মুক্তচিন্তা, চিন্তার মুক্তি, নাকি মুক্ত মন?

লেখক: ইকরাম কবীর Category: প্রবন্ধ (Essay) Edition: Dhaboman - Fall 2017

আমার বন্ধুদের ভাইবারে একটি গ্রুপ আছে। চব্বিশ ঘন্টা আড্ডা চলে সেখানে। রাতে ঘুমানোর সময় নোটিফিকেশন বন্ধ করে রাখতে হয়। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বন্ধুরা। দেশে আমরা যখন ঘুমুচ্ছি, আমেরিকা-কানাডার বন্ধুরা তখন আপিসে যাচ্ছে; অথবা কেবল ঘুম সেরে উঠেছে। বেশির ভাগই ঠাট্টা-মশকরা ও কৌতুক লিখে পাঠায় সবাই। অনেক গুরুগম্ভীর জ্ঞানের আলোচনাও চলে হরদম। অনেকে আবার সে নিজে কত জানে তা জাহির করতে চায়।

মাঝে-মাঝেই কেউ-কেউ ধর্ম নিয়ে কথা বলে বসে। আমার বন্ধুদের মধ্যে বেশ ক’জন নাস্তিক আছে। তারা ধর্মের প্রসঙ্গ এলেই ধর্মকে আক্রমন করে। নানা ভাবে তারা যেন বলতে চায়, ধর্মই যত অনর্থের মূল। আর যারা ধর্মে বিশ্বাস রেখে জীবনের পথ চলছে, তারা ক্ষেপে যায়, রাগ করে। দুই মতালম্বীদের মধ্যে ঝগড়া হয় । এক সময় কেউ একজন বলে ধর্ম নিয়ে এ’গ্রুপে আলোচনা না করতে। তারপর অনেক দিন আর ধর্ম নিয়ে কোন আলোচনা হয় না।

গল্পটি বলার একটি কারণ আছে। ধর্ম নিয়ে আমরা যতবারই কথা বলেছি, ততবারই কেউ না কেউ তর্কযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। তারপর মনে হয় আমরা যেন আলোচনা থেকে পালিয়ে বাঁচি। ধর্ম এবং ধর্মহীনতা নিয়ে কেউ অন্যের ধারনা বা বিশ্বাস মেনে নিতে চায় না। সবাই মনে করে সে ধর্ম এবং ধর্মহীনতা সম্পর্কে যা জানে, সেটাই শেষ কথা। তার জানার বাইরে আর কোন জ্ঞান বা কথা থাকতে পারে না। একটি মানুষ ধর্মব্রত কেন বেছে নিয়েছে তা না শুনেই তাকে আক্রমন করা হয়। মনে হয় ধর্মবিরোধীরা ধর্মবানকে নানা উদাহরন দিয়ে ধর্মচ্যুত করতে চায়। আবার, একটি মানুষ কেন ধর্মহীনতা বেছে নিল তা না জেনেই, ধর্মবান ধর্মহীনকে ধমকে দেয়, বকাবকি করে, তার ওপর রাগ করে।

কখনোই একজন আরেকজনের কথা মুক্ত মন নিয়ে শোনে না। দু’জনেই কিন্তু নিজ-নিজ চিন্তায় নিজের মুক্তি খোঁজে। কিন্তু নিজের চিন্তাকে আরেকজনের কাছে পেশ করতে পারে না। দু’জনেই অন্ধ। একজন ধর্ম বিষয়ে। আর একজন ধর্মহীনতায়। দু’জনেই নিজ-নিজ জ্ঞানে মুক্ত চিন্তা করছে। কিন্তু দু’জনের চিন্তাই বাধার সন্মুখীন হচ্ছে। একজন তার নিজের চিন্তা আরেকজনের কাছে মুক্ত করতে পারছে না। তার নিজের চিন্তার মুক্তির দেখা মিলছে না।

আমার আজকের প্রসঙ্গ এই মুক্তচিন্তা নিয়েই। সে’কারণেই আমার বন্ধুদের গল্প বললাম। প্রসঙ্গটি নিজেই চিন্তার বিষয়। এ’কি মুক্তচিন্তা না কি চিন্তার মুক্তি। মুক্ত চিন্তার অর্থ দাঁড়াতে পারে এমন – আমি যে বিষয়েই চিন্তা করছি, তা অবারিত ভাবে করছি, কেউ সেই’চিন্তায় বাধা দিচ্ছে না। আর চিন্তার মুক্তি হচ্ছে, আমি কোন চিন্তায় আটকে আছি, সমাধান খুঁজে পাচ্ছি না, কেউ আমায় সমাধান পেতে সাহায্য করলো অথবা আমি নিজেই সে সমাধান পেয়ে গেলাম।

তাই কি? আমার চিন্তাই কি শেষ কথা? আমিই কি শেষ বক্তা? আমিই কি শেষ তথ্য প্রদানকারী? আমিই কি শেষ তত্ত্ববাদী? আমার পর আর কেউ কোন কথা বলবে না? আমার ব্যাখ্যার পর আর কেউ বিশ্লেষণ দিতে পারবে না? আর কেউ অন্য কোন অর্থ দিতে পারবে না?

