নদীর বুকে যাদুবাস্তব এক সন্ধ্যা

লেখক: আনজুমান রোজী Category: ছোট গল্প (Short Story) Edition: Dhaboman - Eid 2019

 

 

রাহী অফিসের কাজে চিটাগাং থেকে দুদিন আগে ঢাকায় এসেছে। ঢাকায় আসার খবর ফেবুতে শেয়ার করতেই ম্যাসেঞ্জারে ম্যাসেজ দেয় প্রীতম।

-আপনি এখন ঢাকায়?

-হ্যাঁ। দুদিন আগে এসেছি।

-সময় হবে কি কোনো কফিশপে বসার?

-হতে পারে। দুপুরের পর।

-তাহলে চলে আসুন বেঙ্গল লাইব্রেরিতে।

-ঠিক আছে, চারটায় ওখানে থাকবো।

রাহী না ভেবেই কথা দিয়ে দেয়। হয়তো অবচেতন মনে প্রস্তুত হয়েই আছে। তাই আর সময়ক্ষেপণ না করে কথা দেয়। এমনই বুঝি হয়! এমন আচমকা কিছু ঘটে যাওয়া ব্যাপারগুলোকে রাহী প্রকৃতির বিধান বলে মনে করে নেয়। কিছুই যেন করার নেই। তখন, 'যা হবার তাই হবে' এমন একটা ভাবনা এসে ভর করে।

রাহী রিক্সা থেকে নামতেই দেখে প্রীতম বেঙ্গল লাইব্রেরীর গেটে দাঁড়িয়ে আছে৷ সাদা পাঞ্জাবি আর জিন্স পরা। প্রথম চোখ পড়াতেই রাহী বুঝে ফেলে এই সেই প্রীতম! প্রীতমও বুঝতে পেরে হাস্যোচ্ছল মুখে রাহীর কাছে চলে আসে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যবহৃত ছবি দেখে একে অপরকে চিনে ফেলে। প্রীতম সামনের দিকে হাতবাড়িয়ে বললো, চলুন ভেতরে কফিশপে গিয়ে বসি।

দুজন একসাথে গেট থেকে ভেতরে ঢুকে বেঙ্গল লাইব্রেরির কফিশপে গিয়ে দুকাপ কফি নিয়ে মুখোমুখি বসে। ধীরেসুস্থে কফিতে চুমুক দিতে দিতে প্রীতম বলে, আমরা দূরে কোথাও  যেতে পারি যদি আপনার  আপত্তি না থাকে!

রাহী প্রশ্ন করে,  কোথায়?

--বুড়িগঙ্গায়। নদীতে ভাসবো! বলেই উৎসুক দৃষ্টিতে রাহীর দিকে চেয়ে থাকে।

রাহী কফিতে চুমুক দিতে দিতে বললো, যাওয়া যায়৷

রাহীর বুকে কি কোনো অজানা আশঙ্কা কাজ করছে! নাহ, তো! কেমন নির্ভয়ে বলে ফেললো! হয়তো বিশ্বাসটা সেভাবেই জন্ম নিয়েছিলো! রাহী জানে, প্রীতমের নদীপ্রীতি! নদী মানেই শুশ্রূষা, নারী মানে যেমন! প্রীতম এভাবেই বলে। রাহী মনেমনে হাসলো। প্রীতম আবার বলে,

-তাহলে আগামীকাল সকালের প্রথম লঞ্চে ঢাকা টু চাঁদপুর; আবার চাঁদপুর টু ঢাকা। একদিনের প্ল্যান। কেমন হয় বলেন? তাছাড়া আগামীকাল শুক্রবার, ছুটি। আপনার অসুবিধা হবে নাতো!

রাহী মিষ্টিহেসে মাথানেড়ে বললো, আমি যাবো। এক অজানা উত্তেজনা রাহীর বুকের ভেতর ধড়ফড় করে ওঠে। সবই তো অনিশ্চিত, তারপরেও এতোটুকু কাছাকাছি পাওয়া- মন্দ কী? থাকুক না তা সুখস্মৃতি হয়ে!

