Table of Content

Arju Mun Zarin
NA
NA
1 articles

আনিকা ও তাহেরের আপন ভূবন (প্রেমের গল্প)

লেখক: আরজু মুন জারিন Category: ছোট গল্প (Short Story) Edition: Dhaboman - Eid 2017

১ তাহের:
দিনগুলি মোর সোনার খাচায় রইলনা
রইলনা সেই যে আমার
নানা রঙের দিনগুলি ।
গানের লাইনগুলি টিকটিক করে মাথায় ঘুরছে কাল থেকে তাহেরের।
পরপর কয়দিন হল একই অবস্থা। রাত তিনটা বাজে তাহেরের ঘুম ভেঙ্গে যায়। মাঝরাতে একবার ঘুম ভেঙ্গে গেলে বাজে অবস্থা হয়। এরপরে দুই তিনঘন্টা অজানা কারনে ঘুম আসতে চায়না। বুকের গভীর থেকে দীর্ঘনিশ্বাস আসতে থাকে। কি একটা দুঃখে বুকের ভিতরটা মথিত হতে থাকে।
ঘুম আসছেনা দেখে উঠে পানি খেল। ওয়াশরুমে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে কম্পিউটার খুলে বসল। ফেসবুকে ঢুকতে দেখল চারটা মেয়ের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট। স্ট্রেন্জ। মেয়েরা কি ছেলেদের ফ্রেন্ড রিকোয়েষ্ট পাঠানো শুরু করল। নাকি কোন ছেলে ফেক আইডি নিয়ে মজা করতে চায়। তার এক বন্ধুর কাছে শুনেছে এক সুন্দরী মেয়ের প্রোফাইল পিকচার দেখে আগ্রহী হয়ে দেখে পরে সে নটরডেম কলেজে পড়ে। খুব হাসাহাসি হল এই প্রসঙ্গে কিছুদিন। ফেসবুকে ঢুকে ও ভাল লাগছেনা । সম্প্রতি তার এই রোগ হয়েছে। কিছু ভাল না লাগার রোগ। আনিকা তার জীবন থেকে সরে যাওয়ার পর থেকে তার জীবনটা এরকম বিস্বাদ হয়ে গিয়েছে।
বেশ অনেকদিন পর আজকে আনিকাকে অসম্ভব মনে পড়ছে। যদিও আনিকা বিহীন জীবনে সে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। এখন আর আগের মত তত বেশী কষ্ট হয়না। সে নিজে ই তো হারিয়ে যেতে দিয়েছে আনিকাকে। ডিভোর্সের পর দুইবছর পার হয়ে গিয়েছে। জানেনা এখন কেমন আছে। আচ্ছা ফোন করে দেখবে নাকি একবার। আগের নাম্বার আছে কিনা। কল্পনায় হারিয়ে যায় সেই প্রথম পরিচয়ের দিনে।
তাদের ডিপার্টর্মেন্টে ক্লাসে প্রথম দিন সবার নাম জিজ্ঞাসা করায় আনিকার নাম বলছিল আনিকা তাহের। তার পাশে বসা ছিল তাহের। তাহের নাম বলাতে স্যার বললেন দুই তাহের একলাইনে। সবাই তাদের দিকে তাকিয়ে হাসছিল। আনিকা ও তার দিকে তাকিয়ে হাসল। ক্লাস শেষে ক্যান্টিনে চা খেতে এসে দেখে কোনার একটা চেয়ারে আনিকা বসা। মাথা নীচু করে কি যেন পড়ছে। সে তাড়াতাড়ি দুইকাপ চা আর সিঙ্গারা নিয়ে আনিকার সামনে এসে দাড়াল।
বসার অনুমতি পেলে বসতে পারি বলল সে হেসে।
বসুন না জড়তাবিহীন গলায় আনিকা বলে।
দেখুন আমি আর আপনি অনেকটা অ্যাটাচমেন্ট এ আছি বলল হেসে তাহের।
আনিকা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতে বলল এই যে আপনি ও তাহের আমি ও তাহের বলল তাহের আবার হেসে।
আমার বাবার নাম তাহের বলল আনিকা লজ্জামাখা গলায়।
ঠিক আছে আমি এখন থেকে আপনার বাবার মত অভিভাবক হলাম। বলল একটু কৌতুকের স্বরে। তাহের নিজে ও জানেনা সে কেম এত কথা বলছিল সেদিন আনিকার সাথে ফ্লার্ট করার ভঙ্গিতে । সে আসলে ওই স্বভাবের না। বরং মেয়েদের থেকে সে একটু নিরাপদ দূরত্বে থাকে সবসময়। ওইদিনে আকাশে বাতাসে কি তরল জিনিস ছিল কে জানে তাহের অনর্গল কথা বলছিল আর আনিকা শুনছিল মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতার মত।
বাসায় যাওয়ার সময় তাহের ই রিকশা ঠিক করে দিল। তারাপর বলে ফেলল সাহসী পুরুষের মত
চাইলে আপনাকে তুমি বলতে পারি আরও যদি চান বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে পারি বলল আগ্রহের সঙ্গে।
আনিকার বিব্রতভাব ছিল দেখার মত। সে একইসঙ্গে প্রথমদিন ই এইভাবে কোন ছেলের সঙ্গে একরিকশায় যাওয়ার পক্ষপাতী না আবার তাহেরের মত উপকারী বন্ধুকে নিষেধ করবে কিভাবে সেটা ভাবছে।
সেই অবস্থা থেকে তাহের ই বাচিয়ে দিল তাকে তার বিব্রত অবস্থা অনুধাবন করে।
ওকে চলে যান আপনি কালকে দেখা হবে রিকশাওয়ালার হাতে ভাড়া গুজে দিল বলল সাবধানে যাবেন। ওড়না খেয়াল করে বসবেন।
সেই শুরু। প্রথমদিন একসঙ্গে না গেলে পরের দিন থেকে হয়ে গিয়েছিল রুটিনের মত। আনিকাকে তার বাসায় নামিয়ে প্রতিদিন একই রিকশায় তাহের হলে ফিরে আসত। তারপর থেকে বিয়ে সংসার সবসময় দুইজন দুইজনের খুটি ছায়ার মত পরস্পর পরস্পরকে ঘিরে থাকা।
সেই আনিকা আজ কোথায়। আশ্চর্য কিভাবে এতদিন সে আনিকাকে না দেখে আছে।

