বিবাহ সমাচার

লেখক: মুরাদ নেওয়াজ Category: ছোট গল্প (Short Story) Edition: Dhaboman - Winter 2020

মুন্সিগঞ্জের রহিমপুর গ্রামের মুন্সী বাড়িতে মহা হৈ চৈ, আনন্দের শেষ নাই। এই অবেলায় পাড়া প্রতিবেশীর কিছু মুরব্বিও জড় হয়েছে । খবর এসেছে করিম মুন্সির বড় ছেলে সুদূর আমেরিকার নিউইয়র্কের কুইন্স এ বসবাসকারি তাহের তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে আগামী রবিবার গ্রামের বাড়িতে আসছে। আর মাত্র তিন দিন বাকি।

মুন্সি বাড়িটি বেশ বড়, একটা পাকা দালানও এবড়ো থেবড়ো ভাবে দক্ষিণ দিকে রয়েছ। সবাই মিলে ঠিক করেছে ওখানেই তাহেররা থাকবে, আলো বাতাসের কোন অভাব নেই। তাহের আজকাল নাকি ফাকা, নির্জন, আলো বাতাস, প্রকৃতি খুব পছন্দ করা শুরু করেছে। গরমে তার ঘুম হয় না, তাই একটা এয়ারকন্ডিশনের ব্যবস্থা কি করে করা যায় তার জন্যে এই মুহূর্তে খুব জোরালো আলোচনা চলছে। সব সময় আবার ছাই কারেন্টও থাকে না , এটা একটা মহা জ্বালা।

আলোচনা যখন তুঙ্গে তখন মুন্সি বাড়ীর বড় জামই  সুরুজ মিয়া তার বোরখা পরা স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে হাজির, কাঁধে এক কাঁদি সবরি কলা।সুরুজ মিয়া সালাম,কদম বুছি সেরেই মহা শোরগোল বাধিয়ে দিল। কি কি করা হয়েছে, কি কি করা হবে, কি খাবে, কোথায় থাকবে ইত্যাদি নিয়ে মহা চিৎকার চেঁচামেচি। আগেই বলেছিলাম আমি না আসলে কিছুই হবে না, সব জেনে তার এই মন্তব্য। বাথরুমের অবস্থা দেখে সে মহা বিরক্ত।তাঁর প্রস্তাব, মাইক, ব্যান্ড, ছামিয়ানার ব্যবস্থা করতে হবে, একটা তোরণ নির্মাণ করতে হবে, একটা হাতি কিম্বা উটের ব্যবস্থা করতে পারলে ভালো হয়। সে যখন প্রবাসে, সৌদি আরবে ছিল তখন অনুষ্ঠানে উটের ব্যবস্থা সে নিজের চোখে দেখেছে। বড় বৌ কে মালা দেবার জন্যে একটি ছোটো মেয়েকে ট্রেনিং এর ব্যবস্থাও করতে হবে, এটা তার মেয়েকে ট্রেনিং দিয়ে নিজেই তৈরি করে নিতে পারবে। তার হম্বি-তম্বি বা জামাই এর অধিকার এর কারনেই হোক তার সব প্রস্তাবই গ্রহণ করে নেয়া হলো। ঠিক হলো গ্রামের স্কুলের হেড মাস্টারের তত্ত্বাবধানে স্কুলের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা লাইন ধরে দাঁড়িয়ে, রঙ বেরঙ এর ফ্ল্যাগ নাড়িয়ে নব দম্পতিকে সম্বর্ধনা জানবে। এই ব্যাপারটা জামাই বাবাজি কিছুদিন আগেই দেখেছে এক মন্ত্রীর আগমনে, দুপুরের কড়া রোদে বাচ্চা ছেলেমেয়েরা হাত দুলিয়ে দুলিয়ে হাস্যউজ্জ্বল মন্ত্রী মহাশয়কে বরন করে নিচ্ছে। মন্ত্রীর মুখে সে যেন এক শিশুর হাসি, পবিত্র। সেই দলে তার মেয়েও ছিল, বাড়ী ফিরে পরের সাতদিন প্রচণ্ড জ্বরে পড়ে ছিল বিছানায়।

