রোহিঙ্গা শরনার্থীর মোড়কে মায়ানমার, বাংলাদেশ এবং বৈশ্বিক সমস্যার আবর্তন

লেখক: লুৎফুল হোসেন Category: প্রবন্ধ (Essay) Edition: Dhaboman - Fall 2017

ঔপনিবেশিকতার প্রতিকৃতি বহুরূপী। ইচ্ছা কি অনিচ্ছায় জয়ীর নির্ধারিত সুরেই গান গাইতে হয় বিজিতদেরকে। ক্ষমতা আর শক্তিমত্তা এমনই দুর্দমনীয় যে সত্য তার রঙেই সর্বদা রঞ্জিত হয়। ভারত উপমহাদেশ যখন উপনিবেশ, তখন সেই ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী তদানীন্তন বার্মার আধিপত্য কুক্ষিগত করবার পর সেখানকার অবকাঠামোগত নির্মাণ ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সম্পাদনের জন্য ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পেশাগত দক্ষতা বিবেচনায় অনেক নির্মাণকর্মী ও শ্রমিক অভিবাসিত করে। সেই অভিবাসিত জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই ছিল নিকট দূরত্ব থেকে আগত মুসলিম, যারা মূলত রাখাইন প্রদেশেই তাদের বসতি স্থাপন করে অতীত ইতিহাস, ভৌগলিক ও প্রতিপার্শিক কারণে।

অষ্টম শতকে দক্ষিণ এশিয়ার আরাকান রাজ্যে বসবাস করতো রোহিঙ্গা নামে এক জনগোষ্ঠী। আরাকান রাজ্য পরিচয়ের সেই ভূখণ্ডটিই আজ মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশ নামে পরিচিত। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বি অধ্যুষিত মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশে মুসলিম রোহিঙ্গারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ, রাখাইন বৌদ্ধরা সংখ্যায় কম। সেইসাথে কিছু হিন্দুদেরও বসবাস আছে।

নবম থেকে চতুর্দশ শতাব্দী সময়কালে আরব বণিকদের সান্নিধ্যসূত্র ধরে আরাকান রোহিঙ্গারা ইসলাম ধর্মের সংস্পর্শে আসে। এতে করে ইসলাম ধর্মালম্বীদের সংখ্যা বাড়বার পাশাপাশি প্রতিবেশী বাঙালি মুসলমানদের সাথে তাদের হৃদ্যতা ও সখ্যতাও বাড়ে। আরাকান রাজসভা আর আলাওল সাহিত্য পরিষদ ঘিরে সাহিত্যের পাতায় এর আংশিক ইতিহাস বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষিত মানুষ ছাত্রজীবনে কম-বেশি জানতে পেরেছে।

আঠারো শতকের শেষ দিকে, ১৭৮৪ সালে বার্মার রাজা বোদ্যোপায়া আরাকান রাজ্য দখল করে নিলে তা বার্মার অংশ হয়ে পড়ে। স্বাধিকার হারাবার এ সময়টায় হাজার হাজার আরাকান শরনার্থী পালিয়ে বাঙলায় আশ্রয় নেয়। সেই থেকেই মূলতঃ এই শরনার্থী সংকটের ইতিহাসের শুরু। যদিও সে সময় এটাকে বর্তমানের আঙ্গিকে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি।

ঊনবিংশ শতকে বার্মা ইংরেজ শাসনাধীন হলে আরাকানকে ঘিরে উত্তেজনা কিছুকাল প্রশমিত থাকে। রাখাইন বৌদ্ধ ও রোহিঙ্গা মুসলিমরা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করতে থাকে।

বিংশ শতাব্দীতে এসে, ১৯৪২ সালে, জাপান বৃটিশদের হটিয়ে বার্মার দখল নিলে বার্মিজরা মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর আক্রমণ চালাতে শুরু করে। রোহিঙ্গা মুসলমানদের জনজীবন থেকে শান্তি উবে যায়।

 

