উৎসব

লেখক: মামুন খান Category: ছোট গল্প (Short Story) Edition: Dhaboman - Eid 2019

 

         সকাল থেকেই নাহার মঞ্জিলে একটা উৎসবের আমেজ লেগে আছে। ঈদ পর্ব বাদে সাধারণত তিন ধরণের উপলক্ষ পেলে বাঙ্গালীরা  উৎসবে মেতে ওঠে। প্রথমটি জন্ম, দ্বিতীয়টি বিবাহ, আর তৃতীয়টি মৃত্যু- অর্থাৎ মৃত ব্যক্তির চল্লিশা উপলক্ষে উৎসব। নাহার মঞ্জিলে আজকের উৎসবের উপলক্ষ এই তিনটির কোনটিই না। তবে তৃতীয় উপলক্ষটির সাথে বেশ ভালরকমের যোগসাজশ আছে। এই বাড়ির উৎসবটি মৃত্যুর প্রিপারেশন উপলক্ষে। সব কিছুতেই একটু আধটু প্রিপারেশনের দরকার আছে। যেমন জন্ম উৎসবের প্রিপারেশন শুরু হয়- ফুল শয্যার নিশীথে। আবার এই ফুল শয্যার,  অর্থাৎ বিবাহের প্রিপারেশন শুরু হয়- বাড়িতে ঘটকের আগমন দিয়ে। একই ধারাবাহিকতায় মৃত্যু উৎসবেরও একটা প্রিপারেশনের যৌক্তিকতা এসে যায়। কিন্তু মৃত্যুর প্রিপারেশন কবে থেকে শুরু হবে তা কেউ জানে না। যদি জানত, তবে জন্ম উৎসবের দিনটি থেকেই মানুষ মৃত্যু উৎসবের তোড়জোড় শুরু করে দিত। সে বিবেচনায় সিরাজুল ইসলাম অতিশয় ভাগ্যবান ব্যক্তি। যার নামে নাহার মঞ্জিলের নামকরণ করা হয়েছিল,  সেই নূরুননাহার বেগম বছর পাঁচেক পূর্বেই ইহলোকের কাজকর্ম অসমাপ্ত রেখে পরলোকের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে দিয়েছেন। আর যে ব্যক্তির অর্থ-কড়ি, শ্রম-ঘামে  হেয়ার স্ট্রীটে দেড় বিঘা জমির ওপর বিশাল বাগান সহ দোতলা ভবনটি নির্মিত হয়েছিল- সেই সিরাজুল ইসলাম আজ অবধি বেঁচে আছেন। আজকের উৎসব জীবিত সিরাজুল ইসলামের অনন্ত যাত্রা উপলক্ষে।

     সিরাজুল ইসলাম সাহেব এখনও মারা যাননি, কিন্তু যাবেন- সময় সন্নিকটে।  মরণ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছেন তিনি- ক্যান্সার- অন্ত্রে ক্যান্সার। শেষ মুহূর্তে ধরা পড়েছে- হাতে সময় নেই বললেই চলে। পরিবার পরিজন,  আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, শুভানুরাগী- সব মিলে নাহার মঞ্জিল ক’দিন থেকেই লোকে লোকারণ্য।

     পিতার অন্তিম মুহূর্তের খবর শুনে সুদূর আমেরিকার  ক্যানসাস থেকে স্বপরিবারে উড়ে এসেছে আতাহার ইসলাম- আজ সকালে। আতাহার উইচিটা স্টেইট ইউনিভার্সিটিতে গণিত শাস্ত্রের অধ্যাপক। শৈশব থেকেই আতাহার আচরণগত দিক থেকে অতি বিনয়ী, নম্র, ভদ্র। দীর্ঘ দিন আমেরিকার মত উন্নত দেশে থেকে আর সেই সাথে শিক্ষকতার মত নোবেল প্রফেশনে নিয়োজিত থাকার ফলে সেই ভদ্রতা জ্ঞান চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে সুদে আসলে একটা বিশাল ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আসা অবধি একটা অস্বস্তির মধ্যে আছে সে। অস্বস্তিটা তার পিতার মৃত্যুর দিনক্ষণ ঘিরে। আসলেই তার পিতা সিরাজুল ইসলাম দু’এক দিনের মধ্যে মারা যাবেন কিনা তা নিশ্চিত হতে চাইছে আতাহার। বিষয়টা আত্মীয় স্বজন, এমনকি আপন ছোট ভাই মোতাহারকেও জিজ্ঞেস করতে বিবেকে বাঁধছে তার। মোতাহার আপন ভাই হলেও বাঙ্গালী- আবেগ প্রবণ। মার্কিনীদের মত প্র্যাকটিক্যাল না। আর তাছাড়া এর ওর কাছে ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করার চাইতে বিশেষজ্ঞ অর্থাৎ ডাক্তারের কাছে জিজ্ঞেস করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। সিরাজুল ইসলামের চিকিৎসক হিসেবে নিয়োজিত আছেন দেশের পয়লা কাতারের ক্যান্সার স্পেশালিস্ট ডাঃ আজমুল খান। ডাঃ খানের সাথে কথা বলতে পারলে ভাল হত। কিন্তু রাতের আগে তা সম্ভব না। তবে ভেতরের অস্বস্তি বাইরে প্রকাশ করছে না আতাহার। আত্মীয় স্বজনের সাথে কুশলাদি বিনিময় করার ফাঁকে ফাঁকে নিজের পেশা, নিজ সন্তানদের অসাধারণ মেধা, স্থানীয় অকাট মূর্খ প্রবাসী বাংগালীদের সাথে না মেশার কারণ ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয়েও আলোকপাত করছিল সে- তবে যথেষ্ট ভাব গম্ভীরতার সাথে, পরিমিত পরিমানে।

