হালুয়াঘাট

Writer: Principal(rtd)A.K.Nurul Hoque Category: ভ্রমণ (Travel) Edition: Dhaboman - Winter 2017

হালুয়াঘাট

  নুরুল হক

 

 

কয়েক দিন আগে গিন্নীর জোরাজুরিতে হালুয়াঘাট গিয়েছিলাম। ভারতীয় সীমান্ত থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরবর্তি এই উপজিলাটা ময়মনসিংহ জেলার অংশ। আমাদের গন্তব্য সন্ধ্যাকুড়া গ্রাম। লীনা যখনই কোথাও যাওয়ার কথা বলে, আমি বলি টাকা নেই। অমনি ক্ষেপে গিয়ে বলে, তোমার কাছ থেকে সার জীবন কেবল টাকা নেই টাকা নেই শুনে আসছিকোন দিন তোমার টাকা ছিল? সেই বিয়ের পর থেকেই লালবাগের হাঁট থেকে বাজার করে নিয়ে আসতো। রংপুর থেকে বাজার করে নিয়ে আসতো। পয়সা বাঁচানোর জন্য। নতুন বিয়ে, কিছু বলতো না। এখন বাজার করে এসে খুব কথা শোনায়। আমার সংসারে এসে তার জীবন টা তামা - তামা হয়ে গেল। আসলেই তাই। বাজার করতে গেলে আমি চোখের সামনে যা পাই নিয়ে আসি, আবার আমাকে পচা-গচাও গছিয়ে দেয়। তার জন্য কথা শুনতে হয়। তোমার চোখ নেই? এই পচাগচা গছিয়ে দিয়েছে! এখন নিজেই বেছে বেছে বাজার করে নিয়ে আসে। আমি কখন সাথে গেলেও পাশে দাঁড়িয়ে ইন্টারনেটে ভ্রমন করি। নিজের পায়ের ব্যাথা, ডায়াবেটিস ইত্যাদি নিয়েও সংসার টা ঠেলে যাচ্ছে। আমি বলি, তুমি হলে এই সংসারের বটবৃক্ষ। তোমার ছায়ায় আমি নিশ্চিন্তে আছি। তুমি এদিকটা দেখবে, আর আমি বাইরে। এর জন্য আবার মুখ ঝামটা শুনতে হয়। থা, আর তেল দিতে হবে না

যাই হোক, হালুয়া ঘাটে আভ্রকে নিয়ে যাবেই। আভ্রর একটু ঘোরা ফেরা করা দরকার। ক্যাডেট কলেজ থেকে বাইরে আসার পর ও আর সেভাবে খেলা ধুলা করার সুযোগ পায় নি, তেমন ভালো বন্ধু-বান্ধবও পায়নি। লীনা নিজেই হালুয়াঘাটের এক রেষ্ট হাউসের সাথে যোগাযোগ করে বুক করলো, গাট্টি বোঁচকা বাঁধা ছাঁদা করলো। তার পর বাসে চড়ে হালুয়াঘাট। রেস্ট হাউসে উঠলেও এক রাতের বেশী থাকা হল না। এখানে মুজিবর আর ওর স্ত্রী জাহানারার বাস। মুজিবর আগে আমার সাথে আমার খামারে কাজ করত। নিজ হাতে ওকে নানা ধরণের কাজকর্ম শিখিয়েছিলাম।  জাহানারা হালুয়াঘাটে ব্র্যাকের ওয়েলফেয়ার কর্মী হিসাবে কাজ করত। দুটি ছোট বাচ্চা নিয়ে একাকী সামলাতে পারছিল না তাই মুজিবর খামারের কাজ ছেড়ে স্ত্রীর কাছে চলে আসে। আমরা আসবো ওকে জানিয়েছিলাম।  ও এক রদ্দি মার্কা গাড়ী যোগাড় করে রেখেছিল।  সেই গাড়ীতে চড়ে প্রথম দিন খুব ঘুরে বেড়ালাম। দিন শেষে মনে হল ডিব্বার মধ্যে ঝাল মুড়ি ঝাঁকালে যে অবস্থা হয়, আমাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সব স্থান চ্যুত হয়ে সেই রকম অবস্থা হয়েছে।