১৯৪৫ সালে বার্মিজ জাতিয়তাবাদী নেতা জেনারেল অং সান এর সহায়তায় ইংরেজরা জাপানীদের হটিয়ে বার্মা পুনর্দখল করলেও বার্মিজ সহায়তার স্বীকৃতি স্বরূপ আরাকানীদের স্বার্থ বিবেচনায় আনেনি। আরাকানবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষার স্বাধিকার বিবেচিত হয়নি। বিপরীতে আরাকান স্থায়ী ভাবে আজকের মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়।

১৯৪৮ সালের বার্মা স্বাধীনতা পাওয়ার পর থেকে তাই সাম্প্রতিক অতীত ঘিরে নব্য বার্মা সরকার ও রোহিঙ্গাদের মধ্যকার উত্তেজনা ক্রমান্বয়ে বাড়তেই থাকে। বৃটিশ শাসক কর্তৃক ভারত ভাগ করে একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় মুসলিম অধ্যুষিত আরাকান জনগোষ্ঠী খুব চাইছিলো তারা বার্মার অংশ না হয়ে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তানের অংশ হবে। ভৌগলিক বিবেচনায় বার্মার পশ্চিমে সমুদ্র তীরবর্তী আরাকানের চিলতে ভূখণ্ডটি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হওয়াটা খুব অসম্ভব কিছু ছিল না।

ফলাফল হলো এই যে, জাতিসত্তার প্রতি অনাস্থার অজুহাতে নয়া বার্মিজ সরকার রোহিঙ্গাদের প্রতি কট্টর প্রতিহিংসাপরায়ন নীতি গ্রহণ করে। সকল প্রকার রাষ্ট্রীয় নিয়োগ থেকে তাদের বঞ্চিত করতে শুরু করবার পাশাপাশি সরকারী চাকুরী থেকে তাদের বহিষ্কার করতেও শুরু করে মায়ানমার সরকার।

অষ্টম শতক থেকে রোহিঙ্গা মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠে বসবাস করে আরাকান জনগোষ্ঠীর পরিচয় বহন করলেও ইংরেজ ঔপনিবেশিকতা থেকে স্বাধীন হবার পর থেকে অনাহুত অভিবাসী পরিচয়ে রোহিঙ্গারা বার্মার কেউ নয়, এমন প্রচারণা জোরদার হতে শুরু করে। ১৯৬২ সালে ক্ষমতার পট পরিবর্তন হয়ে জেনারেল নে উইন ক্ষমতা দখল করে নিলেও রোহিঙ্গাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটে না। নে উইন সরকার আরো কঠোর নীতি গ্রহণ করেন রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে।

রোহিঙ্গাদের প্রতি বৈরী আচরণ ও নীতির ষোল কলা পূর্ণ হয় ১৯৭৭ সালে বার্মার জান্তা সরকারের 'নাগামিন' বা 'ড্রাগন কিং' অপারেশন ঘোষণার মধ্য দিয়ে। অভিবাসী খেদাবার নামে রোহিঙ্গাদের নির্মূল করাই ছিলো এই অপারেশনের লক্ষ্য। সামরিক শক্তি প্রয়োগে নির্মম এ সাঁড়াশি অভিযানের ফলশ্রুতিতে অবর্ণনীয় অত্যাচার থেকে বাঁচতে দুই লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে শরনার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়। বার্মার সেনাবাহিনী অবশ্য বরাবরই এ অপারেশনের সত্যতা অস্বীকার করে গেছে।

১৯৭৮ সালে জাতিসংঘের সহায়তায় শরনার্থী বিষয়ক সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে এর সূত্র ধরে প্রায় অধিকাংশ শরনার্থী আরাকানে ফিরে যায়। তবে তাদের উপর বার্মা সরকারের দমন নিপীড়ন আসলে থামেনি।

 

১৯৮২ সালে বার্মা সরকার নতুন এক অভিবাসন আইন পাশ করে, যেখানে বৃটিশ শাসনামলে অভিবাসন প্রকৃয়ার মাধ্যমে আগত জনগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করে আরাকানের সংখ্যাগুরু মুসলিমদেরকে বেআইনী অভিবাসী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এই আইনটির মাধ্যমে ঢালাওভাবে সমস্ত আরাকানবাসী রোহিঙ্গাদেরকেই মূলতঃ মায়ানমারে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়।