     পিতার মৃত্যুর দিনক্ষণ এবং এ নিয়ে আতাহারের অস্বস্তিবোধের পেছনে যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত কারণ অবশ্য আছে। বছর দুই আগেও সিরাজুল ইসলামের মৃত্যুর পরোয়ানা জারী করা হয়েছিল। সে যাত্রা স্ট্রোক করে কমায় চলে গিয়েছিলেন ভদ্রলোক। বাঁচার কথা ছিল না। খবর পেয়ে আমেরিকা আর সুইডেন থেকে ছেলে মেয়েরা যার যার কাজকর্ম ফেলে দেশে এসে হাজির। একদিন যায়, দু’দিন যায়, সপ্তাহ যায়- কিন্তু সিরাজুল ইসলামের প্রাণ বায়ু নেভে না।  তবে হঠাৎ দেশে আসার দরুণ ডঃ আতাহার ইসলাম যারপরনাই ক্ষতির সম্মুখীন হয়। সভা সমিতি বা যে কোন আলোচনায় ডঃ  আতাহার মার্কিনীদের উদার নীতি, সততা এবং মানবিক গুণাবলীর ভূয়সী প্রশংসায় মুখে ফেনা ওঠালেও, প্রকৃত সত্যটা তার ঢের জানা আছে। মার্কিনীরা যে কতটা হারামী আর বজ্জাত তা আতাহারের চেয়ে ভাল আর কেউ জানে না। এতদ স্বত্তেও, নিজ ক্ষমতা, যোগ্যতা আর অসাধারণ মেধার সংমিশ্রন ঘটিয়ে, শত প্রতিকুলতার পাহাড় পদপিষ্ট করে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে সে। সে বছর গণিত বিভাগের চেয়ার ডঃ স্মিথ অবসরে চলে যাবার সময়, পরবর্তী চেয়ার কে হবে তা নিয়ে ডিপার্টমেন্ট এবং কেন্দ্রীয় প্রশাসন, উভয় স্থলেই বিস্তর কানা-ঘুষা, দেন-দরবার, গ্রুপিং -লবিং চলতে থাকে। যোগ্যতা আর সিনিয়রিটির দিক বিবেচনা করলে পরবর্তী চেয়ার পদের জন্য আতাহারের নাম সবার কণ্ঠ থেকে বানের জলের মত গল গল করে নিঃসৃত হওয়ার কথা। কিন্তু ক্ষমতা আর স্নেহ  জাতীয় পদার্থ- এ দুই বস্তুর কার্যকারিতা দেশ আর সামাজিক গন্ডিতে সীমাবদ্ধ না, তা বিশ্বজনীন। রেশন দোকানের চাল-ডাল থেকে শুরু করে দাতা গোষ্ঠির ঋণ পর্যন্ত, অথবা গ্রাম বাংলার হাফেজি মাদ্রাসা থেকে শুরু করে পশ্চিমা বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত, সর্বত্রই ক্ষমতা আর স্নেহ পদার্থের ক্ষমতার জুড়ি মেলা ভার।  সময় মত আট-ঘাট বেঁধেই অগ্রসর হচ্ছিল আতাহার। হঠাৎ দেশ থেকে পয়গাম এল- তাদের পিতা সিরাজুল ইসলাম মরে মরে ভাব। পড়ি-মরি করি দে ছুট দেশে। বলাই বাহুল্য, সে যাত্রা সিরাজুল ইসলামের মৃত্যু এবং আতাহারের চেয়ার পদ- এ দুটোর কোনটাই হয়ে ওঠেনি।

     পিতার মর মর অবস্থার কথা শুনে সুদূর সুইডেনের স্টকহোম থেকে দুপুরের দিকে দেশে এসেছে লাইলী। আগের বার আতাহারের মত লাইলীর কেরিয়ারগত ক্ষতি না হলেও, আর্থিক দিক দিয়ে প্রভূত লোকসান হয়েছিল। লাইলীর স্বামী দিদার আলমের স্টকহোমে মিলিয়ন ইউরোর টিম্বার ব্যবসা। পনের দিনের অনুপস্থিতির দরুণ বড় একটা কনট্রাক্ট হাতছাড়া হয়ে যায় তাদের। শুধু তাই না, দেশ থেকে সুইডেনে ফেরার পর টানা ছয় মাস পুরো পরিবার রোগে শোকে ভুগেছে। সেই আর্থিক আর শারীরিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আবার পিতার অসুস্থতার খবরে অতিশয় বিরক্ত হয়েছে লাইলী। শত অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও এবারও তাকে আসতে হয়েছে, বিশেষ একটা গন্ডগোলের কারণে। গন্ডগোলটা তাদের মুমূর্ষু সাবেকী আমলের ধনী পিতা সিরাজুল ইসলামের মরণোত্তর উইল সংক্রান্ত। তবে পূর্বের তিক্ত অভিজ্ঞতা স্মরণে রেখে, লাইলী এ যাত্রা একাই এসেছে। স্বামী এবং সন্তানদের কেউই সাথে আসেনি।

          সিরাজুল ইসলামের মুমূর্ষু অবস্থার খবর পেয়ে আরেকজন অতিথি নাহার মঞ্জিলে এসেছেন। ভদ্রলোক সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি। নাম খলিলুর রহমান। খলিলুর রহমান সম্পর্কে সিরাজুল ইসলামের বেয়াই- ছোট ছেলে মোতাহারের শ্বশুর। বছর পাঁচেক হল রিটায়ার করেছেন। অবসরে যাবার পর থেকে বছরের বেশীর ভাগ সময়ই বিদেশে থাকেন, ছেলেমেয়েদের সাথে। দেশে থাকেন আর বিদেশে থাকেন নিকট আত্মীয় স্বজনদের বিপদে-আপদে, জন্মে-মৃত্যুতে, বিবাহে-বিচ্ছেদে খলিলুর রহমান সশরীরে উপস্থিত থাকেন, এবং তার সাবেক পেশার মনোভাব নিয়ে সেই ঘটনা বা দূর্ঘটনাকে পরিণতির দিকে ঠেলে দেওয়ার দুরুহ কর্মটি অদ্যাবধি সুচারু রূপে পালন করে আসছেন। আগের বার যখন সিরাজুল ইসলাম কমায় ছিলেন তখন রহমান সাহেব সৌদী আরবে অবস্থান করছিলেন- পবিত্র ওমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে। হজ্জ্ব ব্রত পালন শেষে তিনি যখন ঢাকায় ফিরে আসেন তখন সিরাজুল ইসলাম  হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে গেছেন। বেয়াইয়ের এমন ঘোরতর বিপদের দিনগুলিতে সশরীরে উপস্থিত থাকতে না পেরে খলিলুর রহমানের অনুশোচনার অন্ত ছিল না। আর সেজন্যই এবারে  অসুস্থতার খবর পাওয়া মাত্রই সুদূর বিলেত থেকে পড়িমরি করে  উড়ে এসেছেন। যেন তেন বিমানে আসেননি, এসেছেন বাংলাদেশ বিমানে। আজকের দিনে টাকা থাকলে বাঘের চোখ অথবা সাপের মাথার মনিও হাতের মুঠোয় পাওয়া হয়ত বা সম্ভব। কিন্তু মাত্র চব্বিশ ঘন্টার নোটিশে বিমানের লন্ডন টু ঢাকা ফ্লাইটের টিকেট যোগাড় করা একেবারেই অসম্ভব-  ‘না-মুমকিন’।

