্তু শান্তেরি ওর সাথে কথা বলতে চাইলেই সে ল্যাব ছেড়ে চলে যায়। এরপর শান্তেরি শুরু করে মরা কান্না। আমি সুরেশকে ধরলাম, বললাম - ওর সাথে কথা বল। সুরেশের সাফ কথা - আমি ওর সাথে জীবনেও কোন দিন কথা বলবোনা, তুমি ওকে বল ও যেন আমার সাথে কথা বলার কোন চেস্টা না করে। শান্তেরিকে বললাম - সুরেশ এই বলেছে, তোমারতো এখন আর করার কিছুই নাই। শান্তেরি সুরু করে দিল কান্না। আমি বললাম - কেঁদে কি হবে! তুমিতো সুরেশকে আর ফিরে পাবেনা। শান্তেরি সুরু করে দিল আবার বিলাপ - সুরেশকে ছাড়া আমি বাঁচবোনা, আমি মরে যাব। আমার অবস্থাও ত্রাহি। কি করবো, এই অবুঝ মেয়েকে কিভাবে বাঁচাবো কিছুই বুঝতেছিনা। আমার নিজের উপরও রাগ হলো। কোথা থেকে কিভাবে যে আমার পাশে এসব উটকো ঝামেলার সৃস্টি হয় বুঝিনা। মনে পড়ে গেল ঢাকা ইউনিভার্সিটির কথা। সেখানে অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়াকালিন আমার ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুরও এ অবস্থা হয়ে ছিল (আমি নাম দিয়েছি "ফরমালিন" অবস্থা)। সেও বাঁচবেনা , মরে যাবে। তারও হয়েছিল এই "বাঁচবোনা, মরে যাবো" অবস্থা॥ খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। তাকে আমার রুমে নিয়ে আসলাম। আমার কাছে রেখে দিনের পর দিন কাউনসেলিং করে ফরমালিন খাওয়া থেকে তাকে নিবৃত্ত করলাম। কিন্তু "কোন দিনও বিয়ে করবোনা" তার এই ইস্পাত কঠিন প্রতিগ্যা থেকে তাকে নিবৃত্ত করতে আমাকে এবং তার পরিবার সহ সবাইকে ২০১৩ সন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। ২০১৩ সনে ৫৯ বছর বয়সে খ্যাতনামা এই সাইনটিষ্ট (পিএইচ-ডি, পোষ্ট্-ডক্টরাল ফেলো, আমেরিকা) বিয়ে করেছে। শান্তেরি তো আর আমার ছেলে বন্ধু নয় । ভিষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। তারপরও যখনই সময় সুযোগ পাই বোঝাতে চেস্টা করি। সেদিনও অনেকক্ষণ বোঝালাম, ক্যান্টিন থেকে খাবার আনিয়ে বসিয়ে খাওয়ালাম। শেষে বললাম - দেখ শান্তেরি, স্যারের (আমাদের রিসার্স সুপারভাইজর) কথা বার্তায় বেশ বোঝা যায় তোমার কাজের অগ্র গতিতে স্যার সন্তুস্ট নয়, সব বিষয় নিয়ে তুমি স্যারের সাথে কথা বললে কেমন হয় ? শান্তেরি বললো - স্যার জানে। বললাম - কিভাবে? বললো সেই স্যারের সাথে কথা বলেছে, স্যার সুরেশের সাথে কথা বলেছে, কিন্তু তাতেও কোন ফল আসেনি। তারপর আরো অনেক কথা হলো। অনেক বোঝালাম এবং তার হলে পাঠিয়ে দিলাম। যাওয়ার সময় বললাম - কদিন একটানা হলে থাক, কোথাও বের হয়োনা। ল্যাবে আসিওনা। দেখি তুমি আসতেছনা দেখে সুরেশ তোমার কথা কিছু আমাকে জিগ্যাসা করে কিনা। পর পর তিন দিন শান্তেরি ল্যাবে অনুপস্থিত। সুরেশ আসে প্রতিদিন। আমাদের মাঝে কথা বার্তা হয়। কিন্তু এই তিন দিনে ভূলেও একবারও শান্তেরির নাম মুখে আনেনি সুরেশ। আমার উপদেশ শুনে শান্তেরি সুরেশকে কি ভাবছে আমি জানিনা, তবে সুরেশ যে শান্তেরির নাম মুখে আনবেনা তা আমি জানতাম; সুরেশকে আমি চিনি। তিনদিন পর চতুর্থ দিন শান্তেরি ল্যাবে হাজির। য্থারীতি সুরেশও ল্যাবে উপস্থিত। শান্তেরির চেহারায় ক্লান্তির ভাব আগের চেয়ে একটু কম। ওকে এরকম দেখে আমার একটু ভাল লাগলো। ঘন্টা খানেক তিনজনই চুপ চাপ; যে যার মত নিজ নিজ কাজে ব্যাস্ত। হঠাত কানাড়া ভাষায় শান্তেরি কি যেন বললো। ওদের কারো দিকে তাকাবার ফুরসত আমার নাই। আমার দুচোখ আমার কম্পাউন্ড মাইক্রোস্কোপের দুই অকিউলার ল্যান্সের উপর থিতু। শান্তেরি কানাড়া ভাষায় আবার ও কি যেন