এক সময়ের বার্মা সরকারের পার্লামেন্ট সচিবের বংশধররাই সহসা হয়ে পড়ে মায়ানমারে অবাঞ্ছিত আগন্তুক। নাগরিকত্ব হারিয়ে তাদের পালাতে হয় দেশ ছেড়ে। রাখাইন প্রদেশ জুড়ে রোহিঙ্গাদের ওপর চলতে থাকে

গণহত্যার সংজ্ঞাধীন নিগ্রহ ও অত্যাচারের ভয়াবহতা। নিয়মিত ঘটতে থাকে পালিয়ে দেশ ছাড়ার ঘটনা।

একদিকে যেমন মায়ানমার থেকে মানষের ঢল বাংলাদেশের দিকে আসতেই থাকে, অন্যদিকে এক শরনার্থী প্রত্যাবাসন চুক্তির সূত্র ধরে দু লক্ষ ত্রিশ হাজার রোহিঙ্গা আরাকান বা আজকের রাখাইনে ফিরে যায়। শরনার্থী গ্রহণে বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয়ভাবে কঠোর নীতি গ্রহণ করলেও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যহত থাকে। সুলভ শ্রমমূল্যে নিয়োজিত হয়ে ক্রমে রোহিঙ্গারা সীমান্তবর্তী ও উপকূলীয় এলাকায় চোরাচালান এবং ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত হতে থাকে। আন্তর্জাতিক ভাবে শরনার্থীর অঙ্কে কিছু যোগ না হলেও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের কর্মসংস্থানকারীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতার সুবাদে জাতীয়তার সনদ এবং পাসপোর্টও সংগ্রহ করতে সক্ষম হতে থাকে। ভোটের অঙ্ক সম্ভবত এ বিষয়টিকে সহজ ও ত্বরান্বিত করতে থাকে।

বাংলাদেশ মায়ানমার সীমান্ত এলাকায় কাজ করা সব আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মীরাই রোহিঙ্গা শরনার্থী প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের কঠোর অবস্থানের বিপরীতে এসব সত্য জানে। সাম্প্রতিক সময়ে নতুন করে শরনার্থী সঙ্কট তৈরি হবার আগে পর্যন্ত শরনার্থী শিবিরে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের সংখ্যা মাত্র ত্রিশ হাজার হলেও আন্তর্জাতিক ভাবে বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের হিসাবে বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ লক্ষ রোহিঙ্গার অবস্থান রয়েছে বলে গণনা করা হয়। তবুও জাতিসংঘের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক ভাবে রোহিঙ্গা শরনার্থীদের আশ্রয় প্রদানের জন্য জোর চাপ সৃষ্টি করা হয় বার বার। কিন্তু বহুজাতিগত সামাজিক সংঘাতের নাম দিয়ে নিরস্ত্র প্রতিরোধকারী রোহিঙ্গাদের সাথে রাখাইন বৌদ্ধদের গোত্র বা ধর্ম ভিত্তিক বৈষম্যের দোহাই দিয়ে মায়ানমার সেনাবাহিনীর সশস্ত্র সহিংসতার মাধ্যমে রোহিঙ্গা উৎখাতে বেপরোয়া মায়ানমার সরকারকে জোর গলায় তেমন কিছুই বলা হয়নি। চার দশক ধরে চলমান জাতিবিধ্বংসী চরম মানবাধিকার বিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য তাদের অভিযুক্ত হতে হয়নি।

