Table of Content

Mohammed Shamsujjoha
NA
NA
1 articles

মোহাম্মদ সামসুজ্জোহার কবিতাগুচ্ছ

লেখক: মোহাম্মদ সামসুজ্জোহা Category: কবিতা (Poem) Edition: Dhaboman - Eid 2018

হাম্মদ সামসুজ্জোহা

 কবিতাগুচ্ছ

 

স্বপ্ন-লেখকঃ

স্বপ্ন দেখি কখন ?
যখন নিঃসঙ্গ একাকী আমি,
যখন রাস্তায় ট্র্যাফিক জ্যাম, হাতে অফুরন্ত সময়,
বা দূরে কোথাও যাবো, একাকী দীর্ঘ পথ,
গাড়ির মধ্যে তখন ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে স্বপ্ন বুনি;
অথবা যখন কোন জনার্কীণ আয়োজনে
চলছে অর্থহীন কথাবার্তা বা আমার সাথে যায় না এমন কিছু,
তখনও আমি তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে স্বপ্ন দেখি।
কিছুতেই ঘুম আসছে না বা মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল,
তমসাচ্ছন্ন রাতে তখনও চোখ মেলে স্বপ্ন রচি। 
তাই নিঃসঙ্গতা, ট্র্যাফিক জ্যাম,দীর্ঘ পথ,
জনার্কীণ আয়োজন, তমসাচ্ছন্ন রাত্রি
আমার এখন ভাল লাগে।
লিখি কোথায় ?
সবই মনে মনে স্মৃতিপটে এঁকে রাখি।
কিন্তু স্মৃতিপটটা শুধু অপ্রতুলই নয় বড্ড অরক্ষিতও,
কত স্বপ্ন যে হারিয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই!
স্বপ্নগুলো কেমন ?
ধরো বসন্তের প্রথম ঝুম বৃষ্টি,
আমি তোমাকে বললাম, চলো একটু ভিজি
তুমি বলবে, এই অসময়ে?
আমার কি মাথা নষ্ট হয়েছে ?
অথচ আমার স্বপ্নে, তুমি যেন যুগ যুগ ধরে 
সিক্ত হওয়ার অপেক্ষায়;
দূরে কোথাও যেতে হবে, বললাম, সঙ্গে যাবে ?
তুমি তখন ব্যস্ততার সাতকাহন শুনিয়ে 
আমাকেই উল্টো অবিবেচক বানাবে;
অথচ আমার স্বপ্নে তুমি এক কাপড়ে বেরিয়ে পড়,
যেন অপঠিত দুর্দান্ত এক উপন্যাসের নায়িকা।
কাকভোরে ঘুম ভেঙ্গে গেল,
তোমাকে বললাম, চলো বাইরে হেটে হেটে,
রাস্তায় দাড়িয়ে, কোন ইটালিয়ান হোটেলে চা খাবো;
ঘুম জড়ানো বিরক্তিভরা কন্ঠে তুমি বলবে, 
ঘুমটা ভাঙ্গালে তো? তুমি জানো ?
আমি কাল রাতে কখন ঘুমিয়েছি?
অথচ স্বপ্নে, বিস্ময় অপার! কী করে যেন 
তোমারও একই সময় ঘুম ভেঙ্গে যায়;
তখন তুমিই বলো, চলো ভোরের কচি বাতাসটা 
গায়ে জড়িয়ে একটু ঘুরে আসি-------------।
বা কোনো প্রশান্ত লেকের ধারে গিয়েছি,
তোমাকে বললাম, চলো একটু নৌকায় চড়ি;
তুমি তখন বলবে, না বাবা, 
সাঁতার জানি না, মরার একদম ইচ্ছে নেই।
অথচ আমার স্বপ্নে, 
খরস্রোতা নদীতে তিন তক্তার ডিঙি নৌকায়
তুমি অবলীলায় চেপে বসো,
আমি দুষ্টুমি করে যদি বলি, 
তুমি তো সাঁতার জানো না!
তখন তুমি কী নির্ভয়-নির্ভার কন্ঠে যে বলো, 
কেন, তুমি আছো না?