           তবে কথা একটা থেকেই যায়- হাতী মরলেও মিলিয়ন ডলার। খলিলুর রহমান দেখতে ছোট-খাটো, অপুষ্টিতে ভোগা সজনে ডাঁটার মত টিংটিঙ্গে দেহের গড়ন।  এমনতর আকৃতির একজন মানুষকে হাতীর সাথে (তা হোক না মৃত) তুলনা করা চরম বেয়াদবির সামিল হলেও বিচারপতি রহমানের মূল্যমান সন্দেহাতীত ভাবে মিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। তার পক্ষে বিমানের  টিকেট যোগাড় করা বৃদ্ধাঙ্গুলী আর মধ্যমা সংমিশ্রনে একটা তুড়ির ব্যাপার মাত্র।  নাহার মঞ্জিলের ড্রইং রুমে আত্মীয় স্বজন পরিবেষ্টিত হাজেরাণে মজলিশে খলিলুর রহমান সাহেব সেই অসাধ্য সাধনের কাহিনী অতি নাটকিয় ভঙ্গিতে সবিস্তারে বর্ণনা করছিলেন। এমতাবস্থায় অসুস্থ সিরাজুল ইসলাম সাহেবের খাস লোক, এ বাড়ির অতি পুরোনো ভৃত্য সবুর মিয়া এসে খবর দেয় যে ডাক্তার সাহেব সবাইকে উপরে যেতে বলেছেন। মজলিশের উপস্থিত সবাই আলাপ আলোচনায় এতটাই মশগুল ছিল যে, কোন ফাঁকে ডাক্তার এসেছে তা কেউই টের পায় নি। সবুর মিয়ার ডাকে আলোচনা তখনকার মত স্থগিত রেখে একে একে দোতলায় রোগীর ঘরের দিকে যায় সবাই।

          সিরাজুল ইসলামের ঘরের দরজায় একজন চাকর হাতে একটা কৌটার মধ্যে সুগন্ধি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের মধ্যে মল-মুত্রের গন্ধ থেকে পরিত্রান পেতে দর্শনার্থীরা কৌটা থেকে দুই আঙ্গুলে সুগন্ধি মেখে নাসিকা রন্ধ্রে ঘষে নেয়। পিতার শয্যা পাশে নীরবতা পালনের ভঙ্গিতে ছেলে-মেয়েরা দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। সুযোগ বুঝে ডঃ আজমুল খানকে একটু আড়ালে ডেকে আতাহার নীচু স্বরে বলে, ‘কী বুঝছেন? কবে নাগাদ হবে? হবে তো?’

          ক্যান্সার রোগটা ধনী-গরীবের ভেদাভেদ না মানলেও, দেশের এক নম্বর ক্যান্সার  বিশেষজ্ঞ আজমুল খান এই ভেদটা বেশ সমীহের সঙ্গে মেনে চলেন। দীর্ঘ আড়াই যুগের পেশাগত জীবনে বিস্তর ধনী মানুষের চিকিৎসা তিনি করেছেন। আর তাই এধরণের প্রশ্নও তার কাছে নতুন না।  ‘দেখেন হায়াৎ-মউত তো ঐ একজনের হাতে। সঠিক বলা মুশকিল কবে হবে। তবুও আমার দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা বলছে- যে কোন মুহূর্তে হয়ে যাবে। ম্যাক্সিমাম টুয়েন্টি ফোর আওয়ার্স’, বিমান বালার রেডি মেইড মাপা হাসির মতই রেডি মেইড মাপা উত্তর দেয় আজমুল খান। ডাঃ খানের শেষ দিককার কথা গুলো অপেক্ষাকৃত জোরে উচ্চারিত হওয়ায় ঘরে উপস্থিত অন্যান্য সদস্যদেরও তা কর্ণভূত হয়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের গণনা শুনে সবাই  বড় করে একটা শ্বাস নেয়। সামনে লীন, মৃতপ্রায়  কংকালসার দেহ পানে তাকিয়ে মায়া হয় তাদের, ভীষণ মায়া। কত সুখ, কত আনন্দ, কত হাসি-কান্নার স্মৃতি জড়িয়ে আছে অনন্তপথযাত্রী এই মানুষটিকে ঘিরে। কাছের মসজিদ থেকে আছরের আজানের শব্দ ভেসে আসে।

          খলিলুর রহমানের অতি আঁদরের ছোট কন্যা, এ বাড়ির ছোট বউ জান্নাত আরা বেগম অনেকক্ষণ ধরে সুযোগ খুঁজছিল পিতাকে গোপনে কিছু কথা বলার জন্য।  আজান তাকে সেই সুযোগ করে দেয়। ওজু করার সময় নতুন তোয়ালে হাতে জান্নাত তার পিতার পাশেই দাঁড়িয়েছিল। আশে পাশে চাকর-বাকর থাকায় বারকয়েক বলতে চেয়েও বলে না সে। অগত্যা ভিন দেশী ভাষার আশ্রয় নেয় সে। ইংরেজীতে পিতাকে উদ্দেশ্য করে জান্নাত যা বলে তার মূল ভাবার্থ হচ্ছে- তার ভাসুর বা জা, কেউ যেন ভুলেও শশুরের উইল প্রসংগ না তুলে। ‘আকেলমানদের’ জন্য ইশারাই যথেষ্ট- তা সে ইশারা বাংলা, হিন্দি, উর্দু, তামিল, হিব্রু  অথবা টুটা-ফুটা ইংরেজীতেই হোক না কেন। খলিলুর রহমান যা বোঝার বুঝে গেছে এবং তার মস্তিস্ক ইতিমধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছে। ওজু আর নামাজের সময় তার মস্তিস্ক আবার খুব দ্রুত কাজ করে।

          সন্ধ্যার পর থেকে আগত আত্মীয় স্বজন একে একে বিদায় নিতে থাকে। জোরাজুরি করায় কেউ কেউ রাতের আহার পর্ব পর্যন্ত থেকে যায়। রাতের খাবারের পর হাতে গোনা কয়েকজন নিকট আত্মীয় আর সিরাজুল ইসলামের সন্তানদেরকে নিয়ে খলিলুর রহমান এক জরুরী বৈঠকে বসে। বৈঠকের আলোচ্য বিষয় সিরাজুল ইসলামের আসন্ন মৃত্যু, প্রধান এবং একমাত্র বক্তা খলিলুর রহমান। প্রাক্তন বিচারপতি সাহেব এজলাশে রায় ঘোষনা দেয়ার ভঙ্গিতে শুরু করেন-