অথচ মায়ানমারে মানবাধিকারের ব্যপক লঙ্ঘন ও গণহত্যার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নির্মূল করবার প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণা ও প্রচারণা চালানো প্রাজ্ঞ জন বার্মিজ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ড. মঙ জারনির কথায় মায়ানমার সরকার  গোয়েবলের তত্ত্ব অনুসরণ করে বারংবার একই মিথ্যা উচ্চারণের মাধ্যমে একে সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠা করবার নীল নকশায় সচেষ্ট। তাঁর কথায়, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠারও প্রায় চার দশক আগে থেকে চলমান সহিংস গণহত্যা প্রকৃয়াকে জাতিগত বিদ্বেষের জের ধরে সৃষ্ট সহিংসতা হিসেবে চালিয়ে দেবার কোনো সুযোগ নেই। ড. মঙ খুব স্পষ্ট করেই পুরো পাশ্চাত্যের নানান সভা সমাবেশে ও বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিক আলোচনা অনুষ্ঠানগুলোতে এ কথা বলেছেন বারংবার যে, গণহত্যার সংজ্ঞা অনুযায়ী এর প্রধান পাঁচটি শর্তের চারটিই রোহিঙ্গা নির্মূলের ক্ষেত্রে মায়ানমার সরকার সুস্পষ্ট ভাবে সংঘটিত করেছে এবং দীর্ঘ সময় ধরে করে চলেছে। আর সেগুলো হলো এই যে, কোনো জাতিগোষ্ঠীর সদস্যদের উদ্দেশ্যমূলক ভাবে হত্যা বা নিধন করা, কোনো জাতিগোষ্ঠীকে শারিরীক বা মানসিক ভাবে আঘাত করা বা ক্ষতিগ্রস্ত করা, যৌন নির্যাতন করা এবং বলপূর্বক শ্রম আদায় করা।

রোহিঙ্গাদেরকে কেবল মাত্র নজরদারির আওতায় নয়, সীমানা নির্ধারিত বিভিন্ন নিরাপত্তা গারদের ঝাঁঝরিতে আবদ্ধ থাকতে হয়। এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় যেতে হলে মায়ানমার সেনাবাহিনী বা নাসাকাদের কাছ থেকে অনুমতি বা পাশ সংগ্রহ করে যেতে হয়। রোহিঙ্গা পরিচয় দিলেই শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হতে হয়।

ড. মঙ  গণহত্যার আরো একটা সূত্র স্পষ্ট করে উল্লেখ করে বলেন যে, সরাসরি মানুষ খুন না করেও গণহত্যা সংঘটন করা সম্ভব। তা সম্ভব পরোক্ষ ভাবে কোনো জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব বিপন্ন করবার মাধ্যমে। যেমন রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় গড়ে আশি হাজার মানুষের জন্য একজন ডাক্তার, যেখানে মায়ানমারের বাকি অংশে প্রতি সাতশ জনের জন্য একজন ডাক্তার। পাঁচ বছরের নীচে শিশু মৃত্যুর হার বাকি মায়ানমারের চাইতে রোহিঙ্গাদের মধ্যে তিন গুণ বেশি। এসব স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সমস্যা রোহিঙ্গাদের জাতিগত ভাবে নির্মূল করবার একটা নীল নকশার ভিতর দিয়েই প্রণীত। জাতিগত বিদ্বেষের যে দোহাই দেয়া হয় নিরস্ত্র প্রতিরোধকারী রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে, তা তারা প্রয়োগ করে না কিচিন প্রদেশ বা শান প্রদেশের সহিংস সশস্ত্র প্রতিরোধের মুখে দীর্ঘ সময় পার হলেও সেক্ষেত্রে জাতিগত বিদ্বেষের প্রসঙ্গ উচ্চারিত হতে শোনা যায় না।  

গত নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠিত আদমশুমারিতে রোহিঙ্গাদের মায়ানমারের নাগরিক হিসেবে যথাযথ ভাবে গণনা করা হয়নি। ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ দেয়া হয়নি। সার্বিক ভাবে রোহিঙ্গাদের প্রতি মায়ানমার সরকারের আচরণে মানবাধিকারের পনেরো নম্বর ধারা সুস্পষ্ট ভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। গণহত্যার চার চারটি শর্ত স্পষ্টত প্রমাণিত হয়েছে।

