মোহাম্মদ শামসুজ্জোহার কবিতা

লেখক: মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা Category: কবিতা (Poem) Edition: Dhaboman - Fall 2018

যুদ্ধ

সেও এক হৃদয়ক্ষয়ী যুদ্ধ-
যুদ্ধ মানে ঘাত-প্রতিঘাত
গোলা-বারুদ-দামামা
তীক্ষ্ণ-তীব্র যুক্তির তিরন্দাজি শব্দ বিনিময়;
আটঘাট বেঁধে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে
সবকিছু অধিকারে নেওয়াই চিরায়ত প্রথা;
অথচ যখন তুমি প্রতিপক্ষ
তখন যুদ্ধের সংজ্ঞা-লক্ষ্যই বদলে যায় -
যেন কালবৈশাখী মেঘের রণতুর্যে
দিকবিদিক আড়ম্বর শেষে রিক্ত হয়ে 
উর্বীকে উর্বরা-শস্যময়ী করাতেই সিদ্ধি;
যুদ্ধটা তখন ময়দানে আর থাকে না
জায়গা নেয় অন্তকরণের একেবারে গহিনে-
মনে হয় সব কিছু ছেড়ে দিয়ে 
তোমাকে জিতিয়ে দেওয়াটাই 
আমার পরম বিজয়!
ভিতরটাকে খুব ভাল করে
খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখি-
তার মধ্যে কোনো প্রতিদান-বিনিময়-উপযোগের 
কারণ নিহিত আছে কি !
এমনটা হওয়ার পক্ষে খুঁজে পাই না 
একটাও অকাট্য যুক্তি
বরং বিপক্ষেই যেন খোলা মুক্তির পথ অগুনতি
তবুও নির্বিকার-অসহায় থাকাতেই যত আসক্তি !

 

 

এসেছিলাম

তুমি বলেছিলে, এসো’-
অর্বাচীন অচৌকশ আমি 
শরতের নীল গগনে সতত বদলে যাওয়া 
শুভ্র মেঘের কায়ার মতো
হৃদয়ে কল্পদৃশ্য আঁকতে আঁকতে
হেমন্তের সোনালি মাঠ পেরিয়ে
ফিনফিনে ধুতি কাপড়ের মতো কুয়াশা ঢাকা
কোনো এক ভোরে এসেছিলাম-
মুক্ত বিহঙ্গের মতো 
লোভাতুর এক জীবনের দুর্নিবার টানে।
স্বপ্ন আর বাস্তবের লেগে থাকা
দ্বন্দ্বের ফাঁক গলিয়ে পলকা হওয়ার মতো
কখনো বিপন্ন কখনো অমিয় অনুভবে
উড়ে উড়ে চলেছি প্রয়োজনচ্যূত
কোনো গন্তব্যহীন কাগজের মতো করে।
তবুও নাছোড় অবিনাশী মোহ ঘোর লাগায়-
অবসন্ন বৃষ্টির নির্ঘুম রাতে
পাখির চঞ্চুতে কাঁপন ধরানো খাঁখাঁ দুপুরে,
রূপালী পাখায় উড়ে চলা গাংচিল 
ঝুপ করে জলে ডুব দেওয়ার মতো
শীতের জড়সড় বিকেল 
গোধূলির আবছায়ায় উধাও হলে ।
আছি যেন পালা শেষে হলুদাভ পাতার মতো 
প্রবল অনিচ্ছায় শাখা-প্রশাখা ছেড়ে 
একদিন মাটিতে নেমে যাওয়ার অমোঘ অপেক্ষায় ;
যে দিন বসন্তের শিরশিরে সমীরণ
কোনো অনুরণন তুলতে 
পারবে না নিথর হৃদয়ে!

 

অবাধ্য স্মৃতি

মানুষের মতোই কিছু কিছু স্মৃতি খুব নাছোড়
কিছুতেই চায় না যেতে বিস্মৃতির গহ্বরে;
চোখ বুজলেই 
ঘোর অন্ধকারে জোনাকি পোকার মতো 
দল বেঁধে উড়ে উড়ে আসে -
প্রিয় সেই দহ’র জলে
হিজল গাছটা পাড় ঘেঁষে ঠায় দাঁড়িয়ে;
গনগনে দুপুরে তার ছায়ায় বসে মাছ ধরে 
আত্মভোলা এক বালক সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে;
অথচ বহুবার গিয়েছি গাছটার খোঁজে
কোনো গাছই নেই সেখানে
জায়গাটাই বড্ড অচেনা লাগে
কিন্তু লাভ হয় না কিছুতেই!
চোখ বুঝলেই সেই ডাগর নয়ন
যেখানে অভেদ্য রহস্যে ভরা
ইশারার অবিরাম নাচন
তার সাথে মেলেনি কখনোই মুখের কথন;
চোখে চোখ রেখে পইপই করে খুঁজে
সেসব মেলে না কিছুই এখন।
আমিও তো সেই আমি নেই
স্মৃতিরা অহেতুক টেনেহেঁচড়ে
দূর অতীতের কোনো প্রেক্ষাপটে বসায়;
কী করে পাবে আদি অকৃত্রিম আমায়
সেই অপ্রতিভ-আনাড়িপনা
সবই হারিয়েছে সময়ের করাল গ্রাসে-
পরিপাটি-ঠাটবাটের আস্তরের তলায়!
হারিয়েছে কত মাঠ-ঘাট-প্রান্তর
জীবন, মানুষ, মানুষের ভালোবাসা
কিছু কিছু স্মৃতিই শুধু পিছু ছাড়লো না!