 

পরেরদিন খুব সকালে প্রীতম মহিলা হোস্টেলের কাছে গিয়ে রাহীকে উবারে তুলে নেয়। তখনও বেশ সকাল! সূর্য ওঠেনি। এর আগে বুড়িগঙ্গায় কখনো যায়নি রাহী। দেখার একটা তীব্র স্পৃহা এই মুহূর্তের কাজ করছে। তাছাড়া শুক্রবার ছুটির দিন। সারাদিন কী করবে এমনটাই ভাবছিলো রাহী। ঢাকাতে তার তেমন কেউ নেই যে; কারো সাথে দেখা করবে বা কোথাও গিয়ে ঘুরে আসবে! হঠাৎ করে অনাকাঙ্খিত এবং অনাহূতের মতো আজ প্রীতমকে পেয়ে গেলো। যদিও এমন করে দেখা হওয়ার ভাবনা কখনওই তার মাথায় আসেনি। ফেইসবুকে পাওয়া মানুষগুলোকে রাহী অন্যজগতের মানুষ মনে করে। এদের সাথে বাস্তবে দেখা হবে; এমন ভাবনা কখনওই আসেনি। কিন্তু প্রীতম- রাহীর সেই ভাবনাটা ভেঙে দিলো। আর রাহীও মন্ত্রমুগ্ধের মতো প্রীতমের সাথেসাথে ছুটছে।

 

উবারে বসে ঢাকাশহরের সকালের দৃশ্য দেখতে দেখতে যাচ্ছে ওরা। রাহীর মন যেনো খোলা প্রান্তর পেয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে। প্রীতম কী ভাবছে; ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা। নির্লিপ্ত ভাব নিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। রাহী ভাবে, যে মানুষটি ম্যাসেঞ্জারে অনবরত লিখে যায়, এখন সেই মানুষটি কেমন জগদ্দল পাথর হয়ে পড়ে আছে! সেই ভালো। কথা নাইবা হলো। দুজনের অনুভূতি তো কাজ করছে! নাহলে এতো কাছে আজ আসা হবে কেন? গুলিস্তান থেকে জ্যাম শুরু হলো। মানুষ আর গাড়ির ভিড় ঠেলে উবার চলে এলো সদরঘাট টার্মিনালে।

 

প্রীতম আগে থেকেই টিকেটের ব্যবস্থা করে রেখেছিলো। তাই উবার থেকে নেমে সরাসরি লঞ্চঘাটে চলে যায়। ইতোমধ্যে সূর্য তার আলো ছড়িয়ে দিয়েছে। সোনালী আলো চারদিকে। মানুষের ভিড় বাড়ছে। এতো সকালে মানুষের আনাগোনা দেখে বোঝা গেলো- এই সদরঘাট কখনো ঘুমোয় না। এখানে রাতদিন চব্বিশঘন্টা মানুষ, লঞ্চ আর স্টীমারের সরব প্রতিধ্বনি থাকে। লঞ্চে উঠেই কেবিনের ভেতর হাতব্যাগটা রেখে, বাইরে এসে রেলিং ধরে দাঁড়ায় রাহী। প্রীতমও এসে দাঁড়ায় রাহীর পাশে। দুচোখ ভরে বুড়িগঙ্গার দৃশ্য দেখতে থাকে। নদীর ওপারে জলের গা-ঘেঁষে এলোপাথাড়ি দালানকোঠার দোর্দণ্ড রাজত্ব। দৃষ্টিসীমায় এসব জ্বালা ধরায়। রাহী বিরক্ত হয়ে চোখফিরিয়ে নেয়। নদীতে অসংখ্য ভাসমান নৌকা দেখতে পায়। হঠাৎ-হঠাৎ লঞ্চ, স্টিমারের ভেঁপু শব্দে পরিবেশটা কেঁঁপে ওঠে। রাহী তখন প্রীতমের দিকে চোখফিরিয়ে একটু করে হেসে দেয়। প্রীতমও মুখের কোণে একচিলতে হাসি ছড়িয়ে দেয়। ব্যাপারটা এমন যে; ভেঁপুর শব্দে দুজন সম্বিত ফিরে পায়। নড়েচড়ে দুজন দুজনার আরেকটু কাছে এসে দাঁড়ায়। প্রীতম রাহীর শরীরের উত্তাপ পায়। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে চুপচাপ রাহীর পাশে দাঁড়িয়ে সদরঘাটে মানুষের আনাগোনা দেখতে থাকে। রাহীও ঠিক তেমনি মাঝিদের হাঁকডাক আর মানুষের পারাপারের দৃশ্যে বুঁদ হয়ে যায়। মাঝেমাঝে পাশথেকে প্রীতম আড়চোখে দেখে নেয় রাহীকে। এক অজানা অনুভূতি আর নতুনত্বের পরম পাওয়া এই রাহী। যাকে আধো বোঝে, আধো বোঝে না।