নির্বাচন পরবর্তী সময়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ন্ত্রিত হবার একটা আশাবাদ কেবল মায়ানমারের নিপীড়িত জনগোষ্ঠীই নয়,বিশ্বব্যপী জনমানুষের প্রত্যাশা ছিলো। সেই প্রত্যাশার ছায়া লকলকিয়ে বেড়ে উঠেছিলো শান্তিতে নোবেল বিজয়ী আঙ সান সু কী কে ঘিরে। কিন্তু রোহিঙ্গা বিদ্বেষের বীজ বপন করা জেনারেল আঙ সান কন্যা মানবাধিকার জলাঞ্জলি দিয়েও রোহিঙ্গাদের পক্ষে আসেন নি স্বল্পতম সময়ের জন্যেও। বরং এ প্রসঙ্গে রোহিঙ্গা বিরোধী অবস্থানটুকুই স্পষ্ট হয়েছে তার কথায় এবং সাংবাদিক বিমুখতা নির্ভর মুখে কুলুপ আঁটা আচরণের মধ্য দিয়ে। 

বিপরীতে নির্বাচন পরবর্তী সময়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা আরো স্পষ্ট ভাবে সরাসরি রোহিঙ্গা বিরোধী সহিংসতায় মাঠে নেমে এসেছে। ক্যামেরার সামনে বক্তব্য দিচ্ছে। এসব কর্মকাণ্ডের সবই মায়ানমার সরকারের বারংবার একই মিথ্যে বলে তাকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবার প্রচেষ্টার ফসল। 

 

৩১ আগস্ট ২০১৭ পর্যন্ত মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী ১৭ জায়গায় জ্বালাও পোড়াও এবং মানুষ নির্মূল সহ বিপদজনক মাত্রার ধ্বংসযজ্ঞের সংবাদ পাওয়া গেছে। যা পরবর্তী প্রতি দিন আরো ভয়ঙ্কর মাত্রায় বাড়বার নজির মিলছে। পরবর্তী তিন চার দিনে আরো অর্ধলক্ষ রোহিঙ্গা শরনার্থী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে, সীমান্ত এলাকায় এবং নো ম্যানস ল্যাণ্ডে আশ্রয় নিয়েছে। রোহিঙ্গা মুসলিমদের পাশাপাশি হিন্দুরাও এবার হত্যা ধর্ষণ ও জ্বালাও পোড়াওয়ের মুখোমুখি হয়ে শরনার্থীর ভীড়ে যুক্ত হয়েছে।

অনেক দেরীতে হলেও ধারাবাহিক গণহত্যা ও নিপীড়নের দীর্ঘ চার দশকের মাথায় এসে এবার প্রথম বিশ্ববাসী সত্যিকার অর্থে কথা বলতে শুরু করেছে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহ মাত্রায় নির্যাতনের শিকার এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর পক্ষে। আঙ সান সু কী এহেন মানবাধিকারের বিপর্যয়ের মুখে গত বেশ কিছু দিন ধরে আন্তর্জাতিক পক্ষ সমূহের নাক গলানোতে তাদের অন্তর্গত সমস্যা নিরসনে সমস্যা সৃষ্টির দোহাই উচ্চারণ করছে। শান্তির ধর্ম বৌদ্ধ পুরোহিতরা প্রাণীহত্যা মহাপাপ বাণীর বিপরীতে সহিংস ইন্ধন বাণী উচ্চারণ করছে। বুঝিবা নোবেল শান্তি পুরষ্কার জয়ী সু কী’র কথায় সায় দিয়ে সহিংসতার দোহাই দিয়ে দুর্গত স্থানসমূহে জাতিসংঘের খাদ্য ও ত্রাণ ব্যবস্থা গুটিয়ে নিয়েছে।

মালয়েশিয়া, ইরাণ, তুরস্ক এগিয়ে এসেছে মায়ানমারের বিরুদ্ধে সতর্ক বাণী উচ্চারণ করার মধ্য দিয়ে। ভারতও চাইছে মায়ানমার যতি টানুক। কিন্তু চীন বলছে অন্য কথা। বাংলাদেশ মায়ানমার সীমান্তে উত্তেজনা। তার পরও কথা এই যে সত্যিকারের সমস্যা সমাধানের মানসিকতা কারো মধ্যেই সুস্পষ্ট নয়। সব সদিচ্ছার আড়ালেও যেনো এক সাম্রাজ্যবাদী অঙ্কের খেলা ওৎ পেতে আছে। 