 সব দেখে শুনে তাহের এর বাবা করিম মুন্সি মহা বিরক্তি দেখিয়ে বললো “আহা এতো হৈ চৈ এর কি দরকার , তোমরা যখন বলছো......”  তবে মনে মনে সে খুব আনন্দিত। পাশের গ্রামের কাজি বাড়িকে দেখিয়ে দিতে হবে আমেরিকাতে ছেলে থাকার মর্ম কি? সামনে আবার ইউনিয়ন কাউন্সিলের ইলেকশন ও বটে। একটু গভীর রাতে আমেরিকায় ফোন করে জানতে চাওয়া হল নতুন বউ কি কি খেতে পছন্দ করে, বার্গার, পিজ্জা লাগলে তো ঢাকা থেকে ব্যবস্থা করতে হবে। গরম বা ঠাণ্ডা পানির ব্যবস্থা করতে হবে কি না? চা না কফি পছন্দ করে ...। সব শুনে তাহের লাজুক স্বরে বললো “আপনরা খুব বাড়াবাড়ি করছেন, যেটা ভালো মনে হয় সেটাই করুন।”

 নিউইয়র্কের কুইন্সের ভাড়া করা তাহের এর এপার্টমেন্টএ তখন অন্য দৃশ্য। আশেপাশের ফ্লাট থেকে বাঙালি বন্ধুরা সব এসেছে তাহের এর ফ্লাট এ , ফ্লাটের চারিদিকে সুটকেসের ছড়াছড়ি, বাংলাদেশে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে। নতুন বউকে শাড়ি পরানোর মহড়া শুরু হোলো, সে এক গলদঘর্ম অবস্থা। তারে হাতে কলমে শিখানো হচ্ছে কি করে হাঁটু গেড়ে মুরুব্বিদের পা ধরে সালাম করতে হয়। পাশের ফ্লাটের হাসু ভাবি এক ফাকে দেখিয়ে দিলো কি করে ঘোমটা পড়ে লাজুক ভাবে হাসতে হয়। পিছনে ক্যাসেট এ গান “বউ সাজো গো......” অনেক রাতে সবাই ভরপেট খেয়ে, মিষ্টি মুখ করে, পান খেয়ে ঠোট লাল করে যার যার ফ্লাটে ফিরে গেলো। মনে তাঁদের বিরাট তৃপ্তি , নূতন বিদেশি বউ কে সব কিছু ভালো ভাবে শিখানো গ্যাছে, তা না হলে  কি কেলেঙ্কারি যে হতো ?     

 সকাল ৭ টা , গ্রামটা কেবল  ঘুমের  শেষে জেগে উঠতে শুরু করেছে, চারিদিকে নীরব নিস্তব্ধ। কিন্তু মুন্সি বাড়ির কোলাহলে চারিদিকের পাখিগুলোও উধাও। জামই সবুজ মিয়ার গলা শুনা যাচ্ছে, “এখনও মাইক বাধা হোল না , ব্যান্ড পার্টির খবর কি? ছামিয়ানা টাঙ্গনো এখনও বাকি, আচ্ছা আমি ছাড়া কি একটা কাজও কি হবার নয়।”                 তাহের এর ফ্লাইট বিকাল ৫ টায়। আস্তে আস্তে সময় এগিয়ে যায়। ছেলেমেয়েরা বাড়ির উঠানে হৈ চৈ করে খেলা করছে। জামাই তাদের দিলো কষে ধমক, তারা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো, বুঝলই না কেন তারা বকা খেলো ? এমন সময় বাইরে মাইকে বেজে উঠলো গান “ দাদা পায়ে পড়ি রে মেলা থেকে বউ এনে দে” । ছেলেমেয়েরা সব দুড়দাড় করে বাইরে চলে গেলো। স্কুলের হেডমাস্টার তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে হাজির,  ফ্ল্যাগ নিয়ে হাত দুলনির একটা মহড়াও হয়ে গেলো। গ্রামে ঢোকার মুখে একটা তোরণ তৈরি শেষ , ব্যান্ড পার্টীও হাজির। হাতি বা উট যোগাড় করা যায় নাই, সময় কম কিন্তু একটা গাধা যোগাড় করা গ্যাছে, বাইরে আম গাছের সাথে তারে বেধে রাখা হয়েছে , পিঠে তার লাল কাপড়ের বালিশ। জামাই বাবাজীর গলা চড়ছে সময়ের সাথে সাথে।

