এই কাহিনী পুরানো হইয়াছে বটে তবে অতি পুরাতন নয়। গল্পের সূচনা এইখান হইতে। বুকের পিনপিন ব্যাথা লইয়া এই বৃদ্ধ বহুকাল ধরিয়া টিকিয়া আছে। বুকের বাঁদিকটা ব্যাথায় টনটন করিতেছে। না, না, ইহা কোনও শারীরিক ব্যাথা নয়; মানসিক যন্ত্রণা বলা যাইতে পারে । কাছের মানুষ দূরে চলিয়া গেলে যাহা হয় । ইতিমধ্যে চারদিক চারিপাশে কত কিছুইনা ঘটিয়া গিয়াছে। আজ অব্ধি বেশ কিছুদিন হইল কুদ্দুইচ্চার দেখা নাই। সেই যে উহা বাংলাদেশে পদার্পণ করিয়াছে, ফিরিবার নাম গন্ধ নাই। শীত আসিয়া পরতে পরতে তুষারপাতের নির্যাতনের পর মধুর বসন্তের আগমন। এই বারের হাড় কাঁপানো শীতে বুড়া হাড় খটখটা হইয়া গিয়াছিল। শীত অতিক্রান্ত হইয়া বসন্ত আগমনে বুড়ো মনে যৌবনের হাওয়া নিত্য বহিয়া যাইতে না যাইতে এদেশের আনন্দময় গ্রীষ্মকাল। দু-একজন নেংটি ইঁদুরের মত পালাইয়া বেড়াইলেও বেশকিছুকাল হইল মুজিব হত্যা মামলার জঘন্য খুনিদের ইতিমধ্যেই সব কয়টিকেই ফাঁসীতে লটকানো হইয়াছে। এখন কুদ্দুইচ্চা বস্তুটি থাকিলে চায়ের টেবিলে ক্ষণে ক্ষণে কথার ঝড় তোলা যাইত। নোয়াখাইল্লা এই সুযোগে আমার অন্ন ধ্বংস করিত বটে, তবে ইহাতে আমি এক ধরণের তৃপ্তি বোধ করিতাম কেননা বিনিময়ে কিছুটা হইলেও জ্ঞান অর্জন হইত এই কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। সে না থাকিলে কি । ঐ আজব প্রাণীটির কাণ্ডকারখানা ভুলিতে পারি না। কী করিয়া ভুলি। খুব বেশীদিন আগের কথা নয়। এই গত রমজানের একটি দিন। ড্যানফোরথ ভিলেজ ধরিয়া হাঁটিতেছি। জিরো পয়েন্ট, বাংলা পাড়ার কিছু আগে টিডি ব্যাংকটা পার হইতেই কুদ্দুইচ্চার সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটিল। একেবারে হৈ হৈ করিয়া আমাকে উহার বুকের মধ্যে চাপিয়া ধরিল, যেন আমি তাহাঁর জানেমান। বলিল, ‘আরে বাই আম্নে এতদিন কনাই আছিলেন?’ উত্তরে বলিলাম, ‘ অ্যাঁইতো জায়গা মতই আছিলাম ভাই অন ত্নুই আমাকে কোন হাঁটে ঘাঁটে খুঁজি বেড়াইতেছ হিয়ান তোমার আল্লাহ বলিতে পারিবে। ‘যাক ব্যাক কিসুই ঠিক আছে। কিন্তুক আম্নের বাষা থিক নাই। জগা খিছুরি হাকাই হালাইছেন। অ্যাঁই বুইজ্জি আম্নের নোয়াখাইল্লা কওনের ফ্রয়জন নাই। আম্নে শুদ্দ বাশায় কতা কন হিয়ানি বালা। ক্যাছ কইত্তে হাইচ্ছেন্নি কোনও ? আমি বলিলাম, ঠিক আছে চলো সুইস বেকারিতে চা এর সাথে ছোলা- মুড়ি খাইতে খাইতে একটু গল্প করা যাক। সে বলিল, ‘ ওঁ বুইজ্জি ছাঁ কদ্দুরা খাওইবেন আরি, আম্নে