 

আমার বন্ধুরাঃ

 

আমার বন্ধুরা একেক জন একেক রকম
কেউ অতি মেধাবী, কেউ অতি সাধারণ, কেউ মৃদুভাষী 
কেউ বাচাল, কেউ বন্ধু বৎসল, কেউ আবার অসামাজিক
কেউ উন্নাসিক, কেউ নিরিহ-দয়ালু, কেউ ঈর্ষালু, কেউ একটু স্বার্থপর
কেউ নিখাদ আড্ডাবাজ, কারোর আবার একটু চোরা চোরা স্বভাব
কিন্তু তারা সবাই আমার ভীষণ পছন্দের
ওরা ছাড়া জীবনের স্বাদ পাওয়া হতো না আমার!

আমার বন্ধুদের অনেকেই চাকুরে, কেউ কেউকেটা, কেউ ছাপোষা, 
কেউ বুদ্ধিজীবি, কেউ ব্যবসায়ী, কেউ পেশাজীবি,
কেউ রাজনীতিক, কেউ আবার বিপ্লবী, 
কেউ শিল্পি-সাহিত্যিক,কেউ খেলুড়ে, কেউ সাংবাদিক
কারোর হয়তো কিছুতে একটু নেশা আছে, কেউ আবার জুয়াড়ী
কিন্তু সবাই আমার অতি প্রিয় ;
এরা ছাড়া জীবনটা থেকে যেত একদম অজানা!

আমার বন্ধুরা কেউ ধনী, কেউ নির্ধন, কেউ কৃপন, কেউ খরচে
কেউ খুব সুখি, কেউ একটু দুঃখি দুঃখি
কেউ ধার্মিক, কেউ আবার ধর্মে খুঁজে পায় না প্রাণ
কিন্তু সকলেই আমার অন্তঃপ্রাণ।
তারা ছাড়া জীবনের অর্থ একটুও হতো না বোঝা!

আমার বন্ধুরা কেউ সুদর্শন, কেউ চৌকস, কেউ তারছেঁড়া,
কেউ ধৈর্যশীল, কেউ আবার অস্থির
কেউ রূপবতী, কেউ গুণবতী, কারোর সঙ্গ মধুময়
কেউ অভিমানী,কেউ আবার জীবনটা অতিষ্ট করে তোলে নিরন্তর
কিন্তু ওদেরকে ছাড়া একদম চলে না আমার!

আমার কত বন্ধু যে হারিয়েছে তার ইয়ত্তা নাই
তাদের কথা মনে হলে বুকের মধ্যে মোচড় দেয়!
যদি পুনর্জন্ম হয়, আমার সাথে ওরা জন্মাবে আবার
নতুন বন্ধু নতুন ঝুঁকি,কী দরকার?
পুরোনো বন্ধুদের হাড়ে হাড়ে চেনা আমার 
যতই জ্বালিয়ে মাছভাঁজা করুক ওরা ছাড়া আমি অচল
ওরা বিনা আবার জন্মানো হবে একদম বিফল!

 

 

আমার যত শেখাঃ

 

ছেলেবেলায় আমার সব মাস-ই ছিল মধুময়
খরতাপে পুড়ে তবুও মানুষ জ্যৈষ্ঠ মাসকে-ই বলতো মধু মাস,
খেলে খেলে ঘামে গোসল দিয়ে 
বাড়ি ফিরলে মা বলতো-
ভাদ্রের এই তাল পাকা গরমে এত খেলতে হয় না’
সেটাই ছিল আমার প্রথম ঋতুজ্ঞান।
শরতের নীল আকাশে 
কাশফুলের মত সাদা মেঘগুলো 
ভেঙে-গড়ে কত অবয়বে যে মূর্ত হতো
সেটাই ছিল আমার কল্পনা করতে শেখার হাতে খড়ি।
বাড়ির উঠানে ধূসর জমিনে 
পিচঢালা কালো পথের ওপর
গাছপালার ফাঁক দিয়ে আসা 
রোদ আর ছায়ার মনোরম নকশাগুলো
গড়ে দিয়েছিল আমার লালিত্যবোধের প্রথম সোপান।
শুনশান শারদ-রাতে জানালার সামনের
বিশাল ঝাকড়া শিউলি ফুলের গাছটা
মদির গন্ধ ছড়িয়ে আমার মাতাল হওয়ার 
নেশাটা তখনই ধরিয়ে দিয়েছিল,
আর নৈঃশব্দ্যেরও যে ভাষা আছে
তাও জেনেছিলাম ফুল পতনের শব্দ শুনে শুনে; 
সকালে ঘুম ভেঙ্গেই চোখে পড়তো-
ঝরেপড়া ফুলেরা শিউলি তলায় বৃত্তাকার চাদর বিছিয়ে 
ভোরের স্নিগ্ধতা এঁকে রেখেছে ।
হাড় চিনচিনে মাঘের রাতে 
গাছের ভারাক্রান্ত সিক্ত পাতা গড়িয়ে
ফোটায় ফোটায় শিশির পড়ার শব্দ 
আমাকে তালিম দিত প্রকৃতির ছন্দটা ধরতে ।
শ্রাবণের কোনো ঝুম বৃষ্টিতে সবাই থেকেও
কেউ না-থাকার এক শূণ্যতা বোধ দানা বাঁধে,
স্বেচ্ছায় কারোর আলিঙ্গনের অধীন হওয়ার 
মানবীয় বিপর্যয়ের বেপরোয়া ইচ্ছাটা বোধ হয়
তখনই সংক্রামিত হয়!