আমার নিজের চিন্তা আমার মনের ভেতর অবশ্যই মুক্ত; আকাশের মত মুক্ত; আমি যা ইচ্ছে চিন্তা করতে পারি; যেখানে খুশি যেতে পারি; যা খুশি বিশ্বাস করতে পারি; যা খুশি অবিশ্বাস করতে পারি; যাকে খুশি ভালবাসতে পারি; যাকে ইচ্ছে ছুঁতে পারি; যাকে মারধোর করতে চাই, করতে পারি; বিশ্বের যে প্রান্তেই যেতে চাই, যেতে পারি; যে কাউকেই খারাপ ভাবতে পারি, আবার ভালও মনে করতে পারি। কিন্তু এসব চিন্তার প্রকাশ কি করতে পারি? চিন্তা প্রকাশ না করা গেলে তাকে কি মুক্ত চিন্তা বলা যায়? আমার চিন্তা কি মুক্তি পায়?

হ্যা, প্রশ্ন আসতে পারে, মুক্ত চিন্তার প্রয়োজন কি? মানব সভ্যতা এগিয়ে নিতে যতটুকু চিন্তার প্রয়োজন তা তো প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে শেখানই হচ্ছে! স্কুলে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং আপিস-আদালতে। আর চিন্তার প্রয়োজন কি? সেটিও একটি চিন্তার বিষয়।

ধর্মের প্রসঙ্গে আবার ফিরে আসি। ধরুন আমরা বিশ্বাস করি যে বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন আমাদের সৃষ্টিকর্তা। আমরা প্রায় সবাই তা মানি। কিন্তু মানুষ হিসেবে আমার চিন্তা’তো সৃষ্টিকর্তাকে ছাড়িয়ে আরো অনেক দূর যেতে পারে। সেই চিন্তা কি আমরা করবো? আমরা ফেরেশতাদের কথা জানি, কিন্তু তাদের কখনও দেখি নি। যতটুকু ধর্মগ্রন্থে পড়েছি, ততটুকুই জানি। আমরা কি আমাদের কল্পনা কাজে লাগিয়ে তাদের নিয়ে ভাবতে পারি? তাদের ঘর-সংসার তৈরী করে দিতে পারি? আমরা তা করি না। সবসময় এসব বিষয়ে চিন্তার একটি ব্যকরণ মেনে চলি।

ব্যকরণটি আসলে কি? দেখতে পাই, ধর্মবিরোধী চিন্তা করলেই তাকে মুক্তচিন্তা বলা হয়। সেটি’ই কি ব্যকরণ? আবার, কেউ ধর্মের বাইরে চিন্তা করলে তাকে পাপী বলা হয়। সেটি’ই ব্যকরণ?

তেমন যুৎসই উত্তর নেই। ঠিক আছে, ধর্মের কথা আর নাই বলি। অন্য প্রসঙ্গে কিছু বলি।

আমার এক বন্ধু খুব ভাল লেখক। কিন্তু তাকে নিয়ে সবাই আড়ালে-আবডালে সমালোচনা করে, কথা বলে কারণ যেসব বিষয়ে সচরাচর কেউ কথা বলে না বা বলতে চায় না সে সব তার লেখার বিষয়বস্তু। সে যৌনতা ও যৌন শিক্ষা নিয়ে লেখে, পরকীয়া প্রেম নিয়ে লেখে। খুব বেশি সংখ্যক মানুষ আমি দেখি নি যারা তার লেখা পড়ে তাকে সবার সামনে প্রশংসা করেছে। অবশ্য তার লেখা পড়ে অনেকে উপকার পেয়েছেন, তবে তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন গোপনে। যৌনতা ও পরকীয়া আমাদের সমাজে চিন্তার জন্য বা কথা বলার জন্য স্বীকৃত বিষয় নয়। যৌনতার স্বল্প জ্ঞান নিয়ে যৌনকর্ম করতে গিয়ে অতৃপ্তিতে হতাশ হতে পারি, তারপরও তা নিয়ে চিন্তা বা আলোচনা করতে সাহস করবো না। তবে হাস্য-পরিহাস করতে পারি। আমরা যার সাথে মিলনে ইচ্ছুক বা মিলনে আবদ্ধ হই, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তার সাথেও আমাদের নিজেদের যৌনচিন্তা নিয়ে কথা বলি না।