‘মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য হচ্ছে মৃত্যু। জন্ম নিলে মরতে হবেই। অনন্ত কাল বাস করার জন্য এই ধরণীতে সৃষ্টি কর্তা আমাদের পাঠান নি। আমার অতি নিকটাত্মীয়, প্রিয় জন সিরাজুল ইসলাম সাহেব আজকে সেই নির্মম সত্যের সম্মুখীন। জান্নাতগামী এই মহান ব্যক্তি উপস্থিত সকলের সাথে কোন না কোন ভাবে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ। কিন্তু এটাই কী তার শেষ পরিচয়?’ প্রশ্নটা উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে করলেও আতাহার, মোতাহার এবং লাইলীর উদ্দেশ্যে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ভঙ্গিতে বলেন খলিলুর রহমান- ‘না, মোটেই না। তোমাদের আব্বা সেই বৃটিশ আমল থেকে রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। পাকিস্তান আমলে দু-দুই বার এম, এল, এ নির্বাচিত হন। আইউব সরকারের সময় প্রাদেশিক মন্ত্রী ছিলেন টানা তিন বছর। এতো গেল তার পদবীর কথা। মানবতার মঙ্গলের জন্য উনি যা করেছেন তা বলতে গেলে পুরো রাত পার হয়ে যাবে। তবে এক কথায় বলা চলে বেয়াই সাহেব তার জীবন উৎসর্গ করেছেন মানবতার কল্যাণে। এমনতর  একজন মহামানবের মৃত্যু আর দশজনের মৃত্যুর মত আড়ম্বরহীন হতে পারে না। আমাদের হাতে যে সময় আছে তাকে যদি পরিকল্পনা মাফিক কাজে লাগাতে পারি তাহলে যথা যোগ্য মর্যাদার সাথে এই গুনী মানুষটিকে আমারা ধরণী থেকে বিদায় জানাতে পারি। যাতে লোকে বলে সিরাজুল ইসলামের উত্তরসুরীরা, তার সন্তানেরা অকৃতজ্ঞ না। উপস্থিত সবাই একমত আমার সাথে?’

আতাহার আর লাইলী বাদে বৈঠকে উপস্থিত সবাই মৌখিক ভাবে বা মাথা নেড়ে খলিলুর রহমানের বক্তব্য সমর্থন করে।

           লাইলী আর আতাহারের মনে তখন তাদের পিতার উইলের কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। বিদেশ থেকেই দুজনে বিশ্বস্ত সুত্রে খোঁজ পেয়েছে যে ছোট ভাই মোতাহার আর তার স্ত্রী জান্নাত অসুস্থ, অথর্ব সিরাজুল ইসলামকে ভুলিয়ে ভালিয়ে সমস্ত বিষয় সম্পত্তি নিজেদের নামে ‘উইল’ করিয়ে নিয়েছে। দেশে আসা অব্দি লাইলী আর আতাহার উইলের প্রসংগ তোলার সুযোগ খুঁজছে। বাইরের সব মানুষ চলে যাবার পর সেই সুযোগ তারা পেয়েছিল। কিন্তু এই বূড়ো হাবরার আঁতলামির কারণে সে সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। ধৈর্য না রাখতে পেরে পাশে উপবিষ্ট বড় ভাইকে কনুই দিয়ে খোঁচা মারে লাইলী। আতাহার কিছু বলার জন্য গলা খাঁকারী দেয়।

           ঝানু খলিলুর রহমানের রাডারে বিষয়টা ধরা পড়ে। তাই আতাহারকে কোন রকম সুযোগ  না দিয়ে সে বলে, ‘তোমার মনের কথা আমি বুঝতে পারছি বাবা। দীর্ঘ দুই যুগ ধরে সুপ্রীম কোর্টে বিচারপতির মত গুরু দায়িত্ব পালন করেছি। এটাতো ফেলনা কোন বিষয় না। তোমাদের মনের কথাই আমার কথা। তাহলে বেয়াই সাহেবের শেষকৃত্য এবং তার পরবর্তি অনুষ্ঠানের একটা পরিকল্পনা করা যাক, কী বল?’

‘জ্বী আব্বা, বাবার অবর্তমানে আপনিইতো আমাদের মুরুব্বী। আপনি যা বলবেন তাই হবে’, শশুরের উদ্দেশ্য বলে মোতাহার। সেই সাথে আতাহারের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে, ‘তাই না ভাইজান, আপনি কি বলেন?’

মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করছে আতাহার। উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া এই মূহূর্তে কোন রকম সীন ক্রিয়েট করা সমীচীন হবে না বিধায় ছোট ভাইয়ের কথায় মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় সে।

‘আলহামদুলিল্লাহ। শুনে নিশ্চিত হলাম। তাহলে কী কী করা যায় তার একটা লিস্ট করে ফেলি। মা জান্নাত, একটা কাগজ আর কলম দে তো মা’।

আলোর গতিতে কাগজ কলম এনে খলিলুর রহমানের সামনে রাখে জান্নাত।

‘নাম্বার ওয়ান- দামি কাঠের একটা কফিন, কি কাঠের, শাল না সেগুন?’

‘শাল কাঠের হলেই ভাল হয়। গুলশান দুই নাম্বারে একটা দোকান হয়েছে। আজকাল মন্ত্রী-মিনিস্টারদের কাফন-কফিন  ওই দোকান থেকেই সাপ্লাই দেয়। দোকানের মালিক আবার আমার ক্লাশ মেইট, নবাবপুর স্কুলে দুই বছর একসাথে পড়েছি’। উত্তর দেয় মোতাহার।