দুয়ারে দুটা মাইক্রোবাস প্রস্তুত ঢাকা বিমান বন্দরে যাবার জন্যে, ফুলে ফুলে সাজানো। বউ কে বরন করার জন্যে, আতপ চাল, দূর্বাঘাস, কুলা, ফুলের মালা সব উঠানো হচ্ছে গাড়িতে। জামাইয়ের তত্ত্বাবধানে ১০ জনের একটা দল যাচ্ছে বিমান বন্দরে, মেয়েরা ঘরের ভিতর এখনও সাজা গোজায় ব্যস্ত । তাদের দেরি হচ্ছে, মেজাজের পর্দা উঠছে জামাই সুরুজ মিয়ার। অস্ফুট স্বরে বলছে “ এই জন্যই আমি মেয়েদের নিতে চাই নি , শুধু জানে সাজু গুজু, আরে প্লেন কি আমদের জন্যে ওয়েট করবে? আমাদেরকেই প্লেন এর জন্যে ওয়েট করতে হবে।”  এর মধ্যে হোল আরেক বিপত্তি, সুরুজ মিয়ার মেয়ে জবাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তাকেই ট্রেনিং দেওয়া হয়েছিলো নতুন বউকে মালা দেবার জন্যে। অনেক  খুঁজাখুঁজি করে তারে পাওয়া গেলো বাঁশ বাগানে , প্রজাপতি ধরতে ব্যস্ত ছিল সে। সূর্য মিয়া কষে দিল তারে একটা থাপ্পড়, “বদমাইশ মেয়ে তুমার জন্যে আমাদের সবার দেরি হচ্ছে, কাণ্ডজ্ঞান আর কবে হবে” –চেঁচিয়ে উঠলো সুরুজ মিয়াঁ। জবা কান্তে কান্তে, মুখ ডলতে ডলতে গাড়ীতে উঠে বসলো। জবাকে যেতেই হবে , তাকেই তো নতুন বঁধু কে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নেবার ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। বিমান বন্দরের দিকে শুরু হোল শুভ যাত্রা। বেজে উঠলো ব্যান্ড পার্টি, মাইকে গান “কতদিন দেখি নি তোমায় ......”

 বিমান বন্দরে যখন উপস্থিত হলো দুটা মাইক্রোবাস, তখনো আরও দুঘণ্টা বাকি প্লেন আসতে। দুলাভাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বল্লো, “দেখলে কি সময় মতো পৌঁছে গেলাম , এরেই বলে সঠিক প্লান“। এর মধ্যে জানা গেলো ফ্লাইট এক ঘণ্টা লেট। মহিলারা বেশ অস্থির হয়ে পড়ল, তাদের বিরাট চিন্তা, ফুল, দূর্বা না যেন সব শুকিয়ে যায়, একটু পানির ছিটা দিতে পারলে ভাল হতো। দুলাভাই চারিদিকে হাতাহাতি, ছুটাছুটি করে কয়েকটা পানির বোতল যোগাড় করে ফেললো। দু’বোন জবা আর চামেলি মহা আনন্দে ফুল আর দূর্বায় পনির ছিটা দিতে লাগলো, জবার কান্না এতক্ষণে থেমে গেছে। দুলাভাই  অস্থির ভাবে পায়চারি করতে করতে দেশ আর জাতির সময় জ্ঞান এর উপরে বিরাট এক বক্তৃতা দিয়ে ফেলল, শ্রোতা ওই জবা আর চামেলি।

অবশেষে প্রতীক্ষার অবসান হলো, ঘোষণায় জানা গেলো প্লেন এইমাত্র ল্যান্ড করেছে। দুলাভাই সবাইকে তাড়াতাড়ি প্রস্তুতি নিতে বললো, কারও যেন ত্রুটি না হয়  সবাই ঝটপট লাইন দিয়ে দাড়িয়ে পড়লো, দূর্বা ঘাস আর ফুলের মালা থেকে তখনও পানি চুয়িয়ে পড়ছে। সবাই উন্মুখ হয়ে খুঁজতে থাকলো তাহেরকে, এক এক করে সবাই বেরিয়ে আসছে। প্রথম দেখলো জবা, সে চেঁচিয়ে উঠলো “ঐ তো মামা” ।  ঐ তো তাসের ,কিন্তু সাথে উনি কে? বৌ কোথায়, এতো দেখছি এক কালো মহিলা, নিগ্রো। দুলাভাই ধপাস করে বসে পড়ে অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো “ আমি আগেই বলেছিলাম এর মধ্যে এক ঘাপলা আছে”।