 

লঞ্চের রেলিং ধরে কতক্ষণ যে রাহী আর প্রীতম দাঁড়িয়েছিল; বুঝতে পারেনি কেউ। লঞ্চ ভেঁপু বাজিয়ে ধীরেধীরে নড়তে শুরু করে। দুজন দুজনার দিকে তাকিয়ে আবার লঞ্চের সদরঘাট থেকে বের হওয়ার দৃশ্য দেখতে থাকে। লঞ্চ যখন বুড়িগঙ্গা ব্রিজ পার হয়ে গেলো; তখন নদীর প্রশস্ততায় মুগ্ধ হয়ে- একসময় রাহী অস্ফুটস্বরে- 'কী সুন্দর!' বলে ওঠে। প্রীতমও মুগ্ধচোখে রাহীকে দেখতে থাকে।

ব্রীজটা দৃষ্টির আড়াল হতেই প্রীতম বলে,

- চলুন চা, কফি কিছু অর্ডার দিই৷ সকাল থেকে কিছুই তো পেটে পড়েনি!

রাহীও সাথেসাথে, 'ঠিক আছে' বলে কেবিনের ভেতর চলে এলো। প্রীতম কেবিনে ঢুকে অর্ডার দেওয়ামাত্রই চায়ের সাথে ডিম ওমলেট আর দুটো পরোটা চলে এলো৷

কেবিনের ভেতর পাশাপাশি দুটো বেড। একটি বেডে বসতে বসতে একহাতে চায়ের কাপ রাহীর দিকে এগিয়ে দিয়ে প্রীতম বলে,

--এবার বলুন আপনার কথা।

-- আমাদের তো প্রতিদিনই কথা হয়। মনে হয় সবকথা বলা হয়ে গেছে।

-তা কী হয় নাকি! এই যে এখন নতুন একটা পরিবেশে, আমরা পশাপাশি দুজন। কেমন অনুভূতি কাজ করছে! এই কথা তো আমাদের বলা হয়নি। কারণ, আমরা জানতাম না আমাদের এভাবে দেখা হবে!

-হুম, তা জানতাম না।

-ভয় করছে?

-না না। ভয় করবে কেন! আমরা তো একে অপরকে অনেকদিন ধরে জানি। যদিও ফোনে কথা বলা; বা দেখা হয়নি কোনোদিন। তারপরেও একটা বিশ্বাস তো জন্মেছে!

-হুম, আমারও একই ভাবনা। একটা বিশ্বাস তো জন্মেছে। আমি আবার এমনই হুটহাট কিছু একটা করে ফেলি। প্ল্যান করে কোনো কাজ করে চার্ম পাইনা। তাছাড়া তাতে কোনো এক্সাইটমেন্টও থাকেনা। আপনি ঠিক আছেন তো!

 

দেখা হওয়ার পর থেকে রাহী প্রীতমের মুখে এতো কথা একসাথে শোনেনি। ভেবেছিলো পুরোটা পথ এভাবেই নীরবতার মধ্যেদিয়ে কেটে যাবে। রাহী আবার চুপচাপ থেকে- অনুভূতির ছোঁয়ায় থাকতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। কিন্তু এখন আর সেই সুযোগ নেই। তাই একটু নড়েচড়ে বসে বললো, আমি ঠিক আছি। একটু এডভেঞ্চার এডভেঞ্চার লাগছে। এই আর কী!