তাহলে যৌনতা বিষয় হয়ে এলেই কি আমাদের চিন্তা বাধা পায়? আটকে 

যায়? দু’হাজার সতেরো সালের চিন্তা আর দু’হাজার পঞ্চাশ সালের চিন্তার ভেতর কি কোন পার্থক্য আছে? হয়তো, হয়তো না। আমার মনে হয় আমার এই বন্ধুর লেখাগুলো একসময়, আরো কুড়ি বছর পর বেশ সমাদৃত হবে। ভবিষ্যতের সমাজ তাকে ভাল লেখক হিসেবে, ভাল চিন্তাবিদ হিসেবে, ভাল শিক্ষক হিসেবে স্বীকৃ্তি দেবে। কেন? কারণ আমি মনে করি আমাদের প্রচলিত চিন্তাকে পেছনে ফেলে, তার বাইরে গিয়ে সে চিন্তা করেছে, যার মূল্যায়ন আমাদের ‘প্রচলিত’ মস্তিস্কে করতে পারছি না। আমাদের এক-বংশ পরেই তা হয় তো করা সম্ভব হবে। এটিই কি মুক্তচিন্তা? না কি চিন্তার মুক্তি?

উত্তর পাচ্ছি না। আপনারা পাচ্ছেন?

আরেকটি উদাহরন দেই। দিনা ফেরদৌস নামে একজন লেখক লিখলেন যে নারীদের জন্যেও যৌনপল্লী প্রয়োজন কারণ নারীরও কামের প্রয়োজন আছে। চিন্তাটি যথার্থ। এযাবৎ কালে নারীর যে কামচিন্তা থাকতে পারে তা আমাদের সমাজ স্বীকৃ্তি দেয় নি। শুধু ছেলেদেরই কামঘরে যেতে হবে নারীদের নয় – এ’চিন্তা একটি প্রচলিত চিন্তা যার প্রকাশ আছে। কিন্তু নারীরও যে কামের প্রয়োজন আছে তা আমাদের সমাজে প্রকাশিত চিন্তা নয়। তবে প্রতিটি চিন্তাশীল নারীই কোন না কোন সময় এ’চিন্তাটি করেছেন কিন্তু প্রকাশ করতে পারেন নি। কারণ তাদের সে স্বাধীনতা নেই। এই লেখক এই চিন্তাটি করে তা প্রকাশও করেছেন।

খুব খারাপ লেগেছে কি? লাগতে পারে। আমরা এরকমটি শুনতে অভ্যস্থ নই। আমার কাছে একটি স্বাভাবিক যুক্তি-যুক্ত চিন্তা মনে হয়েছে।

তাহলে কি এই লেখকের চিন্তাটি’কে আমরা মুক্ত চিন্তা বলতে পারি? যদি পারি, তাহলে কি তিনি বা দেশের সকল নারী তাদের এ’চিন্তা থেকে মুক্ত হতে পারছেন? পারুক বা না পারুক, সমাজ কি তাদের এই চিন্তাকে মুক্ত মনে মেনে নিতে পারছে?

প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

অনেকে হয়’তো বলবেন, স্বাধীনতা যেমন পুরোপুরি স্বাধীন নয়, তেমন চিন্তার প্রকাশও পুরোপুরি স্বাধীন নয়। মনে মনে অনেক চিন্তাই করা যায়, কিন্তু তা কতটুকু প্রকাশ করা যায় সে প্রশ্নের উত্তর বোধহয় পৃথিবীর কারো কাছে নেই; থাকলেও একেক জনের ব্যাখ্যা হবে একেক রকম।

আচ্ছা, তাহলে সব চিন্তা প্রকাশ নাই বা করলাম। তবে আড্ডা-আলোচনায় আমরা যখন বসি এবং নিজ-নিজ চিন্তার প্রকাশ করি, তখন তো অন্ততঃ একে অপরের চিন্তাগুলো মুক্ত মন নিয়ে শুনতে পারি। নাকি ‘আমার চিন্তাই সঠিক’ এমন ভাবনাই প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে যাব?