২ আনিকা:
আজকে সারাদিন এত বাজে গেল। ঘর থেকে বের হতে স্লিপ করে পড়ে গেল রাস্তায় তাও এত মানুষের চোখের সামনে। শখ করে বানানো নুতুন জামা য় কাদা লেগে গেল। ঘরে ফিরে আসতে হল আবার। ড্রেস চেন্জ করতে হল। সবকিছু করে অফিসে পৌছতে আধাঘন্টা দেরী হয়ে গেল। ঢোকার মুখে এমডি স্যারের সাথে দেখা। ঠিক যেদিন তার লেট হয় সেদিন এম ডি স্যারের সাথে দেখা হয়। এমডি স্যার নিশ্চয় ভাবছে আনিকা মেয়েটা প্রতিদিন লেট করে। অপ্রস্তুত হয়ে সালাম করল এমডি স্যারকে।
কি সব খবর ভাল?এমডি স্যার হেসে জিজ্ঞাসা করে। এই এমডি স্যার অনেক ভদ্র ভালমানুষ ধরনের । তিনি অফিসে আসেন সবার আগে এবং থাকেন নাকি অনেক রাত পর্যন্ত। যে অফিসে এমডি রা সারাক্ষন থাকে সেখানে কর্মচারীর সময় কাটে চরম ব্যস্ততায়। এমডি স্যারের কাছে নিজেকে করিৎকর্মা দেখাতে অ্যাডমিন ম্যনেজার সবাইকে দৌড়িয়ে মারেন। আনিকা অ্যাডমিন ম্যানেজার এর অ্যাসিসটেন্ট হিসাবে কাজ করে। অফিসের সব চিঠিপত্র টাইপ করা ফ্যাক্স মেইল ডিসপাচ ফোন করেসপন্ড বাহিরে লোকাল সবই তার কাজ।
তার ডেস্কে এসে বসতে প্রায় সাড়ে নয়টা বাজল।
আনিকা দেরী কেন?বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করে অ্যাডমিন স্যার।
স্যার একটা ছোট্র অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল। বিব্রত জবাব তার।
অ্যাকসিডেন্ট কিভাবে কখন হল?বেশ ব্যস্ততার ভঙ্গি করেন তিনি।
না স্যার তেমন কিছু না স্যার রাস্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। আবার ঘরে গিয়ে ড্রেস চেন্জ করে আসতে হল তো স্যার।
সবসময় হাতে হাফ এন রাখবেন আনয়েবয়ডেবল সারকামস্ট্যান্সর জন্য। আপনিতো জানেননা কি হতে যাচ্ছে সামনে। সবসময় প্রিপ্যায়ারড আর অ্যালার্ট থাকবেন। অ্যাডমিন স্যার উপদেশ দেন।
এখন এই চারঘন্টা নিশ্বাস বন্ধ করে কাজ করা। দুইটা বাজে একটু রিল্যাক্স হল । লাঞ্চ করতে আজকে অফিসে নীচের ক্যান্টিনে আসল। এলিভেটরে আবার এমডি স্যারের সাথে দেখা। সুন্দর করে আবার হাসলেন। তাদের অফিসের সবমেয়েরা পাগল এই এমডি স্যারের জন্য। উনি হ্যান্ডসাম একজন মানুষ। আচার আচরনে সোবার এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ।
ক্যান্টিনে এসে আজকে তেমন কোন ভাল মেনু পেলনা। একটা পরোটা আর আলুর তরকারী কিনল। লাঞ্চ করতে করতে ফোন চেক করছে কে কে ফোন করছে। একটা নাম্বার মিলাতে চমকে উঠল মনের অজান্তে।
তাহের এতদিন পরে ফোন করেছে। তাও আবার মাঝরাতে।
কি হয়েছে ওর? ও কি ভাল আছে? ও কি এখন ও ভাবে আমাকে?
স্মৃতির পাতা উল্টে চলে গেল তার বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে।