--হ্যাঁ, তা ঠিক। আমি এই বিষয়টাকে খুব এনজয় করি। হঠাৎ করে কিছু পাওয়া। যেমন আজ আপনাকে পাওয়া! বলেই প্রীতম একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাহীর দিকে। রাহী মাথানুয়ে নির্লিপ্তের মতো খেতে থাকে। খাওয়া শেষ করে আর কোনো কথা না বলে- হাতের প্লেট আর চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে, উঠে প্রীতমের বেডের পাশে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। মৃদুমন্দ মিষ্টি বাতাস রাহীকে ছুঁয়ে যায়। নদীতে সূর্যের আলো ঝিকমিক করছে। নৌযান চলাচলে ব্যস্তসমস্ত নদী। দূরে কোথাও পালতোলা নৌকার হাতছানি । প্রকৃতির এক অপার্থিব রূপ। নদীর দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ করে নদী নিয়ে প্রীতমের ভার্চুয়ালি কিছু কথা রাহীর মনে পড়ে গেলো। প্রীতম  জিজ্ঞেস করেছিলো "বলুন তো, নদীকে নারীর সাথে তুলনা করা হয় কেন?"

- "জলের কাছে নারী চিরকালই বন্দী। কান্না তার চিরসঙ্গী তাই।" বাস্তবতার নিরিখে নারীর এমন অবস্থা থেকেই রাহী একটু উষ্মা নিয়ে জবাব দিয়েছিলো।

প্রীতম লিখেছিলো, "আমার কাছে কিন্তু অন্যরকম মনে হয়।"

-কীরকম? রাহী প্রশ্ন করে চুপচাপ বসে অপেক্ষা করে।

-"তবুও নদীর মানে স্নিগ্ধ শুশ্রূষার জল, সূর্য মানে আলো; এখনো নারী মানে তুমি"...জীবনানন্দ। যতই হম্বিতম্বি করুক পুরুষের শুশ্রূষা, পরিত্রাণ নারীতেই। মন ও শরীর মিলিয়ে নারীর মতো নদীর জলও এই স্নিগ্ধতা দান করে। নারী নদীর মতই উচ্ছ্বল, বহমান এবং পরিবর্তনশীল। নদী যেমন উর্বরতা ধারণ করে, নারীও তাই। নদী ছাড়া সভ্যতা বিকশিত হয়নি, নারীও তেমনি মানব প্রজনন ও বিকাশকে এগিয়ে নিয়ে যায়।

 

প্রীতমের এমন উত্তরে রাহী কিছুটা স্তম্ভিত হয়ে যায়। প্রীতমের ভাবনা আর বোধের গভীরতা দেখে বেশ অবাক হয়। কিছুক্ষণ পরেই রাহী উওর দেয়,

-এটা তো উচ্চমার্গীয় ভাবনা, যা কবি সাহিত্যিকেরা ভাবেন। সাধারণ মানুষ এমন ভাবনার ধারেকাছে দিয়েও যায় না। নারী শুধু চোখের জল- এইটুকুই বুঝি।

-কান্নাকাটি- নারীপুরুষ সকলেই করে। তবে নারীর ক্ষমতা অসীম। একজন নারী- পুরুষের দুর্বলতা, গোপনীয়তা, চেহারার সবদিক জানতে পারেন।

প্রীতমের জবাব পেয়ে রাহী লিখেছিলো,

-হুম, নারী তা পারে। কিন্তু পুরুষ তা পারে না। কারণ, পুরুষ স্বার্থপর। পুরুষ শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবে।

তারপর প্রীতম লেখে,

-এভাবে অবশ্য বলা যায়। অস্বীকারের ক্ষেত্র কম। তবে সোশিও-এন্থ্রোপলোজিক্যালে এর ব্যাখ্যাও আছে। কয়েকহাজার বছর ধরে পুরুষকে লড়তে হয়েছে বন্যপশুর সাথে, প্রকৃতির সাথে, অন্যগোত্রের সাথে। এই লড়াই তাকে বাইরে শক্ত করেছে; কিন্তু ভেতরে সেভাবে পরিপক্ক হতে দেয়নি। নারীর ক্ষেত্রে ঘটেছে উল্টোটা।

রাহী আবার লেখে,

- একসময় পৃথিবীতে নারীতন্ত্র ছিলো। ক্ষমতার পেশীশক্তিতে ক্রমান্বয়ে পুরুষতন্ত্র সৃষ্টি হয়।

-তা সৃষ্টি হলেও মানুষের প্রতিটি আচরণের পেছনে বহুবছরের দীর্ঘধারাবাহিকতা থাকে। তাছাড়া, পুরুষের আগ্রাসী মনোভাব, শারীরিক শক্তির অহমিকা, নিজেকে জাহির করার প্রবণতা, নারীকে অবহেলা-- এসব আমার কাছে শিশুতোষ ইমম্যাচিউরিটি মনে হয়। হ্যাঁ, এটা ঠি যে; পুরুষ স্বাভাবিকভাবে সবল, কল্পনায় সৃষ্টিশীল কিন্তু দুর্বল। দুর্বল বলেই নিজেকে সবল দেখানোর একটা প্রচেষ্টা সবসময় তার মধ্যে থাকে- যেটা শিশুরা করে!