যাই হোক বাধ্য হয়ে মুজিবর এবং জাহানারার আতিথেয়তা নিতে হল। কিছুতেই ছাড়বে না। গ্রামে এখনও এই রেওয়াজটা আছে। মানুষ অসম্ভব অতিথিপরায়ণ। অনেক মানুষ এসেছে আমাদের সাথে দেখা করতে।  আপন জনের মতো কথা বলেছে। এক বয়ষ্ক মহিলা হঠাৎ নিজে থেকেই আমার স্ত্রীর মাথা থেকে পাঁকা চুল বাঁছতে লাগলো। আগের দিনে কিভাবে একজনের মাথা থেকে আরেক জনের মাথায় উকুন ছড়িয়ে পড়ত মনে পড়ে গেল। একটু শংকায় থাকলাম।

ওখানেই বশীর, তার বাবা আব্দুর রহমান, তার মা শরীফার সাথে দেখা। বশীর ঢাকার দক্ষিণ খানে অবস্থিত আমাদের স্কুলের ছাত্র ছিল। ওর বাবা মা ৭/৮ বছর ঢাকায় কাটিয়ে দেশে ফিরে আসে। আব্দুর রহমান ঋন করে একটি ইজি বাইক কিনেছে। আর শরীফা ঢাকা থেকে জামা কাপড় কিনে এনে বাড়ী বাড়ী বিক্রয় করতো। এখন ছোট ছেলের জন্য আর পারেনা। ওখানে এক গারো বাড়ীতে ব্র্যাক এর একটি স্কুল আছে। সেখানেই সে এখন শিক্ষকতা করে। শুনে অবাক হলাম যে সে এখান থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষাও দেয়।  একজন শিক্ষক দিয়েই ব্র্যাক এর স্কুল গুলি চলে। যাই হোক, ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। আমি স্বর্গে যাইনি কিন্তু চেষ্টা করেছি মানুষের কষ্টের দিক গুলির সাথে পরিচিত হতে। মুজিবর আর জাহানারা ধার করে হলেও নিজের একটা ঠাঁই করেছে। এক টুকরো জমি কিনে ছোট একটা বাড়ী বানিয়েছে। এর আগে অন্যের জায়গায় ঘর উঠিয়ে থাকতো।

ওদের সংসার দেখে আমাদের আগের গ্রামের সংসারের কথা মনে পড়ল। বাড়ীতে হাঁস মুরগী, পুকুরে মাছ, গাছে তাজা তরকারী, শাক সবজি। এটা এক সময় গ্রামের যে কোন পরিবারের বৈশিষ্ট ছিল।

এক দিন নলকুড়ায় অবস্থিত মধুটীলা ইকো পার্কে গিয়েছিলাম। খুব সুন্দর সবুজ বনানী, বেশ কয়েকটা ছোট ছোট টিলা আছে। তিনটা টিলায় চড়েছিলাম। সব গুলিতে চড়া সম্ভব ছিলনা। লীনা তিনটাতেই চড়েছে। তার অদম্য মনবল দেখে অবাক হয়েছি, খুশিও হয়েছি। ২০১২ তে একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিল। তারপর অনেক ঝড় ঝাপটা গিয়েছে ওর উপর দিয়ে। সে গুলি কাটিয়ে উঠে যে আবার নিজের আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে, এটা একটা বড় পাওয়া। আমার মত বাহির্মূখী লোক তাকে সব সময় সঙ্গ দিতে পারেনা, বলা যায় আমাদের সংসারটা একাই চালিয়ে নিচ্ছে। আর ছেলেমেয়েগুলোও হয়েছে খুব মা ভক্ত, এমনকি মাত্র ক’দিন আগে আসা পুত্র বধূও তার আঁচলে ঠাঁই নিয়েছে। আমি ভাবি, ভালই হলো।  সব ওর দলে। হবেই বা না কেন? সে ওদের সাথে কথা বলে, ওদের সুখ দুঃখের ভাগীদার হয়। আমার সময় কোথায়?

মধুটিলা ইকো পার্কে খাওয়া ডাবের পানির কথা উল্লেখ না করলেই নয়। মাত্র ৩০ টাকায় সেরা ডাবের পানি পান করেছি। একেবারে গাছ থেকে মাত্র পেড়ে আনা। কচি ডাব। কি মিষ্টি ! 

