লুসিফারের গল্প

লেখক: মাফিয়া মল্লিক Category: প্রবন্ধ (Essay) Edition: Dhaboman - Eid 2019

মাইগ্রেন এটাক গুলোর এমন ভয়াবহ হতে পারে যে মনে হয় এই শেষ, যদি বেঁচেও থাকো বাকিজীবন জড় পদার্থ হয়ে থাকবে। মাইগ্রেনের মজা হলো, ব্যাথাটা তোমাকে নিয়ে খেলতে পারে। 

শুরুতে ‘Aura’ বলে একটা আধিভৌতিক সময় আসে, অদ্ভুত কিছু লক্ষন নিয়ে, যা তুমি একাই বুঝতে পারবে, এটা হলো মাইগ্রেনের খেলার প্রথম চাল। ঘোষনা দিয়েই সে আসে।

Aura টা একেকজনের একেক রকম। হয়তো তুমি দেখবে চারদিক কেমন অন্যরকম হয়ে আসছে, একটু আলো আঁধারী, ঠিক ঝড়ের আগ মুহুর্তের মতো, হালকা শীত ছুঁয়ে যায় যা আরাম দেয় না বরং হাড়ের মাঝে ভয়ের কাঁপন ধরায়। একটু ঝাপসা, ভাসা ভাসা, মাথাটা মনে হবে কেমন জমাট কিন্ত তুলোট, ভারী হালকা, সেই মেলা থেকে কেনা ছোটবেলার অনবরত ঘাড় নড়া মাটির পুতুল বুড়োর মতো। হাঁটতে গেলে পা যেন মাটি ছোঁয় না, কেমন ভেসে ভেসে যাওয়া। রঙ গুলো কেমন অতি পুরোনো চশমার ঘষা কাঁচের ভেতর দিয়ে দেখার মত মায়াবী দেখায়, নরম, স্নিগ্ধ। বইয়ের দিকে তাকালে অক্ষরগুলো হাঁটাহাঁটি করতে থাকে, দেয়ালে ঝোলানো বিমূর্ত ছবি চোখ তুলে তাকায়, যন্ত্রনাটা তখনো শুরু হয়নি তেমন করে। এই সময় টুক করে ওষুধ গুলো খেয়ে নিলে তুমি প্রথম চাল টা জিতে গেলে প্রায় ! 

এরপর শুরু আসল খেলা। প্রথমে দৃষ্টি। রঙগুলো প্রান পায়, জাফরি কাটা জানালার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে আসা বৃষ্টিধোয়া বিকেলের নরম আলোর মতো, তারা নিজের মনে ঘুরে বেড়ায় তোমার চারপাশে, তাকিয়ে দেখে, কানে কানে এক রঙ আরেক রঙ কে কি কি যেন বলে আর হেসে গড়িয়ে পড়ে। একরাশ হাওয়াই মেঠাই এর মতো প্যাস্টেল রঙের পুরো প্যালেট পেঁজা তুলো হয়ে তোমার ঘরের ছাদ দেয়াল মেঝে আবৃত করে ফেলে, ধোঁয়া ধোঁয়া তবু তাদের চেনা যায় আলাদা করে, কবেকার স্টেশনে দেখা বিষন্ন তরুনীর শাড়ীর রঙের মতো, মোটা ফ্রেমের চশমায় যার চোখ দুটো ঢাকা ছিলো তুমি দেখতে পাওনি। আস্তে আস্তে রঙেরা জমাট বেঁধে আসতে থাকে, মেহগনি কাঠের এন্টিক আসবাবের মতো, যেমন রঙ তুমি দেখেছো ঠাকুমার বাড়ীতে তাঁর মায়ের বিয়ের তত্ত্বের আসবাবের গায়ে, গাঢ়, ঔজ্জ্বল্যহীন, ধূলিধুসর তবু প্রতাপশালী বৃদ্ধের মতো রাশভারী, প্রতিপত্তিময়। আসন গেড়ে সে বসে তোমার মস্তিষ্কের মধ্যভাগে, জমাট বাঁধা দুর্বোধ্য সে অপার্থিব রঙ যার স্মৃতি শুধু মাতৃজঠরের অন্ধকারের কথা মনে করায় কিন্তু নিরাপত্তা দেয় না। ভরা বর্ষার আকাশ ভরা পুন্জিভুত বৃষ্টিমেঘের আঁধারের মতো ভারী, ভেজা ভেজা, স্তুপীকৃত অন্ধকার নেমে আসতে থাকে, গাঢ় মেহগনি অতিপ্রাকৃতিক সে রঙ তোমার অস্তিত্ব কে গ্রাস করে নিতে থাকে।

