ঘোল - মাখন ওয়ালা

লেখক: কানিজ ফাতিমা Category: বাস্তব থেকে নেয়া (Anecdote) Edition: Dhaboman - Eid 2019

কানিজ ফাতিমা 

 

আমাদের ছোটবেলায় অনেক রকম ব্যাবসা  অথবা ক্ষুদ্র ব্যাবসা ছিল, যার মাধ্যমে অনেক পরিবারের আয়- রোজগারের ব্যাবস্থা হত। আমি সময়কালটা একদম নিরধারিতভাবে না বলতে পারলেও হয়ত ১৯৭৫-১৯৮৫, এই এক দশকের মধ্যে হবে, যতদূর আমার স্মৃতিতে ভাসে।

 

আমি ছোট অথবা বুঝতে শিখছি এমন একটা বয়স আমার, তখন আমাদের পাড়ায় একজন বৃদ্ধ  ভদ্রলোক "ঘোল - মাখন" বিক্রি করতেন ফেরি করে। তাঁর পরনে থাকত শুধুমাত্র সাদা রঙের ( যা কিনা অতি পুরানো হওয়ার জন্য ঘি রঙ ধারণ করেছে ) একটা ধুতি হাঁটু পর্যন্ত, খালি পা, কখনও স্যান্ডো  গেঞ্জি পরতেন, আবার কখনও খালি গায়ে থাকতেন, তবে শরীরে ( বুকে - পিঠে ) পৈতাটা ঠিকই থাকত । বড় একটা বাঁশের লাঠির দুই মাথায় দুইটা বড় হাড়ি দড়ির শিকার মধ্যে ঝুলত। একটা হাড়িতে থাকত ঘোল আর অন্যটাতে থাকত পানির মধ্যে ভাসমান মাখনের ছোট ছোট দলা। ঘোলের হাড়ির উপরে এলুমিনিয়ামের থালার উপরে থাকত দুইটা ছোট কাঁচের গ্লাস, যেটা দিয়ে ঘোল মেপে বিক্রি করত।

 

প্রতদিন সকালে সদর দরজায় এসে হাঁক দিত "ঘোল - মাখন, লাগবে ঘোল - মাখন"। অমনি মা বলতো পিরিচ নিয়ে যাও, চারটা মাখন কিনো। আমার ঘোলের দাম মনে নেই, তবে মাখনের দাম মনে আছে। কারণ, ঘোল খেত মা আর আব্বা, আর মাখন খেতাম আমি ও আমার ভাইয়া । একটা মাখনের দাম ছিল চার আনা। একটা মাখনের সাইজ হল এক ইঞ্চি ব্যাসের একটা দলা। "ঘোল - মাখন ওয়ালা" হাত দিয়ে তাঁর হাঁড়ির মধ্যে থেকে মাখন তুলে দিত আমার হাতে রাখা পিরিচের উপর। এই চারটা মাখনের দলা একটা চায়ের কাপের পিরিচে করে ঘরে নিয়ে আসতাম। ( হাইজিন বলে জিনিসটা তখন কেউ তেমন তোয়াক্কা করত না। )

 

ঐ মাখন ঘরে এনে সাথে সাথে একটা গরম রুটির উপরে প্রলেপ দিয়ে তাঁর উপরে চিনি ছিটিয়ে মা রুটিটা পেঁচিয়ে লম্বা রোল করে হাতে দিত খাওয়ার জন্য। আর অন্য আরেকটা মাখন পিরিচের উপরে নিয়ে এক চামচ চিনি ছড়িয়ে চামচ দিয়ে শুধু শুধু চেটে চেটে খেতাম। এইভাবে দুইটা মাখন আমার আর দুইটা মাখন আমার ভাইয়ার জন্য দেয়া হত। সেই মাখন খেয়েই বড় হয়েছি আমরা।

 

"ঘোল - মাখন ওয়ালা" ( নাম জানি না, আমরা এই নামেই তাঁকে চিনতাম ) আবার ঘিও বিক্রি করতেন। মা ঘি এর বায়না দিত ওনার কাছে, বলতো খাঁটি "গাওয়া ঘি"। আর আমাদের প্রতিদিনের খাবারে ঘি থাকত। দুপুরে একরকম ভর্তা বা সবজি ভাজি থাকত আর এক রকম মাছের তরকারি বা ঝোল। মা গরম ভাতের ওপর এক চামচ ঘি ঢেলে দিয়ে লবন দিয়ে ভাতটা নরম করে মেখে দিত। এই ঘি-লবন দিয়ে গরম ভাত অমৃতের মত লাগত। আমার মা ডাল বাগার দিতেন ঘি দিয়ে, অতুলনীয় স্বাদ! আমার মা বলতেন "ঘি - মাখন খেলে বুদ্ধি দীপ্ত হয়"। কথাটার সত্য-মিথ্যা জানি না, তবে "ঘি - মাখন" আমাদের প্রতিদিনের খাবারের অবশ্য অংশ ছিল। এখন সুপার মার্কেটের কত-শত ব্র্যান্ডের মাখন দেখি, কিনি, খাই, কিন্তু সেই স্বাদ তো পাই না!

 

এখনও আমি মাঝে মাঝে গরম ভাত ঘি-লবন দিয়ে খাই, আর আমার বাচ্চারাতো খুবই পছন্দ করে। দুই-তিন লোকমা ভাত  ঘি-লবন দিয়ে খেয়ে তারপর ঐ ভাতের সাথে ভাজি বা ভর্তা দিয়ে খেতাম। সেই স্বাদ এখনও জিহ্বায় লেগে আছে, ভুলতে পারি না। আর সেই একই কারণে "ঘোল - মাখন ওয়ালার" চেহারাটাও মন থেকে মুছতে পারি নাই। এখনও এই মধ্য বয়সে এসব স্মৃতি থেকে থেকে মানসপটে ফিরে আসে।

 

তারপর একটা সময় আসে যখন বড় বড় মিষ্টির দোকান থেকে ঘি কিনে খাওয়া প্রেস্টিজের অংশ হয়ে গেল। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ঘি টিন এর ডিব্বায় বিক্রি হওয়া শুরু হল। হয়ত সে কারণেই একসময় "ঘোল - মাখন ওয়ালা" হারিয়ে গেল আমাদের আশেপাশে থেকে, বুঝতে পারি নাই কখন হারিয়ে গেল। অথবা টেরও পাই নাই, জীবনের চলমান সময়ে, যখন কৈশোর অথবা যৌবনে পড়াশুনা, চাকরী, সংসার, এসব নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম।

 

এখন মনে হয়, ভদ্রলোক হয়ত কয়েক দশক আগেই পরলোকগত হয়েছেন। কারণ, তখনইতো উনি বৃদ্ধ ছিলেন, ৭০এর কোটায় বয়স ছিল। এখন মনে হয়, উনি কীভাবে মারা গেলেন? উনার পরিবার কীভাবে চলত যখন উনি এই "ঘোল - মাখন" আর বিক্রি করতে পারতেন না? ওনার পরে তো আর কাউকে "ঘোল - মাখন" বেচতে দেখিনি আমাদের পাড়ায়।

 

ওনার হাতে তৈরি "ঘি-মাখন" খেয়ে বড় হয়েছি। পড়াশুনা করে উন্নত দেশে থাকছি। খুব জানতে ইচ্ছা করে ওনার পরিবারের সদস্যদের কি পরিণতি হয়েছে?  কি করেন তাঁরা এখন? কোথায় তাঁরা? কেমন আছেন? তাঁরা কি আমারই মতো ভাল আছেন?