যাই হোক, লীনা বেড়াতে এসেও একদল ভক্ত বানিয়ে নিয়েছে। আসলে ওর আপন করে নেওয়ার একটা দারুণ ক্ষমতা আছে। আমি আবার সেটা সহজে পারি না। আমি যে কি আমি নিজেই বুঝি না।

যাই হোক, আসার আগের দিন সন্ধ্যায় মনে হলো এই শরীফদের গাইডেন্স দরকার। নয়তো হারিয়ে যাবে। সাবিনা নামের একটা কিশোরী নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগত। আমি তাকে ডাক্তার দেখিয়ে, বেশ কিছু টাকা পয়সা খরচ করে ভালো করে দেই।  আমাদের এক পৃষ্ঠপোষক ডেভিড তাকে একটা গাভী কিনে দিয়েছিল। সেই সাবিনা পরে এক ছেলের সাথে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে। তার বয়েস তখন মাত্র পনের। আমি এই ভয়টাই করেছিলাম।  আমি তার মাকে বলেছিলাম ওকে বাড়ার চরে আমাদের খামারে পাঠিয়ে দিতে, খামারে কাজ করত, স্কুলে পড়াশোনা করত, একটা ভবিষ্যৎ হত। ও দেখতে সুন্দর, আর গ্রামের দিকে অল্পবয়েসেই ছেলেমেয়েরা বিয়ে করে বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে বিরাট সংসার পাতিয়ে বসে। পড়াশোনা করে জীবনটাকে গড়ার সুযোগই হয় না।  

মুজিবরের বড় মেয়েটা সেভেনে উঠবে। জাহানারাকে চাকুরীর জন্য মাঝে মাঝে দূরে যেতে হয়।  মুজিবর আবার বাড়ার চরে খামারে কাজ করতে যেতে চায়। ওর বাচ্চাদের দেখবে কে? জাহানারা প্রাইভেট পড়াত। কিন্তু তাতে তেমন আয় হয়না। ওকে বুদ্ধি দিয়েছিলাম, ওর বাড়ীতে কয়েকটা বাচ্চা নিয়ে বিকেলে পড়াতে।  শরীফ ওর মেয়েদেরকে সেখানে দিতে পারবে। ঐ এলাকায় যেহেতু কোন স্কুল নেই, সেহেতু গরীব বাচ্চারা বিকেলে ওর কাছে এসে পড়তে পারবে।

ও বেশ কিছুদিন আগেই কাজে নেমে গিয়েছে। শুনলাম মোট ছাত্র ছাত্রী ৩৪ জন হয়ে গিয়েছে, আরোও হবে। মুজিবরকে বললাম ওর পুকুর পাড়ে বাঁশের একটি টং ঘর তৈরী করতে, যার উপরে ত্রিপলের ছাউনি হবে। ছেলেমেয়েরা মাটিতে পাটি পেতে বসে পড়বে।

আমার পরিচিত বেশ কিছু মানুষ দুঃস্থদের জন্য জামাকাপড় দান করার আগ্রহ দেখিয়েছে। কাপড় পুরানো হলেও দেখে বোঝা যায় না। সেগুলো হালুয়াঘাটে পাঠিয়ে দেব বলে মনস্থির করেছি। সমস্যা হচ্ছে কাপড় নিয়ে বাসে করে আসা যাবেনা, আবার সি এঞ্জি ভাড়াও তিন - সাড়ে তিনশ টাকা। যাই হোক, ব্যবস্থা একটা হবে।

এই সফর লীনার জন্যই সম্ভব হয়েছে। হালুয়া ঘাটের সন্ধ্যাকুরা গ্রামের বাচ্চাদের জন্য খুব শীঘ্রই আমাদের স্কুলটা খুলবে। মাসে সেখানে খরচ  ৬ হাজার টাকার মত হবে। ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা আরোও বেড়ে গেলে খরচটাও বাড়বে। প্রতি মাসে অর্থ জোগাড় করতে কষ্ট হবে জানি কিন্তু তাই বলে দমে যাবার মানুষ আমরা নই। আমরা শহরের মানুষ গুলি যদি আমাদের গ্রামের বাচ্চাদের এভাবে দিক নির্দেশনা দেই, তা হলে ওরা মাদকদ্রব্য, অপরাধ এবং দারিদ্র থেকে বের হয়ে আসতে পারবে। আমাদের  মধ্যে যাদের গ্রামে শিকড় রয়েছে, তাদের নিজ নিজ গ্রামের ছেলে মেয়েদের প্রতি একটা দায়বদ্ধতা আছে। 

গ্রাম নিয়েই তো বাংলাদেশ। গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে।

প্রাক্তন ক্যাডেট কলেজের শিক্ষক নুরুল ইসলাম বর্তমানে তার সংগঠন CCP Foundation এর মাধ্যমে দুঃস্থ বালক বালিকাদেরকে বিনামূল্যে শিক্ষা প্রদান এবং অন্যান্যভাবে সাহায্য সহযোগীতা করে থাকেন