‘আচ্ছা ঠিক আছে শাল কাঠের কফিন আর সবচেয়ে দামি কাফনের কাপড়। এই দায়িত্বটা জামাই বাবাজী তোমাকে দিলাম। বেলা দশটার মধে জিনিষ বাড়ির পেছনের বাগানে রেডি থাকা চাই। এবারে আসা যাক জানাজার কথায়। জানাজা হবে তিন বার। প্রথমে মহল্লার মসজিদে, দ্বিতীয়টি হবে বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেইটে আর তৃতীয় এবং শেষ জানাজা হবে সংসদ ভবনের সামনে। আমি কালকে ফযর নামাজ গিয়ে পড়ব বায়তুল মোকাররমে। খতিব সাহেব আমার বন্ধু লোক। উনাকে ঘটনাটা জানিয়ে রাখতে হবে। বায়তুল মোকাররম থেকে সরাসরি চলে যাব সংসদের স্পীকারের বাসায়। সংসদের সামনে জানাজা আর পরবর্তি অধিবেশনে বেয়াই সাহেবের নামে যাতে একটা শোক প্রস্তাব আসে সে ব্যবস্থা করে আসব ইনশাল্লাহ্‌’।   একটু বিরতি দিয়ে উপস্থিত সবার মতি-গতি বোঝার চেষ্টা করে খলিলুর রহমান। লাইলী বিরক্ত হয়ে এক ফাঁকে উঠে অন্য ঘরে চলে গেছে। আর আতাহারের চোখ ঢুলু ঢুলু, তার মন এখন বিছানায়- উইলে বা খলিলুর হমানের  বক্তব্যের ধারে কাছেও না । অন্য সবাই বিমোহিত নয়নে তাকিয়ে আছে খলিলুর রহমানের দিকে। এরকম আলীশান একটা প্ল্যান এই ছোট-খাটো মানুষটির মাথা থেকে আসল কী করে- ভাবছে সবাই।

           শুভ্র দাঁড়িতে ডান হাতে তৃপ্তির পরশ বুলিয়ে আবার শুরু করে খলিলুর রহমান, ‘এবারে আসা যাক কবরের কথায়। বাবা আতাহার কবর কোথায় দেয়া যায় বলত?’ আতাহার তখন আধা ঘুম, আধা জাগা। ‘আতাহার’ শব্দটা কানে এসে বাজায় অনেক কষ্টে চোখ তুলে প্রশ্ন কর্তার পানে তাকিয়ে বলে সে, ‘জ্বী, খালুজান, কিছু বললেন?’

‘কবর কোথায় দেয়া যায়?’

‘ও কবর? কেন আজিমপুর, আজিমপুর কবরস্থানে! মা’র কবর, তাছাড়া আমাদের অন্যান্য অনেক আত্মীয়-স্বজনের কবরওতো ঐখানে।’

‘এটা কোন যুক্তির কথা না বাবাজী। মরার পর আবার আত্মীয়-স্বজন কী? তোমার বাবাতো ঐখানে দাওয়াত খেতে যাচ্ছে না। আমার মতে উনার কবর হওয়া উচিৎ শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে। বেয়াই সাহেবের মৃত্যুর সংবাদ যখন রেডিও, পাঁচটা টিভি চ্যানেল আর সবগুলি জাতীয় দৈনিকে আসবে, তখন উনার সংক্ষিপ্ত জীবনীর সাথে সাথে একটা কথা বার বার উচ্চারিত হবে- মরহুমকে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে যথাযথ মর্যাদার সাথে সমাহিত করা হয়েছে।  বিষয়টা ভেবে দেখতো, কত বড় সম্মানের কথা!’ অনেকটা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে কথাগুলো বলে খলিলুর রহমান।

‘জ্বী, মুরুব্বী কথাটা ঠিকই বলেছেন।’

‘আব্বার কথাটায় যুক্তি আছে।’

‘খালুজান একটা কোটি টাকার কথা বলছেন।’

ঘরে উপস্থিত একেকজন যার যার সম্পর্ক অনুযায়ী সম্বোধন করে, খলিলুর রহমানের প্রস্তাব কণ্ঠ ভোটে পাশ করে দেয়।

পরম তৃপ্তির সাথে দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে সভার কার্যক্রম পুনরায় শুরু করে খলিলুর রহমান।

 কাফন-কফিন, লাশ গোসল করানো, জানাজা, প্রেস বিজ্ঞপ্তি, কবরস্থানে যাওয়া, কবরের জমি কেনা, রেডিও-টিভিতে নিউজ পাঠানো, সংসদে শোক প্রস্তাব, কুল খানীর তারিখ, কুল খানীর নিমন্ত্রণ পত্র লেখা, নিমন্ত্রণ পত্র বিলি-বন্টন, খাবারের মেনুসহ যাবতীয় কাজের দায়িত্ব একেক জনকে ভাগ করে দিয়ে খলিলুর রহমান  সভার সমাপ্তি ঘোষনা করে পরম তৃপ্তির সাথে ঘুমাতে চলে যায়।

          ঢেঁকি যেমন স্বর্গে গেলেও ধান ভানে অথবা মাতাল যেমন সুরার গন্ধ পেলেই মাতলামী শুরু করে দেয়, কুকুর যেমন ‘ইয়ের’ সুবাস পেলে - - - তেমনি বাড়ির বৌ-ঝি একসাথ হলে একটু-আধটু কথা হয়েই থাকে। আর সেই কথার মধ্যে যদি বার্তা মেশানো ফোঁড়ন থাকে তবে তা হরমোন দেওয়া মুরগীর ছানার মত তরতর করে বেড়ে যায় এক পলকে। লাইলী আর জান্নাতের মধ্যে যে বিশাল আকারের ঝগড়া পরদিন দুপুরে হয়ে গেল তার সুত্রপাত ছিল সদ্য ফোঁটা চিঁউ চিঁউ করা মুরগী ছানার মত অতি ক্ষুদ্র। লাইলী আর তার স্বামীর নামে ঢাকা শহরের অভিজাত এলাকায় দু-দুটো বিশালাকায় বাড়ি আছে। সে বাড়ির ভাড়া সময় মত আদায়, বাড়ির দেখা-শুনা করা এবং খরচা পাতির পর বাকী টাকা ব্যাংকে জমা করার দায়িত্ব দেওয়া আছে মাইনুদ্দীন নামের লাইলীর দুঃসম্পর্কের এক ভাসুরের কাছে। দেশে আসার আগে ফোনে  জানিয়ে দিয়েছে লাইলী, যাতে আসার পরদিনই মাইনুদ্দীন হিসাব সহ তার সাথে সাক্ষাৎ করে। কথা মত পরদিন সকালে লাল রঙ্গের মহাজনি হিসাবের খাতা-পত্র নিয়ে হেয়ার স্ট্রীটের নাহার ভিলায় হাজির হয় মাইনুদ্দীন।