[ ৩ ]
এক বিষন্ন মনখারাপ করা বিকাল আজ। কাজ শেষ করে বসে আছে তাহের অফিসে । নিজেকে উদ্দেশ্যহীনের মত লাগছে। কি করবে কোথায় যাবে কোনকিছু ই যেন জানা নাই আজ। ইচ্ছে হচ্ছে কিছুক্ষন চিৎকার করে কাদে। তাহলে যদি তার এই বিষন্নতা কাটে।
ভীষন দেখতে ইচ্ছে করছে আনিকা তোমাকে। আমি চলে যাইনা আনিকার কাছে সব রাগ অভিমান ভূলে। আমি যদি ওর কছে মাপ চেয়ে বলি তোমাকে আমার বড় দরকার আনিকা ও কি আমাকে ফিরিয়ে দিবে। মনে মনে ভাবছে আর নিজের সাথে কথা বলছে তাহের।
আশ্চর্য আনিকা এতদিন আমি কিভাবে ছিলাম তোমকে ছাড়া।
আবার ফোন করল সে আনিকার নাম্বারে। নাহ কেও ধরছেনা। মনে হয় ও নাম্বার চেন্জ করেছে।
হাটতে হাটতে চলে আসে টি এস সি চত্বরটতে যেখানে প্রথম আনিকাকে দেখেছিল। ঘাসের উপর শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে আগের মত। ঘুমের মধ্যে চলে যায় স্বপ্নের জগতে।