কইলে তোঁ অ্যাঁই আর মানা কইত্তাম হারিনা। ক্যাছ কইত্তে হাইচ্ছেন্নি কোনও ? যাইহোক এই অদ্ভুত ভূত প্রাণীটির সহিত আলাপচারিতা জমিয়া উঠিল। আড্ডার মধ্যিখানে কুদ্দুইচ্চার চখেমুখে তাড়াহুড়া পরিলক্ষিত হইল। ভাবিলাম রমজান মাস, কিজানি আবার তারাবির নামাজ পড়া শুরু করিল কিনা। ধর্মকর্মে বাধা দেওয়া আমার জন্য অধর্ম জ্ঞান করিলাম। অতএব উহাকে গুডবাই বলিয়া আমি রাজা গোবিন্দ মানিক্যের মত রাজকীয় হালে উল্টা পথে গন্তব্যহীন চলিতে লাগিলাম। ইফতার এবং চা-নাস্তা অনেক বেশী ঠাসিয়া ফেলিয়াছি অতএব একটু হাঁটাহাঁটি না করিলে রুহু মোবারক ফাঁসিয়া যাইবার যথেষ্ট সম্ভাবনা বিরাজ করিতেছে। যাহা হউক, অনেকদূর পাড়ি দিয়া ফিরিবার পথে চমকিয়া উঠিলাম কারণ যাহাকে দেখিবার নয় উহা সুইস বেকারির সামনে পাগল প্রায় পায়চারি করিতেছে। ‘ আরে কুদ্দুইচ্চা তুমিনা পত্রপাঠ বিদায় লইয়া চলিয়া গিয়াছিলে ? এখন বাজে রাত দশটা, তা তুমি কী মনে করিয়া এইভাবে হাঁটাহাঁটি করিয়া কালক্ষয় করিতেছ ? ‘ এই কথা শুনিয়া সে কাঁদ কাঁদ ভাবে বলিয়া উঠিল, ‘ বুইজ্জেন্নি বাই অ্যাঁর মুরগা আজি গেছে।’ আমি বলিলালাম, মুরগি হারাইয়া গিয়াছে ? বলকি, তা বাপু তোমার হাতেতো আমি মোরগ জাতীয় প্রাণী দেখিয়াছি বলিয়া মনে পড়ে না। কুদ্দুইচ্চা আমার কথা শুনিয়া ঝাঁ ঝাঁ করিয়া উঠিল, ‘ আম্নে বুজেননো অ্যাঁই সস্তায় হাই একলগে তিনগা হার্ড ছিকেন কিনছিলাম। জীবন্ত ন, মরা মুরগী, হেতারা ছিলি কাডি দিছে। ক্যাছ কইত্তে হাইচ্ছেন্নি কোনও ? অন আম্নের এক ডলারের চ্যাঁ খাইতো যাই অ্যাঁর দশ ডলার লোস, বুইজ্জেনি। সুইস বেকারির ছেয়ারের নিছে রাইকছিলাম। হেতেনরা দোয়ান বন্দো করি ছলি গেছে। ‘ আমি উহাকে উপদেশ দিয়াছিলাম মসজিদের সামনে যাইয়া পায়চারি করিবার জন্য। কেনোনা আমি জানি সুইসের মালিক তারাবি পড়ার জন্য বায়তুল আমান মসজিদে যান। কুদ্দুইচ্চা মসজিদ পানে রওনা হইল আর আমার গৃহে প্রত্যাবর্তন । পরদিন উহাকে ফোন করিয়া যাহা শুনিলাম তাহা আশাব্যাঞ্জক নহে। সে বলিল যে মসজিদের দু টি গেট। শেষ অবধি হাঁটাহাঁটি করিতে করিতে ক্লান্ত হইয়াও বিশেষ লাভ হয় নাই। চিড়িয়াকোন দরোজা দিয়া উড়িয়া গিয়াছে তাহা কুদ্দুইচ্চা টের পায় নাই। আমি তাকে সুইসে যাইয়া খোঁজ করিবার পরামর্শ দিলে সে যাইতে অস্বীকার করিল কেননা মুরগী পচিয়া দুর্গন্ধ বাহির হইলে ঐ প্রাণীটির পিথের ছাল থাকিবে না। এই কারণে সে ১০ ডলারের আশা ত্যাগ করিয়াছিল। যাহা হউক পরে আমার সহিত সাক্ষাৎ ঘটায় তিনি বলিলেন