          নাহার ভিলায় প্রবেশ পথে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের মত বড় লোহার ফটক পেরোলেই ছোট্ট পরিসরে একটা বাগান, বাগানের পরেই সাবেক আমলের জমিদারদের মত মজবুত করে তৈরী করা দোতলা ইমারত। ইমারতের মোজাইক করা বারান্দায় বেতের সোফায় বসে নাস্তা শেষে চা পান করছিল লাইলী। মেজাজটা তার যাচ্ছেতাই রকমের খারাপ কাল রাত থেকেই। মেজাজ খারাপ বা রাগ করার কথা মোতাহার, তার স্ত্রী জান্নাত আর জান্নাতের ধুরন্ধর পিতা সুপ্রীম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি খলিলুর রহমানের উপর। কিন্তু যত রাগ হচ্ছে তার এখন বড় ভাই আতাহারের ওপর। আতাহারের এই মিউ মিউ করা স্বভাবের সাথে লাইলী পূর্ব পরিচিত। বছর দুই আগে সামারে উইচিটায় সপরিবারে বেড়াতে গিয়েছিল লাইলী। তখন দেখেছে সে কথায় কথায় শুধু বৌয়ের প্রশংসা। জুঁই এটা করেছে, জুঁই ওটা করেছে, জুঁইয়ের হাতের ওমুক রান্নাটা - - -  ইত্যাদি ইত্যদি। বাড়ির পোষা কুকুরটার ঘেউ ঘেউ যেমন বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে সীমাবদ্ধ, আতাহারের দৈনন্দিন কথা-বার্তাও তেমনি বৌয়ের প্রশংসার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এর বাইরে,  স্ত্রীর সামনে জোরে কাশি দেয়ার সাহস টুকু পর্যন্ত নাই তার। জুঁই যখন আতাহারের সাথে কথা বলে তখন তাকে কথা না বলে  আঙ্গুল আর চোখের একসারসাইজ বললেই ভাল হয়। অবশ্য এতে লাইলী আশ্চর্য হয় নি মোটেই। ইউরোপ আমেরিকা থেকে শুরু করে গ্রাম বাংলার হাটে-ঘাটে নৌকায় ভাসমান বেদে-বেদেনীর সংসার পর্যন্ত সর্বত্রই পুরুষ মানুষ বলতেই স্ত্রীর সামনে হয় বেড়াল, নয়ত ভেড়া, অথবা পাঁঠা বড় জোর রাম-ছাগল। কিন্তু নিজ বৌয়ের কাছে বেড়ালের মত মিউ মিউ করা আর ভরা মজলিশে মিউ মিউ করে কোটি টাকার সম্পত্তি হাতছাড়া করা এক কথা না। সকালে ঘুম থেকে উঠেই আগে বড় ভাইয়ের ওপর এক হাত নেবে বলে ঠিক করে রেখেছিল লাইলী। কিন্তু খানিক বেলা করে ঘুম থেকে উঠে লাইলী দেখে বড় ভাই আতাহার সকাল সকাল  বেরিয়ে গেছে।

          বারান্দায় বসে ধূমায়িত চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তপ্ত মেজাজ ঠান্ডা করার চেষ্টা করছিল লাইলী।  এক গাদা খাতা পত্র নিয়ে লোহার ফটক ঠেলে মাইনুদ্দীনকে প্রবেশ করতে দেখে মেজাজটা একলাফে একশ ডিগ্রী ছাড়িয়ে যায় তার। বাঁ হাতে হিসাবের লাল খাতা বুকের সাথে লেপ্টে  ধরে, ডান হাত কপালে ঠেকিয়ে লাইলীর উদ্দেশ্যে একটা সালাম দিয়ে বাধ্য ছাত্রের মত অবনত মস্তকে লাইলীর সামনে এসে দাঁড়ায় মাইনুদ্দীন।

‘আপনার হাতে লাল রঙ্গের ওগুলো কী?’ স্বরটা যথেষ্ট নম্র রাখার চেষ্টা করে জিজ্ঞেস করে লাইলী।

‘জ্বী, হি- সা- বে-’, কাচু মাচু করতে থাকে মাইনুদ্দীন।

‘আপনাকে না গত বার আসার পরই বলে গিয়েছিলাম কম্পিউটার কেনার জন্য, কেনেন নাই কেন?’

করটিয়া সাদত  কলেজ থেকে ১৯৭৪ সালে ডিগ্রী পাশ করা মাইনুদ্দীন খান বাস্তব জীবনে একটু না ভাল রকমের অকুতোভয় প্রকৃতির। তার গ্রামের বাড়ির পুকুরের মেছো সাপ থেকে শুরু করে মার্কীন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পর্যন্ত পৃথিবীতে যত রকমের বিপদজনক প্রাণী আছে, অথবা দুষ্টু বালকের পকেটে  লুকিয়ে রাখা আম কাটার চাকু থেকে শুরু করে হালের জঙ্গী বোমা পর্যন্ত কোন কিছুতে সে ডর-ভয় পায় না- শুধু একটা জিনিষ আর একজন মানুষ ছাড়া। প্রথমটি,  আধুনিক সভ্যতার সবচেয়ে অত্যাশ্চর্য বিস্ময় (অন্ততঃ মাইনুদ্দীনের কাছে)- কম্পিউটার। আর দ্বিতীয়টি- তার দুঃসম্পর্কের খালাতো ভাইয়ের মুখরা টাইপের স্ত্রী লাইলী। কম্পিউটারের কী-বোর্ডে আঙ্গুল রাখলে রাজ্যের ভয় আর সংকোচ হাতের দশ আঙ্গুলে এসে ভর করে এবং একসময় সারা শরীর অবশ করে দেয়। আর তার অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের বর্তমান উসিলা লাইলীর সামনে আসলে শুধু ভয় না, সাথে একরাশ লজ্জার ভারে সে ঝড়ে আক্রান্ত বাঁশের মত নুয়ে পড়ে। কম্পিউটারের কথা জিজ্ঞেস করায় এই মুহূর্তে মাইনুদ্দীনের অবনত মস্তক আরেক ধাপ নেমে যায়। অনেক কষ্টে শরীরের কাঁপুনি আটকে রেখে মাইনুদ্দীন বলে, ‘ভাবী, মানে, ইয়ে- -‘।

দীর্ঘ দিন ইউরোপে থাকা এবং সেই সাথে মুখরা স্বভাবের হলেও, লাইলীর ভদ্রতা জ্ঞান অতি মাত্রায় টনটনে। মুরুব্বী গোছের একজন মানুষ (তা হোক না গরীব মানুষ) তাকে বারবার ভাবী বলে ডাকে- এটাকে সে সহজ ভাবে মেনে নিতে পারে না। তাই সে মাইনুদ্দীনকে ধমকের সুরে বলে, ‘আপনাকে না কতদিন বলেছি, আমাকে ভাবী বলবেন না!’