[ ৪ ]
আনিকার ওড়না আটকে গিয়েছিল রিকশার চাকায়। সেই প্রথম দিন ক্লাসে যাচ্ছিল। রিকশা থেকে নামতে গিয়ে এই বিপত্তি।
ওয়েট ওয়েট পিছন থেকে একটি ছেলে বলে উঠল। সেই তাহের। প্রথমদিনের সেই স্মৃতি হুবহু এখনও মনে আছে আনিকার। রিকশা থেকে নেমে এসে সাবধানে রিকশা থেকে ওড়না বের করে আনল।
খেয়াল করবেন না বলে সে হাসল। তারপর দেখা গেল একই ক্লাস একই ডিপার্টমেন্ট। তাতে আস্তে আস্তে দুজনের সম্পর্ক গাড় রুপ নেয়। সেই থেকে শুরু চলা একসাথে ।
পড়াশোনা শেষ হল । দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ করা। কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করা। তিনবছরের মধ্যে ডিভোর্স। সমস্যা শুরু হয়েছিল আনিকা চাকরীতে জয়েনের পর। তার কাজ যেন মানতে পারছিলনা তাহের। প্রতিদিন ঝগড়া কাজ থেকে ফেরার পর। অসহ্য হয়ে উঠেছিল জীবন।
আচ্ছা আমার কি একটু ধৈর্য ধরা উচিত ছিলনা। মনে মনে সে ভাবে। তাহের তো আমার কাছে তো বড় কিছু চায়নি। একটু সাহচর্য ভালবাসা সব স্বামী যা চায়। আমার বাসায় ফিরতে দেরী হত কাজ শেষে সেটা কি আামার দোষ। নিজেকে জবাবদিহীতার ভঙ্গিতে সে বলতে থাকে। তাহের কেন আমাকে ফোর্স করবে জব ছাড়ানোর জন্য। ওর কি উচিত ছিলনা আমার ইচ্ছা অনিচ্ছার সন্মান করা। এসব ভাবছে রিকশায় বসে বাসার দিকে যেতে যেতে। বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করেনা। মায়ের এক কথা। বিয়ে কর। মায়ের এক দুঃসম্পর্কের খালাত বোনের ছেলে ঘরে গেলে দেখে ড্রঈং রুমে বসে আছে। মায়ের সাথে কথাকাটি করার ইচ্ছা নাই আজকে। এই সময় কোথাও বসে পার করা যাক।
তার ফোনটা আবার বেজে উঠল। আবার তাহেরের ফোন। বুঝতে পারছেনা ফোন ধরবে কিনা। ভাবতে ভাবতে ফোনটা কেটে গেল। ধরলে বা কি কথা বলবে। সব ঝগড়া বিভেদ ভুলে বিচ্ছেদের দেওয়াল সরিয়ে আজ কি সে সহজভাবে কথা বলতে পারবে।
রিকশা থেকে নেমে পড়ল। কার্জন হলের মাঠের দিকে হাটতে হাটতে একসময়ে এসে দাড়াল তার প্রিয় সেই গোল চত্তরের কাছে। হাটতে হাটতে ফোনে ঘুরলো তাহেরের নাম্বার।
একইসঙ্গে তাহেরের কথা কেমন আছ । সামনে দাড়িয়ে থাকতে দেখল তাহেরকে।
দুজন দুজনকে দেখে চমকে উঠল খুশীতে। এই তাদের সেই প্রিয় জায়গা ক্লাস শেষে বাসায় যাওয়ার আগে কিছুক্ষনের জন্য তারা বসত। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকল কতক্ষন। প্রায় দুইবছর তিনমাস পাঁচদিন পরে দেখা দুজনের। দুজনের মনে হল এখন ও কিছু ই হারিয়ে যায়নি। সেই একই আবেগবোধ করল দুজন দুজনের প্রতি যা প্রথম প্রেমের স্বীকৃতি পাওয়ার দিন তারা বোধ করেছিল।
শুকিয়ে গেছ তুমি আবেগঘন গলায় বলল আনিকা।
তুমি নাই তো তাই তাহের বলল। না খেয়ে শুয়ে থাকতাম প্রায় সময়।
ইশ এরকম করতে কেন । আমাকে ফোন দিলে তো চলে আসতাম। বিষন্ন আনিকা বলল।
এইতো দিলাম তুমি এলে তাহের হাসল। মিছিমিছি দুইটা বৎসর কষ্ট পেলাম।
দুইজন দুইজনের চোখের দিকে তকিয়ে হাসতে থাকে আনন্দে আবেগে ভালবাসায় এবং একই সঙ্গে চোখে আনন্দের অশ্রজলে।
চল বাসায় যাই বলে এসে হাত ধরল তাহের আনিকার।
চল বলল আনিকা।
তারা ভূলে গেল তাদের দুইবছরের বিচ্ছেদের কথা।
পুরানো গৃহ আহত বিষন্ন মনটাকে মেরামত করে নুতুন করে আবার সুন্দর জীবনের স্বপ্নে বুদ হল ।