প্রীতমের জবাব পেয়ে রাহী অবাক হয়ে লিখলো,-ওয়াও! হোয়াট এ এ্যাক্সপ্ল্যানেশন!

প্রীতম আবার লেখে,

-আমি সো-কল্ড নারীবাদী নই। কিন্তু নারীর সবকিছুই- বিস্ময়, সম্মান ও ভালোবাসা নিয়ে দেখি।

-হুম, বুঝতে পারলাম।

-আমার কথাগুলো কি ঠিক মনে হচ্ছে?

-আপনার কথা ধরেই বলি, পুরুষ নিজেকে নিয়েই ভাবে, তাই তারা শিশু! এই হলো মোদ্দাকথা।

-শিশু ইমম্যাচিউরিটি অর্থে। আমার কাছে পুরুষদের তাই মনে হয়।

 

রাহী আর কোনো জবাব দেয়না। প্রীতমের লেখাগুলো পড়ে এপাশে বসে নিজের মনে হেসে ওঠে। ভাবে, পুরুষের নমনীয় আদিখ্যেতার কথা। শিশুসুলভ আচরণ আর কোনোকিছু না বোঝার আচরণ; এর সবই  নারীকে কাছে পাওয়ার পুরুষের তীব্র আকুতি! প্রীতমের শোভনীয় আচরণের তুলনা হয় না! কথার পৃষ্ঠে কথা সাজানো এবং তাতে শব্দ বাক্যের চমৎকার সংযোজন; সত্যি অবাক করার মতো। রাহীর মনে কথাগুলো  এখন ঘুরপাক খাচ্ছে। নদী থেকে নারী, নারী থেকে পুরুষ; কত বিচিত্র এর ধারাবাহিকতা! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখফিরিয়ে দেখে- প্রীতম গভীর ঘুমে ডুবে আছে। আর এদিকে প্রীতম রাহীর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে যখন কোনো সাড়াশব্দ পেলো না;;তখন অলসভঙ্গীতে বেডের ওপর গাএলিয়ে দেয়; তারপর একসময় ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে। প্রীতম ঘুমিয়ে আছে দেখে রাহী ধীরপায়ে নিজের বেডে গিয়ে বসে। ব্যাগ থেকে বই বের করে পড়ার চেষ্টা করে।

 

ভার্চুয়াল জগতের মাধ্যমে রাহী-প্রীতমের পরিচয় হয়। অল্পস্বল্প আলাপচারিতায় বুঝে নেয় একে অপরের মানসিকতা। কথোপকথনের দীর্ঘসূত্রিতায় পরস্পরের মনের ঘনিষ্টতা বাড়তে থাকে। তাও প্রায় বছরতিনেক হাই হ্যালোর আলাপন থেকে ধীরেধীরে কথার ফাঁকে চলে আসে বিভিন্ন বিষয়। কখনো দেশের পরিস্থিতি নিয়ে কথা, রাজনীতি নিয়ে কথা; সেইসাথে মানুষ, জীবন, সমাজ, সাহিত্য তো ছিলোই। কথার মারপ্যাঁচে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা বেশ গভীরেই চলে যায়। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের যুক্তিতে দুজনেই অনড়। স্বাধীকার আন্দোলনে মুক্তিযুদ্ধের বিষয় বাংলাদেশ এবং বাঙালি অস্তিত্বের একটি অপরিহার্য অংশ। এই বিষয়ে কীভাবে কী করা যায়; তা নিয়েও চলে লম্বা আলোচনা। অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনায় উজ্জীবিত দুটি মানুষ স্বপ্ন দেখে শান্তির এক বাংলাদেশ! যেখানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই এক হয়ে বসবাস করবে । এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের কিছু কাজও প্রীতম হাতে নিয়েছে। এসবও রাহীর সাথে আলাপচারিতায় জানায় প্রীতম। রাহীও মুগ্ধ হয়ে ভাবে- এখনো পৃথিবীতে মানুষ আছে বলে পৃথিবীটা আজো এতো সুন্দর।