বললো। সুরেশের কোন শব্দ নাই। পাঁচ মিনিট পর সুরেশ ল্যাব ত্যাগ করলো। শান্তেরির শুরু হলো কান্না। আমি ভিষণ বিরক্তবোধ করলাম শান্তেরির আচরনে। আমি মাইক্রোস্কোপের উপর থেকে আমার মুখ তুললাম এবং শান্তেরির দিকে ফিরে বললাম - আচ্ছা শান্তেরি, তুমি ওর দিকে কথা ছুড়ে দিলে কেন? বাচ্চাদের মত ওর এককথা - ওকে ছাড়া আমি বাঁচবোনা। আমি মুখে কিছু বললাম না, তবে মনে মনে বললাম- আচ্ছা ঠিক আছে, মর। শান্তেরির কান্না থামেনা। কিছুক্ষণ পর আমি বললাম - শান্তেরি কান্না থামাও , স্যার আসার সময় হলো প্রায়। এখানে বলে রাখা দরকার আমাদের একটা রুটিন ছিল এরকম - প্রতিদিন সকাল সাড়ে এগারটায় আমাদের স্যার ল্যাবে আসবেন, আমাদের নিয়ে বসবেন, ৩০ থেকে ৪০ মিনিট থাকবেন। এই সময়টুকুতে আমাদের মধ্যে আলোচনা হবে আমাদের রিসার্স ওয়ার্ক নিয়ে। আমরা আমাদের কোন সমস্যা থাকলে বা কাজ নিয়ে নতুন কোন আইডিয়া আসলে তা আমরা স্যারকে বলি, স্যার আমাদের দিক নির্দেশনা দেন, ইত্যাদি। আমাদের সবার অভিমত এই সময়্টা আমাদের সবার কাছেই বেশ চমতকার সময়। আমরা প্রতিদিন এই সময়ের অপেক্ষায় থাকি। আমার কথা শুনে শান্তেরি হঠাত সম্ভিত ফিরে পেল। ঘড়ি দেখলো এবং খুব তাড়াতাড়ি ব্যাগ গোছালো। তারপর চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো। আমি বললাম - সুরেশ আমাকে কিছু বলে যায়নি, তুমিও চলে যাচ্ছ, তুমি কোথায় গেছ এ প্রশ্ন যদি স্যার করে তাহলে আমি কি বলবো? শান্তেরি বললো - এরকম যদি প্রশ্ন করে তাহলে উত্তর দিও - শান্তেরি সাত্তা । আমি বললাম - এ কথার অর্থ কি? শান্তেরি বললো- এ কথার অর্থ তোমার জানার দরকার নাই; অর্থ স্যার জানে। তুমি শুধু বলবে - শান্তেরি সাত্তা। এটা বলেই শান্তেরি হন হন করে ল্যাব থেকে বের হয়ে গেল। শান্তেরির যাওয়ার পাঁচ মিনিট পরই স্যার ল্যাবে ঢুকলেন। ঢুকেই দেখলেন সুরেশ নাই, শান্তেরি নাই। আমার নিকট থেকে জানতে চাইলেন ওরা দুজন কোথায়। আমি বললাম - সুরেশ কোথায় জানিনা, তবে শান্তেরি সাত্তা । স্যার জোরে শব্দ করে বললেন - হো-য়া-ট? আমিতো শান্তেরিকে ঘন্টা খানেক আগেও ল্যাবে দেখেছি। স্যারের অবস্থা দেখে আমি খুবই অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। কি বললাম আর এখন কি বলবো বুঝতে পারছিলামনা। অসহায় ভাবে বললাম - আমি জানিনা। স্যার শান্ত স্বরে এবার আমাকে বললেন - আচ্ছা বাহারুল বলোত শান্তেরি ঠিক কতক্ষণ আগে ল্যাব ছেড়েছে। আমি বললাম - এইতো ৫\৭ মিনিট আগে। স্যার এবার একটু হাসলেন এবং জানতে চাইলেন "শান্তেরি সাত্তা " এই কানাড়া কথাটা আমাকে কে শিখিয়েছে। আমি বললাম - শান্তেরি রুম থেকে বের হওয়ার আগে এটা আমাকে শিখিয়েছে এবং বলেছে সে কোথায় তা যদি তুমি জানতে চাও তাহলে আমি যেন তোমাকে বলি - শান্তেরি সাত্তা । স্যার এবার ভালোই একটা হাসি দিলেন এবং আমাকে বললেন - তুমি কি জান "শান্তেরি সাত্তা " এ কথার অর্থ কি? আমি কাচুমাচু করে বললাম – না, আমি জানিনা। স্যার হেসে বললেন - এর অর্থ হলো- শান্তেরি মারা গেছে। সেদিন স্যার আর বসলেন না ল্যাবে। চলে গেলেন নিজের রুমে। আমার রাগও হলো আবার হাসিও আসলো; শান্তেরি এরকম একটা কথা বলতে আমাকে বলে গেল! তারপরও আরো কাহিনি আছে। সেসব কথা থাক। পরিশেষে শুধু এটুকু বলবো যে শান্তেরি মরে নাই। শান্তেরি বেঁচে আছে এবং বেশ ভাল আছে। লন্ডনের বড় এক হাসপাতালের বড় বড় ডিগ্রীধারি বড় এক ডাক্তারের স্ত্রী হয়ে এখন সে লন্ডনে। তাদের দুটি অনিন্দ সুন্দর পুত্র সন্তানও আছে।