আমরা আড্ডা দিয়া উঠিবার পর টেবিলের নীচে একটি শপিং ব্যাগের ভিতর মুরগী পাইয়া ফ্রিজে তুলিয়া রাখিয়াছেন। কুদ্দুইচ্চা এই কথা শুনার অনেকদিন পর মুরগী উদ্ধার করিয়াছিল। এইভাবে উহার সহিত বিচিত্র সব ঘটনার স্মৃতিচারন করিতে করিতে ভাবিতেছিলাম হঠাত করিয়া এই আজব জীবটি আবার কথায় ডুব দিল। কী আশ্চর্য, কাকতলিয়ভাবে কুদ্দুইচ্চার ফোন, ‘ আরে বাইজান, আম্নে কেরুম আছেন? অ্যাঁই তরন্ত আই গেছি। বইজ্জেনি। আইছি গতকাইল সইন্দদায়। আম্নেরে এক্কান আওয়াজ দিয়। টেলিফোনে ব্যাক কওন যাইতনো। হরে আম্নেরে বাঙ্গিচুরি কমু। হিয়ান অইল আমরাতো মুক্তযোদ্ধাগো লাই স্মৃতি সৌধ গইররছি। অখন এক্কান ঘৃণাসৌধ গইররলে কেমন অয় ? ক্যাস কইত্তে হাইচ্ছেনি কনও ? ‘ আমি বলিলাম একেবারেই ক্যাচ করিতে পারি নাই। হাত ফসঃকাইয়া কঠিন বস্তু মাটিতে পড়িয়া গিয়াছে। বাপু একটু বুঝাইয়া বল। ‘
‘ বুজেন নো ? এই দরেন খন্দকার মস্তাইক্কা দি শুরু কইত্তাম হারি। হে বেডা আছিল মুজিব হইত্তার নটের গুরু, বিদেশী চর । কেউ কেউ কয় সি,আই,এ ; অ্যাঁই হিয়ান বালা বুজি না। কী ছালাক দেইকছেননি হেতার বিছার অওনের আগেই ফটল তইলছে। মরণোত্তর বিছার অওনের দরকার। এখন আমার ফ্রস্তাব অইল জাতীয় স্রিতিশধর তুন এককানা দূরে হেতেনের বিরাত এককান মূর্তি বানাই ঘৃণাসৌধ গড়ন দরকার। এরফরদি আমরা এক এক করি বাকি যুদ্ধ অফরাদির লাই ঘৃণাসৌধ গড়নের কাজে মনোযোগ দিমু। প্রথ্যেক বছর ১৫ই আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে দলে দলে মানুষ যাই মউস্তাইক্কার মূর্তির দিকে ঠেঙের জুতা-স্যান্ডেল ছুঁড়ি মাইরব। কেউ ইচ্ছা কইরলে কাকুর গলায় জুতার মালাও হরাইত হারে। ক্যাস কইত্তে হাইছেন্নি কোনো? অন আম্নে কী বলেন? ইয়ান এককান অভিনব বিষয় অইতন ?
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়িয়া বলিলাম এরকমটিই হওয়ার দরকার ছিল। হইলে উপযুক্ত হইত। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশে সদুপদেশ কে শুনে ? পরে একদিন এই বিষয়ে তোমার সহিত বিস্তারিত আলাপ করিব; এই বলিয়া ফোন ছাড়িয়া দিলাম। এক অবচেতন ভাবনার মধ্যে নিমজ্জিত হইয়া ভাবিতে লাগিলাম চারদিক চারিপাশে কী সমস্ত অনর্থ এবং অবিচার ঘটিয়া চলিয়াছে ? হায়! এইসবের জন্যতো বাংলাদেশ স্বাধীন হয় নাই ?