 

 

কোলের ওপর বইটা নিয়ে চুপচাপ বসে থাকে রাহী। পড়ায় আর মন দিতে পারেনি। প্রীতমকে পাওয়ার পর থেকে শুরু করে আজকের এই মুহূর্ত পর্যন্ত অনেককিছু মনে পড়ছে । হঠাৎ করে প্রীতমের ঘুমভরা মুখের দিকে রাহীর চোখ পড়ে। একদৃষ্টিতে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে- ইচ্ছে হচ্ছিলো প্রীতমের চুলে আঙ্গুল দিয়ে বিলিকেটে দিতে। আরো ইচ্ছে হচ্ছিলো প্রীতমের প্রশস্ত কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিতে। এমনটা ভাবতে ভাবতে রাহী বেড থেকে নেমে কেবিনের বাইরে চলে আসে। সূর্যটা এখন মধ্যগগনে গনগন করছে। রোদের তাপে নদীর জলও যেনো তেঁতে উঠছে। লঞ্চ এখন বুড়িগঙ্গা নদী থেকে ধলেশ্বরী হয়ে শীতলক্ষ্যাকে পাশ কাটিয়ে মেঘনায় উঠে গেছে। মেঘনায় লঞ্চ প্রবেশ করতেই ছোটছোট জেলেনৌকা পানির ঢেউয়ে দুলুদুলু দুলছে। মনে হবে এই তো বুঝি উল্টে গেল, কেউ বা ধরছে জাল টেনে, শক্ত হাতে হাল টেনে ধরছে তার সঙ্গী, কেউ বা নৌকায় বসে গুনে নিচ্ছে ধরাপড়া মাছের সংখ্যা, কারো মুখের কোণে লেগে আছে হাসি! ওদিকে নৌকায় জীবন্ত ইলিশের ছটফটানি! এসব দৃশ্য চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে রাহী।

 

কেবিনের এদিকটা খুব নীরব। মানুষের আসা যাওয়া নেই বললেই চলে। রাহী মনে মনে খুশি হয় এমন নিরিবিলি পরিবেশ দেখে। এভাবে যে কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলো বুঝতে পারেনি। হঠাৎ কাঁধের ওপর হাতের ছোঁয়ায় ফিরে দেখে- প্রীতম ঘুম থেকে উঠে রাহির পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। আচমকা এমন ছোঁয়ায় কেঁপে ওঠে রাহী! একটু সরে যেতেই- প্রীতম ওর হাত ধরে কাছে টেনে এনে বলে, দেখো, আমরা চাঁদপুরের কাছাকাছি চলে এসেছি। রাহী আর কোনো কথা না বলে প্রীতমের পাশে দাঁড়িয়ে দূরে চাঁদপুর শহর দেখার চেষ্টা করে। প্রীতম দুকাপ কফির অর্ডার দেয়। মাঝনদীতে কফিতে চুমুক দিতে দিতে উথালপাতাল মেঘনার অপরূপ শোভাদেখতে থাকে দুজন।

 

দুপুর দু'টোয় চাঁদপুর ঘাটে লঞ্চ ভেড়ে। লঞ্চ থেকে বের হয়ে রাহী-প্রীতম চাঁদপুরের মোহনায় যাওয়ার প্ল্যান করে। যেখানে পদ্মা, মেঘনা আর ডাকাতিয়া; এই তিনটি নদী একসাথে মিশেছে। চাঁদপুর মোহনার কাছে গিয়ে রাহী বিস্মিত হয়ে যায়। বিস্তৃত নদীর ধূ ধূ চরাচর দেখে প্রকৃতির কাছে আবেগী হয়ে ওঠে। প্রীতমও অভিভূত হয়ে নদীর সৌন্দর্য দু'চোখ ভরে দেখতে থাকে। অস্ফুটস্বরে বলে,

'এখানে নদীর মতো এক দেশ

শান্ত, স্ফীত, কল্লোলময়ী

বিচিত্ররূপিনী অনেক বর্ণের রেখাঙ্কন

এ আমার পূর্ব বাংলা

যার উপমা একটি শান্ত শীতল নদী'

 

কাছেই দাঁড়িয়েছিলো রাহী। একটু হেসে বললো, 'আমার পূর্ব বাংলা', সৈয়দ আলী আহসা্নের লেখা।

-হুম। সেই একই তো দেশ। আমার বাংলাদেশ।

আবার নদীর দিকে মুখঘুরিয়ে প্রীতম বলে,

-একজন নদীর ভেতর একনদী মেঘনাকে দেখি। 'মেঘনা আমার প্রিয়া, কেন এমন ব্যাকুল ডাকো বারবার?'