‘জ্বী, ভাবী আর বলব না।’

কটমট করে মাইনুদ্দীনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে লাইলী।

‘কই দেখি হিসাব-পাতি দেখি’।

হিসাবের একগাদা  খাতা-পত্র  টেবিলের ওপর মেলে ধরে মাইনুদ্দীন।

একপাতা দুই পাতা করে উলটিয়ে হিসাবে ভুল ধরার চেষ্টা করে লাইলী, ‘এই পাঁচ হাজার টাকা কিসের? এখানে ওমুক খরচটা কোথা থেকে আসল - - -।’

‘না না ভাবী- - - এই যে দেখেন আগস্টের ২ তারিখে - - -’। মাইনুদ্দীন অত্যন্ত বিনয়ের সাথে তার মনিবের ভুল বোঝানোর চেষ্টা করে। মুখে বিনয়ের ভাষা থাকলেও মনে মনে সে বলে, আরে মূর্খ রমণী, তুই যেখানে গরমল খুঁজছিস, গরমিল সেইখানে নেই। গরমিল যা আছে, তা তুই কেন, তোর কোটিপতি কাঠুরিয়া স্বামীও ধরতে পারবে না।

লাইলী যখন হিসাবের গরমিল ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করছিল, তখন এক ফাঁকে জান্নাত পিছনে এসে দাঁড়ায়। হিসাবের খাতায় লাইলীর চিরুনী অভিযান কিছুক্ষন প্রত্যক্ষ করার পর পেছন থেকে টিপ্পনী কেটে বলে, ‘আপা, আপনি কী ইহুদী না-কি?’

দীর্ঘ দিন ইউরোপে থাকার ফলে লাইলী খুব ভাল করেই জানে যে, কাউকে ইহুদী বলা মানে তাকে বিশ্ব-ব্রম্মান্ডের নিকৃষ্টতম গালি দেওয়া। গালি খেয়ে গালি হজম করার স্বভাব আর যার থাক অন্ততঃ লাইলীর নেই।  শুরু হয় কথা কাটাকাটি। কার পূর্ব পুরুষ চোর ছিল? কার ওমুক সম্পর্কের ওমুক লোক চোরাকারবারী করতে গিয়ে হাতে-নাতে ধরা খেয়েছিল। বিদেশ বাড়িতে কার স্বামী না স্বামীর ভাই অন্য বাঙ্গালীর পাসপোর্ট হাপিস করে হাজত বাসী হয়েছিল। এভাবে  হাঁড়ি থেকে বিভিন্ন প্রজাতির ব্যাঙ একের পর এক লাফিয়ে লাফিয়ে বেরুতে থাকে। এক পর্যায়ে আসে উইলের কথা। লাইলীর একটা বদভ্যাস হচ্ছে যে সে উত্তেজিত হলে বেশিক্ষণ বাংলা আঁকড়ে ধরে রাখতে পারে না, সুইডিস ভাষার আশ্রয় নিতে হয়। জান্নাতের সাথে ঝগড়ার সময়ও এর ব্যতিক্রম হয় না। মিনিট পাঁচেক বাংলায় চালানোর পর, মামুলী হাম-জ্বরের মত মাতৃভাষা মন প্রাণ থেকে ঝেড়ে ফেলে সুইডিস ভাষার আশ্রয় নেয় সে। ভীনদেশী ভাষার প্রলয় প্রথম দিকে কালবৈশাখীর মত হলেও ক্রমে ক্রমে তা হারিকেনের তীব্রতা ধারণ করে। হারিকেনের আঘাতে নাকাল জান্নাত, বারান্দা থেকে ড্রইং রুমে আশ্রয় নেয়। ড্রইং রুমেও টিকতে না পেরে, রান্না ঘর এবং রান্না ঘর থেকে সর্বশেষে নিজ বেডরুমে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পায়।

সন্ধ্যার পূর্ব ক্ষণে আতাহার, মোতাহার এবং খলিলুর রহমান সহ অন্যান্য সদস্যবৃন্দ যখন যার যার কাজ সেরে নাহার মঞ্জিলে ফেরে তখন নাহার মঞ্জিল সম্পূর্ণ শান্ত- অল কোয়ায়েট ইন ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট। রণ-ক্লান্ত দুই সৈনিক তখন যার যার বিছানায় গভীর ঘুমে  নিমজ্জিত। বাইরে থেকে ফিরে সবাই একবার করে রোগীর ঘরে গিয়ে খোঁজ নেয়। সিরাজুল ইসলামের ঘরে কর্তব্যরত নার্স বিরস বদনে জানায়, ‘উনি ঠিক আছেন। এখনও খবর হয় নেই’।

মাগরেবের নামাজ শেষে প্রিয় নাতনী সাত বছর বয়সী কুমকুমকে লন্ডনের গল্প শোনাচ্ছিল খলিলুর রহমান। যদিও কুমকুম লন্ডনের গল্প শোনার চাইতে আজকে দুপুরে তার মা এবং বিদেশ থেকে আসা ফুপ্পীর মধ্যে যে বাক-যুদ্ধ হয়ে গেছে তার বিশদ বর্ণনা দিতে বেশী ব্যস্ত। মনে মনে আদরের কন্যা জান্নাতের ওপর নাখোশ হয় সে। মেয়েটার বুদ্ধি-শুদ্ধি একেবারেই নেই। খামোখা ঝগড়া-ঝাটি করে, তৈরী পায়েশে নুনের ছিটা দিয়ে লাভ আছে কোন? তবে সব ভাল তার শেষ ভাল যার। মনে মনে ভাবে খলিলুর রহমান, সেই সাথে তৃপ্তির নিঃশ্বাস নেয়। নাতনীকে লন্ডনের গল্প শোনায় সে। হঠাৎ বুকের বা পাশে চিনচিনে একটা ব্যথা অনুভব করে সে, সেই সাথে নিঃশ্বাসে কষ্ট। চিনচিনে ব্যাথাটা মূহূর্তে বেড়ে যায়। দাঁত মুখ চেপে কোনরকমে কুমকুমকে উদ্দেশ্য করে বলে খলিলুর রহমান, ‘নানা ভাই তোমার আম্মুকে একটু ডেকে আনো তো, আমার বুকে কেমন যেন ব্যাথা করছে’। অনিচ্ছা সত্ত্বেও কুমকুম  জননীকে ডাকতে যায়।

মিনিট পাঁচেক পরে জান্নাত  ড্রইং রুমে ঢুকেই থমকে যায়। কার্পেটের ওপর শুকনো খেজুর শাখার মত বাঁকা হয়ে ডান কাতে শুয়ে আছে খলিলুর রহমান।

‘বাবা কি হয়েছে?’ চিৎকার করে শায়িত খলিলুর রহমানকে জড়িয়ে ধরে জান্নাত। চিৎকারের শব্দে একে একে সবাই ছুটে আসে।

‘কি হয়েছে?’