মায়ানমার দেশটা বাংলাদেশের চেয়ে আয়তনে প্রায় পাঁচ গুণ বড়। দেশটার পশ্চিমাংশে দীর্ঘ সমুদ্রসীমাটিও বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার চেয়ে পাঁচ গুণ বড়। দেশটির জনসংখ্যা বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক। আর সমুদ্র ছাড়া সীমানা ভাগাভাগি করেছে বিশাল দৈর্ঘ জুড়ে চীনের সাথে, থাইল্যাণ্ডের সাথে, আর ভারত ও বাংলাদেশের সাথে। প্রাচীন আরাকান রাজ্য রাখাইন প্রদেশ হিসেবে তৎকালীন বার্মা আর অধুনা মায়ানমারের অংশ হলেও এখানকার জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বাকী দেশটার সুসম্পর্ক কোনোকালেই বিদ্যমান ছিলনা বলে এটা এক দিকে যেমন মায়ানমারের জন্য সামরিক ঝুঁকি, অন্য দিকে এর নিরবিচ্ছিন্ন দখলদারিত্ব ভারত মহাসাগরে নৌ আধিপত্যের একটা সহজ সূত্র। সেই অঙ্কই সম্ভবত নোবেল প্রদান থেকে আর বাকি সব ছুতায় পরাশক্তিদের নাক গলাবার পথ তৈরির ছুতো। আর মুখ্য উদ্দেশ্য অমন কোনো এক লক্ষ্যে নিহিত বলেই মায়ানমারের গণহত্যা, জ্বালাও পোড়াও, শিশু ও নারী নির্যাতন, বল প্রয়োগে শ্রম আদায়, এবং গণহত্যার মতো বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানোর চাইতে মেনে নেয়াতেই বিশ্ব মোড়লরা বেশি স্বচ্ছন্দ্য।

শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ দিনের রোহিঙ্গা শরনার্থী সমস্যার পিঠে তাই আজ বাংলাদেশ মায়ানমার সীমান্তে উত্তেজনা যোগ হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে ২৭১ কিলোমিটার দীর্ঘ বাংলাদেশ মায়ানমার সীমান্ত। যার ৬৩ কিলোমিটার জলসীমানা এবং বাকী ২০৮ কিলোমিটারই রাখাইন প্রদেশের দুর্গম পাহাড়ী এলাকা। যোগ হচ্ছে চীন বা আমেরিকার ভিন্ন ভিন্ন বিবেচনায় মাথা ঘামানো। যুক্ত হয়েছে উত্তর কোরিয়া, পারমানবিক বোমার মতন প্রসঙ্গও। আপাতত যদিও ১৯৬৬ সালের নদী চুক্তি লঙ্ঘন করে বাঁধ নির্মাণকে কেন্দ্র করে টেকনাফ বিলীন হয়ে যাবার সম্ভাবনা ঘিরে নিকট অতীতে সমর শক্তির সর্বশেষ মোকাবেলায় বাংলাদেশের সহজ বিজয় এবং নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ভিতর দিয়ে বাঁধ নির্মাণ উদ্যোগ স্থগিত করে দুই ব্যাটালিয়ন মায়ানমার সেনা হঠে যাবার ইতিহাস আমাদের খুব বেশি অস্বঃস্তিতে রাখবার কথা নয়। তবু আমেরিকার বশংবদ তুরস্ক বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দেবার প্রস্তাব আর বিপরীতে মায়ানমারকে ইরাণের হুমকি, সব মিলিয়ে একটা বৈশ্বিক হিসাব নিকাশ এতো বছর পরে যেনো স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সামর্থ দিয়ে বাংলাদেশের উচিৎ তাই যতো দ্রুত সম্ভব বিশ্ব জনমত তৈরী করে সুদীর্ঘকালের এ সমস্যাটির স্থায়ী সমাধানের পথে এগোতে সচেষ্ট হওয়া। স্রেফ রোহিঙ্গা শরনার্থী সমস্যার আবর্তে ঘুর্ণায়মান থাকলে তা সচেতন সিদ্ধান্ত নয় বলে প্রমাণিত হবার শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।