রাহী কোনো কথা না বলে নীরবে প্রীতমের পাশেপাশে হাঁটতে থাকে। নদীর উন্মত্তা আর দুজনের হৃদয়ের উন্মত্ততা এক হয়ে বাজে। দুজনই অস্থির, উন্মুখ। কিন্তু কেন? যেন প্রকৃতির আবহে সমর্পিত দুজন।

 

কিছুক্ষণ এদিকসেদিক ঘোরাঘুরি করে ছবি তোলে দুজন। নদীরপাড়ে এক লোকাল রেস্টুরেন্টে প্রীতম, রাহী ঢুকে মেঘনার তরতাজা ইলিশ দিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে আবার লঞ্চঘাটে ফিরে আসে। বিকেলের লঞ্চে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় তারা।

 

রাহী লঞ্চের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। নদীর বাতাসে চুলগুলো উড়ে উড়ে মুখের ওপর পড়ছে। অলক্ষ্যে সেই চুল বারবার হাত দিয়ে সরিয়ে নদীর দিকে একমনে তাকিয়ে থাকে । প্রীতম একটু দূরে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখে। মেঘনার বুকে এখন পড়ন্ত বিকেল, গোধূলিরঙে রাঙা। সেই রঙ নদীর জলে মিশে আধোলাজের আভা ফুটে ওঠে, যেনো রাহীর মনের আড়ষ্টভাব। একবার নদীর জলের দিকে, একবার রাহীর দিকে চোখ রাখে প্রীতম। দুজনেই নির্বাক, নিশ্চুপ। শুধু নদীর ঢেউয়ের মতো অনুভূতিগুলো একে অপরের দিকে আছড়ে পড়ছে। রাহীও লক্ষ্য করলো, প্রীতম তার এতো কাছে দাঁড়িয়ে আছে যে; মনে হচ্ছে লক্ষযোজন দূরে দাঁড়িয়ে আছে। শিশুসুলভ ভাব তার মুখাবয়বে, অথচ কী কঠিন তার ব্যক্তিত্ব!

প্রীতমের পাশে দাঁড়িয়ে রাহী তাদের ভার্চুয়ালি কথোপকথনের বিষয়গুলো মনে করার চেষ্টা করছে। আজই প্রথম প্রীতমকে দেখেছে। তাও আবার অযাচিতভাবে।

 

রাহীও বিয়ে কিরেনি, বিয়ে করেনি প্রীতমও। দুজনেরই কাছাকাছি বয়স। প্রীতমের বোহেমিয়ান জীবন। একথা প্রীতম অনেকভাবেই রাহীকে বুঝিয়েছে। কোনো বন্ধন তার ভালো লাগেনা। কোনো আবেগতাড়িত সম্পর্কেও বেশিদিন সে থাকতে পারেনা। এমনকোনো সম্পর্ক প্রীতম চায় না; যে সম্পর্কে কোনো কমিটমেন্ট থাকে। এসব রাহী ভালো করেই জেনেছে এবং বুঝেছে। প্রীতমের প্রায় কথাতেই এমন একটা সুর সবসময় ফুটে ওঠে। তারপরেও কোথায় যেনো এমন কিছুএকটা আছে; যার কারণে প্রীতমকে রাহীর ভালো লেগে যায়। দিনের পর দিন চ্যাট করতে করতে কখন যে একে অপরের কাছে চলে আসে! সেইসাথে চলতে থাকে অপেক্ষার প্রহর। কখন কথা হবে, কখন প্রীতম বলবে গুড মর্নিং! বলতে গেলে একরকম মোহগ্রস্ত হয়েই আজকে এভাবে হিতাহিত জ্ঞানের ধার না ধেরে প্রীতমের সাথে রাহীর চলে আসা!