 

 

 

 

আমি চাই:


আমি চাই আমার সন্তানেরা শিশিরসিক্ত দুর্বাঘাস, 
কচুপাতায় টলমলে পানি, জঙলা তরু-ফুলে বসা ফড়িং, 
কাকতাড়ুয়ার মাথায় নিকষ কালো ফিঙ্গেরাজা দেখে বিস্মিত হোক
অবাক হয়ে যাক প্রজাপতি আর রংধনু দেখে 
নদীতে নুইয়ে পড়া বাঁশগাছের ডগা থেকে 
এক ডুবে মাছরাঙার মাছ শিকার দেখে বিহ্বল হোক।

আমি চাই আমার সন্তানেরা অমাবশ্যায় জোনাকির আলো 
আর ভরা পূর্ণিমায় প্রকৃতির মায়াবী রূপে বিমোহিত হোক
তন্ময় হয়ে দেখুক শূণ্যে পায়রাদের ডিগবাজি 
জলাভূমিতে বক-পানকৌড়ি-কলহংসের কলকাকলিতে বিমুগ্ধ হোক
পাখিদের বাসা বানানো দেখতে দেখতে 
নাওয়া-খাওয়া ভুলে যাক।

আমি চাই আমার সন্তানেরা বড়শি ফেলে মাছ ধরুক
সাঁতার কেটে পুকুর এপার-ওপার করুক
বৃষ্টিতে ভিজুক আর কাদা-পানির মধ্যে খেলে খেলে
প্রচন্ড ক্ষুর্ধাত হয়ে খাবারে স্বাদ বুঝুক।

আমি চাই আমার সন্তানেরা পাঠ্যক্রমের বাইরে অনেক বই পড়ুক
বিজ্ঞান-সংগীত-শিল্প-সাহিত্যে-খেলা-ধুলায় প্রগাঢ় আগ্রহ জন্মাক
স্বপ্ন দেখুক আর তার পিছনে ছুটুক
তাদের পৃথিবীটা অনেক অনেক বড় হোক।

আমি চাই আমার সন্তানেরা একটা স্বতোজাত জীবন নিয়ে মগ্ন থাকুক
ক্ষুদ্র বিষয়েও নৈব্যক্তিক মূল্যায়ন করা শিখুক
অবিমিশ্রিত সত্যের স্বাদ-সৌন্দর্য উপভোগ করুক
সৌন্দর্যের সত্য-রহস্যটা খুঁজে পাক।

আমি চাই আমার সন্তানদের মধ্যে নতুন সংবেদনশীলতা সৃষ্টি হোক
উন্নততর মূল্যবোধে অটল থেকে বাঁচুক 
দেশপ্রেম নিয়ে বাগড়ম্বতা না করে 
তারা নিজের ন্যায্য কাজটা ঠিকমত করুক।

আমি চাই বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা আমার সন্তানদের পাথেয় হোক
মানবতাকে সবার উপরে স্থান দিক
তাদের ধর্মেও ওগুলোই সর্বোচ্চ স্থান পাক
উদারনৈতিকতা ও সম্মান তাদের ভালবাসার ভিত্তি হোক।

আমি চাই না আমার সন্তানেরা আমাদের অচরিতার্থ স্বপ্নের দায় বহন করুক
কোন অলীক জগতে সংসক্ত হয়ে থাকুক
কারোর অন্তঃসারশূণ্য ভ্রান্ত জীবন অনুসরণ করুক
আমাদের কোন ইতরতা-অনৈতিকতা ওদের স্পর্শ করুক।