‘আব্বা এরকম করে পড়ে আছে কেন?’

‘খালু জান, ও খালু জান- - -’।

‘বাবা, ও বাবা কথা বল’।

‘ডাক্তার ডাকো, ডাক্তার’।

এ্যাম্বুলেন্স আসে, ডাক্তার আসে, লোক-লস্কর, দারোয়ান আসে। কিন্তু খলিলুর রহমান কোন কথা বলে না। সে তখন এসব থেকে দূরে, অনেক দূরে।

          সিরাজুল ইসলামকে দেখাশুনা করার জন্য দূ’জন ফুলটাইম নার্স পালা করে ডিউটি দেয়। এদের একজনের নাম আলেয়া বেগম। আলেয়া সন্ধ্যার সময় এসেই ইজি চেয়ারে আরাম করে বসে, সামনে খোলা থাকে হূমায়ুন আহামেদের উপন্যাস। রোগীকে দেখাশোনা করার আসলে কিছু নেই। শুধু ঘটনাটা ঘটে যাবার পর বাড়ির লোকজনকে সংবাদ দেওয়া। ঘটনাও ঘটে না, আলেয়ার খবর এলান করাও হয়ে ওঠে না। হূমায়ূন আহামেদের উপন্যাস পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে সে আরাম কেদারায় ঘুমিয়েই রাত কাবার করে দেয়। সেদিন সন্ধ্যায় বিনা নোটিশে একটা দূর্ঘটনা ঘটে যাওয়ায় নাহার মঞ্জিলে সত্যিকারের উৎসব শুরু হয়ে যায়। একদিকে মাতম, অন্যদিকে লাশের গোসল, জানাজা, গনসংযোগ, চেঁচামেচি, আন্ডা-বাচ্চার প্যানপ্যনানি- বলতে গেলে পূরো রাতটাই মাটি আলেয়ার।  ভোরের দিকে একটু তন্দ্রামত এসেছিল আলেয়ার। হঠাৎ খচমচ আওয়াজ শুনে চোখ মেলে ভূত দেখার মত চমকে ওঠে সে। নাক-মুখ থেকে অক্সিজেনের নল খুলে শোয়া থেকে ওঠার ব্যর্থ চেষ্টা করছে মৃত্যুপথযাত্রী সিরাজুল ইসলাম। চেয়ার ছেড়ে সিরাজুল ইসলামের কাছে যায় আলেয়া, চোখে মুখে তার তখনও ভূত দেখার চমক।

সামনে অচেনা রমণী দেখে ক্ষীণ কণ্ঠে বলে সিরাজুল ইসলাম, ‘তুমি কে?’

‘আমি আলেয়া, আপনার নার্স।’

‘নার্স- - - নার্স’, বার কয়েক শব্দটা পুনরাবৃত্তি করে সে।

‘ও আচ্ছা ভাল। আমি বাইরে যাবো, আমারে বাইরে নিয়া চল’।

সিরাজুল ইসলামের শীর্ণ দেহ বিছানা থেকে তুলতে কষ্ট হয় না আলেয়ার। আলেয়ার কাঁধে ভর দিয়ে এক পা, দুই পা এগুতে থাকে সিরাজুল ইসলাম।

নাহার মঞ্জিল তখন মৃত্যু উৎসবে রমরমা। কেউ বা মাতমে, কেউ বা গোসলে, কেউ বা কাফনে, কেউ বা জোট সরকারের দুঃশাসনের সমালোচনায় মশগুল। উৎসবে মাতোয়ারা মানুষ গুলো নার্সের কাঁধে ভর দিয়ে সিরাজুল ইসলামের জীবন্ত কঙ্কাল আসতে দেখে বিস্ময়ে মমি হয়ে যায় যেন।

বারান্দায় গদিওয়ালা বেতের চেয়ারে এনে সিরাজুল ইসলামকে বসিয়ে দেয় আলেয়া।

চেয়ারে বসে হাঁপায় সিরাজুল ইসলাম, পাঁজরের হাঁড় গুলো উঠা নামা করে সেই সাথে। আতাহার  পিতার কাছে এসে দাঁড়ায়।

‘তুমি কে’? আতাহারের উদ্দেশ্য প্রশ্ন করে সিরাজুল ইসলাম।

‘বাবা, আমি আতাহার, আপনার বড় ছেলে’।

‘আতাহার- - - বড় ছেলে!’

শব্দ গুলো যেন বোধগোম্য হয় না তার। এবারে সামনে শাল কাঠের কফিনে দামী কাফনে জড়ানো খলিলুর রহমানকে দেখিয়ে বলে, ‘ইনি কে? ইনি এভাবে শুয়ে আছেন কেন’?

‘বাবা, ইনি আপনার বেয়াই খলিলুর রহমান। কালকে সন্ধ্যায় মারা গেছেন,’ উত্তর দেয় আতাহার।

‘বেয়াই’, ‘খলিলুর রহমান’ এসবের কোন কিছুই যেন তার বোধগম্য হয় না। তবে ‘মৃত্যু’ শব্দটা তার পরিচিত মনে হয়।

‘ও উনি মারা গেছেন? তা উনাকে এখানে রেখেছ কেন? কবরস্থানে রাইখা আস’।

সিরাজুল ইসলামের কথায় থেমে থাকা উৎসবে নতুন মাত্রা যোগ হয়। লাশের পরিচর্যায় যারা ছিল তারা আবার ব্যস্ত হয়ে ওঠে, মাতমকারীরা পূণরায় মাতম শুরু করে দেয়।

          সিরাজুল ইসলামের কমায় গমনের মধ্য দিয়ে নাহার মঞ্জিলে যে উৎসবের সূচনা হয়েছিল- আত্মীয় পরিজনের কাঁধে সওয়ার হয়ে, শাল কাঠের কফিনে, সাদা কাফনে আচ্ছাদিত খলিলুর রমানের নশ্বর দেহের অনন্ত যাত্রা দিয়ে সেই উৎসব পরিপূর্ণ হয়।

 

টরন্টো

mkhan1969@yahoo.com