 

এদিকে রাহী পুরোই ঘরকুনো মেয়ে। নিজের মতো একাকী থাকতে ভালোবাসে। ভালোবাসে বই পড়তে, মুভি দেখতে। ঘুরতে খুব পছন্দ করলেও অসুস্থ মা'কে রেখে কোথাও যেতে পারেনি। মা, মেয়ে মিলে দুজনের সংসার। শান্তস্বভাবের রাহী- প্রয়োজন ছাড়া কোনো কথা বলতে চায়না। জীবনের ব্যাপারেও তেমন কোনো নির্দিষ্ট ভাবনা নেই । যখন, যা হবার হবে। সময়ের ওপর সবকিছু ছেড়ে দিয়ে একরকম নিরবছিন্ন জীবনযাপন রাহীর । এরমধ্যে কেউ যদি ভালোবেসে কাছে এসে রাহীর জীবন জগৎ ভরিয়ে দিতে চায়; দেবে! রাহীও এমনকিছুর অপেক্ষা করছে। যদি কেউ এসে যায় রাহীর জীবনে! প্রীতমকে নিয়ে সেভাবে ভাবতে পারছে না। কিন্তু প্রীতমের প্রতি এক অলীক আকর্ষণ রাহীকে বুঁদ করে রেখেছে। এই আকর্ষণে পাওয়া না-পাওয়ার ঊর্ধ্বে কিছু আছে কিনা জানে না! তবে ভালোলাগে। এই ভালোলাগার অর্থই কি ভালোবাসা? এমন এলোমেলো কিছু ভাবতে ভাবতে প্রীতমের আরো কাছে এসে- রাহী তার মাথাটা প্রীতমের কাঁধে এলিয়ে দেয় এক নির্ভার অনুভূতিতে।

 

বাতাসে ঠাণ্ডার ভাবটা বেড়ে যায়। কনকনে ঠাণ্ডা সহ্য করতে না পেরে রাহী উঠে কেবিনে চলে আসে। পিছুপিছু  প্রীতমও আসে। প্রীতম নিজ বেডে বসতে বসতে বলে, সময় কীভাবে গড়িয়ে গেলো! আমাদের কিন্তু সেভাবে কথাই হলো না।

স্মিতহেসে রাহী বলে, কিছুকথা না হয় জমা থাকুক!

নির্জন চারিধার। মনেমনে প্রীতম আঁকে আনকোরা ছবি। সন্ধ্যাস্তিমিত আলোয় পাশাপাশি দুজন। একহাত ব্যবধান মাঝখানে। আধহাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে, চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে নেয় রাহী! অফুরান দিগন্ত অবধি নিষ্পত্র এই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে প্রীতম ভাবে,

"ক্ষুধার্ত নদীর মতো তীব্র দু’টি জলের আওয়াজ তুলে

মিশে যাই চলো অকর্ষিত উপত্যকায়!

চরের মাটির মতো খুলে দাও শরীরের ভাঁজ!

উগোল মাছের মাংস তৃপ্ত হোক তোমার কাদায়"

[সোনালি কাবিন-৩/আল মাহমুদ]

 

ভাবতে ভাবতে প্রীতম রাহীর খুব কাছে এসে দুহাতে মুখটি তুলে ধরে। চোখে চোখ রেখে বলে,

--এমন রহস্যময়ী যেনো কখনো দেখিনি! দেখিছি কী কখনো! হয়তো কখনো আর দেখবো না।

 একটু চুপ  থেকে আবার বলে, আমি জানি, নদীও কখনো কখনো বিবস্ত্র হয়।

রাহী প্রীতমের হাতটি সরিয়ে দিয়ে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে- আমি জানি আমাদের আর কখনো দেখা হবে না। তারচেয়ে' বরং এভাবেই থাক! রেশটুকু থেকে যাক আজন্ম।

 

রাত আটটায় লঞ্চ সদরঘাট টার্মিনালে এসে ভিড়ে। রাহী আর প্রীতম লঞ্চ থেকে নেমে- দুজন দুদিকে উবার নিয়ে চলে যায় যারযার গন্তব্যে। এরপর রাহী আর প্রীতমের সাথে যোগাযোগ করেনি। কারণ, রাহী জানে, প্রীতমই আর কখনো রাহীর সাথে যোগাযোগ করবে না। সেই ভালো! নদীর বুকে সন্ধ্যাটা যাদুবাস্তব হয়ে থাক!