শব্দ শব্দ শব্দ ... শশকের মগ্নতায় শুষে নেয়া পালক ঝরার শব্দ, ঝিম ধরা দুপুরে কান পাতলে নৈঃশব্দের অনুরনন তোলা কর্ণকুহরে, অথবা তুমি শুনতে পাবে কোথাকার কোন পরিত্যক্ত ভেঙ্গে পড়া আলিশান বাড়ীর জংলা বাগানের মাঝে শ্যাওলা ধরা শ্বেতপাথরের চৌবাচ্চার মাঝে ডানা ভাঙ্গা অর্ধনগ্ন অপ্সরী মূর্তির চোখ থেকে ঝরে যাওয়া ফোঁটা ফোঁটা জলের শব্দ ... টুপ ... টাপ ... টুপ ... টাপ ... আলুথালু বসনে দুহাতে নিজেকে আবৃত করার মুহুর্তে ভাস্করের সৃষ্টিতে চিরতরে বাঁধা পড়ে যাওয়া যে অপ্সরীর ভীত চকিত লাজুক দৃষ্টিতে কেউ দৃষ্টি রাখেনা, তার খসে পড়া কাপড়ের ভাঁজের রহস্যে আটকা পড়ে গেছে তোমার মানবেতর কৌতুহল।

শীত নেমে আসে। কার্তিকের রাতভর বৃষ্টির পর শীত শীত সকালের মতো নয়, যে শীতে আলো ফুটি ফুটি ভোরে স্বামীরা আদুরে বেড়ালের মতো স্ত্রীদের টেনে নেয় পুরনো নরম শাড়ীতে বোনা কাঁথার নিচে, অঘ্রানের শেষে পৌষের ধান কাটা মাঠের মতো পাতা পোড়া গন্ধ মাখা মাধুর্য্যে নয়, মাঘের কুয়াশায় ঝকঝকে লেপা উঠোনে উনুনের পাশে চাদর জড়িয়ে তাজা খেজুর রসে চুমুক দিয়ে গরম পিঠার অপেক্ষায় উত্তুরে বাতাসে কেঁপে ওঠা শীত নয়। এই হিম বয়ে আসে শরীরের কোষে কোষে সঞ্চিত পূর্বজন্মের স্মৃতি থেকে, বরফাচ্ছন্ন অন্তহীন দীর্ঘ শীতার্ত দিনের স্মৃতি যেখানে স্তেপ অঞ্চলের মতো দৃষ্টিসীমার ভেতর শীতল শুভ্রতায় নেই শিকার, আগুন বা খাদ্য, অবিমৃশ্য সে শুভ্রতায় মৃত্যু আসে অনিবার্য হয়ে যেখানে, নিয়ে যায় বৃদ্ধ ও শিশুদের, পোষা প্রানী বা অন্তপ্রান। প্রখর দারুন অতি রুদ্র তুষারাবৃত জনপদে নরনারী ভুলে যায় শিকার, কৌশল, রমন। শুধু জিইয়ে থাকে প্রবল এক টিকে থাকার আকাঙ্ক্ষা, যার বসবাস সকল বোধ বিবেচনার উর্দ্ধে শুধুমাত্র ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতায়। এই হিম বয়ে যায় শিরায় শিরায়, ধমনীতে, মস্তিষ্ক হৃৎপিন্ড জরায়ু শীশ্ম যোণী পুরো শরীর অধিকার করে হিম পৌঁছে যায় আরো গভীরে, হাড়ে। মাইগ্রেন ফিসফিসিয়ে জানায়, এবার খেলা তার হাতে।

ঘোড়ার খুরের তুড়ুকে, চিতার ক্ষীপ্রতায়, ময়াল সাপের দৃষ্টি সম্মোহনে মরুপ্রান্তের ধুলি ঝড়ের মতো চারদিক লন্ডভন্ড করে সে ঘিরে ধরে তোমায়, প্রচন্ড যন্ত্রনায় তুমি অবশ হয়ে যেতে থাকো, হাড় মাংস রক্তকনিকা থেকে ত্বক চুল নখাগ্র, ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকো হারিয়ে যেতে থাকো প্যান্ডোরার বাক্সের প্রাচুর্য্যের মতো, অবর্ননীয় সে যন্ত্রনার জন্ম এ পৃথিবীতে নয়। চারদিক ঝলসে ওঠে শত বজ্রপাতের বিস্ফোরিত আলোয়, আকাশ প্রকম্পিত হয় প্রচন্ড নিনাদে, পাশবিক যন্ত্রনায় বিবশ হয়ে যেতে যেতে তুমি সমস্ত স্বত্তা দিয়ে আর্তনাদ করে বলো চাইনা আলো চাইনা শব্দ চাইনা অস্তিত্ব। মৃত্যুকামনায় চেতন অবচেতনের মাঝে ভেসে যেতে যেতে তুমি দেখো, লুসিফারের ছদ্মবেশে মৃত দৃষ্টিতে শীতল গলায় মাইগ্রেন বলছে, কিস্তি।