গ্রহণ-গ্রন্থি

লেখক: লুৎফুল হোসেন Category: ছোট গল্প (Short Story) Edition: Dhaboman - Winter 2020

 
 

। এক ।

হাত বাড়িয়ে রোদটাকে ছোঁবার চেষ্টা করে প্রসূন। বিছানায় স্পষ্ট একটা আলোর সীমানা গড়ে নিস্তেজ সূর্যালোক ছড়িয়ে আছে অনেকখানি জায়গা নিয়ে। পাশের বাড়ির মেহগনি পাতাদের অলস নড়াচড়া সেখানটায় ধীর একটা ঢেউ তুলছে। অনেকটা দূরবর্তী জাহাজের আলোর মতো। বিন্দু থেকে প্রখর হতে পালা করে যৎসামান্য উজ্জ্বল ও ফিকে হচ্ছে ফিরে ফিরে। ওই দিকে তাকিয়ে অনির্দিষ্টে দৃষ্টি হারাতে থাকে প্রসূন। আনমনে বাঁ হাতের আঙুলগুলো বুলায় বিছানার গায়ে, চাদরের মিহি স্পর্শ মাখে।

কিং সাইজ বেডে অসমতলে মেলে থাকা পাতলা কমফোর্টারটা ছড়িয়ে আছে হাতের নাগাল থেকে একটু দূরে। বিছানার এই খালি অংশটায় রাতভর দখল নিয়ে পাশে ছিল ঐশী। তার ফেলে যাওয়া গন্ধটা এখনো প্রখর। অন্য কোনো দিনের মতো আজও সে উঠে চলে গেছে তার নিজস্ব নিয়মে। যাবার সময় প্রসূনের ঘুমন্ত হাতটা মুঠির মধ্যে পুরে বুকের কাছটায় চেপে ধরেছিল। কপালে একটা চুমু খেলো যখন, আধো ঘুমে চোখ খুলে দেখেছে তখন একবার। স্নান সেরে পরিপাটি, নিজেকে গোছানো শেষ। বন্ধুদের সঙ্গে কোথাও ব্রেকফাস্ট আড্ডায় যাবে। এটুকু জানা ছিল। উঠে যাবার মুহূর্তে পিছু টেনে এনে ঠোঁটে একটা আলতো চুমু ফিরিয়ে দিতেই হেসে উঠে বলল, ঘুমটা ভাঙিয়েই দিলাম!

কথা আর নীরবতার অনিয়মে এই এক রুটিন ওদের। এমন রাতগুলো কেটে যায় এক নিমেষে। সকাল হলে টের পাওয়া যায়, জীবন থেকে খসে গেল আরো একটা স্বর্গ সন্ধানী চাঁদ। না শৃঙ্গার, না অরগ্যাজম। ওসব তো দূর। দুজনের কারোরই তাড়া নেই যেন এমন কিছুর জন্য। অথচ এরকম সবকটা রাতে গন্তব্যের এফোঁড় ওফোঁড় কিছু একটা আকাঙ্ক্ষা বুকের ভেতর নিয়েই হয়তো ওরা এক হয়।

সম্পর্কের দৈর্ঘ্য খুব বেশি দিনের নয়। তবুও তো প্রায় দুই বছর পেরোল চেনা থেকে ঝট করে বুনে তোলা নৈকট্যের। এর মধ্যে শুধু দুই কুড়ি রাত। এক শহরে থাকলে গল্পটা হয়তো হতে পারত অন্য রকম। কিন্তু যা হয়েছে, সেটাকে কোনো একটা রকমের ফরম্যাটে ফেলতে যে কেউই হিমশিম খাবে। তবু এভাবেই তো কেটে গেল এটুকু সময়!

সোফার সামনে থেকে খানিকটা ঠেলে পাশে সরানো সেন্টার টেবিলে লং আইল্যান্ড আইসটির স্মৃতি আঁকড়ে এক জোড়া পাম ট্রির মতো পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে টল গ্লাস দুটো। প্রিয় স্ট্রং ককটেলটার এই এক সুবিধা। বারবার পানীয়ের জোগাড়যন্ত্রে নজর দিতে হয় না। আড্ডা চালাতে চালাতে দু-দুবার ভরে নিলেই সময় গড়িয়ে যায়। ড্রিংসের মেন্যু বুঝে মাপমতো পছন্দ মিলিয়ে আগে থেকে তৈরি করে রাখে প্রসূন। শুরু থেকে শেষ, সারাটা সময় কথার সমুদ্র ঢেউ তুলতে থাকে। তরলের উচ্চতা কমতে কমতে দুবার তলানিতে আসতে রাত গড়ায়, চোখও ভারী হয়। এরপর বিছানায় এক হয়ে থেকে নিরাবরণ গায়ে গা মাখিয়ে উষ্ণতা ভাগাভাগির ফাঁকে তাদের কথার ফুল ফুটতেই থাকে, ফুটতেই থাকে। হ্যাঁ, নীরবতাও সেই সব সংলাপের একটা গাঢ় ও দীর্ঘ অংশ। তখন ওরা হয়তো একে অন্যকে পড়তে থাকে। অবিরাম এমন নৈঃশব্দ্য পড়াটা বোধ হয় সাত জনমেও শেষ হবে না তাদের।

এমন রাতগুলোতে আরো একটা অনুষঙ্গ থাকে। কিছু একটা চলতে থাকে ব্লু-রে প্লেয়ারে। কোনো গান, কোনো মুভি। কাল যেমন চলছিল ‘আ রুম উইদ আ ভিউ,। শেষ দৃশ্যের কিছুটা আগে ওটা থমকে আছে এখনো।

 

। দুই ।

 

সাইলেন্ট ফোনটার বাতি জ্বলা-নেভা দেখে তাকাতেই কলটা থেমে গেল। এক ঝলকের দেখায় নামটা উবে যাবার আগে পড়ে ফেলতে পারা গেল। ট্যান। টিএএনআইএসএইচএ। তানিশা থেকে ট্যান।

ন'টা না বাজতেই এই ছুটির দিনে! দেখতে না দেখতে আবারো বাতি জ্বলে উঠতে অনিচ্ছায় ঝুঁকে এগিয়ে বেডসাইড থেকে তুলে আনল ফোনটা।

 

: হ্যালো! এমন সাতসকালে!

: নটা বাজল প্রায়। সাত কোথায়!

: কেসটা কী? বলে ফেলো।

: তুমি কি ফ্রি? একা বাসায়, না অকুপাইড আছো!

: এখন একা। সারা দিন একা।

: তাহলে ভাগার জন্য প্যাক করো। এগারোটায় আসছি।

: সৌম্য তো জুরিখ গেল তার টিম নিয়ে।

: হ্যাঁ, ফিরেছে গতকাল।

: এইসব মন্ত্রী-সাংসদ নিয়ে এসে আমার দুই বেডের ছোট্ট বাসাটাকে কোন এজেন্সির নজরে যে ফেলছো! কে জানে!

: অতো লেকচার না কপচে তাড়া করো চান্দু।

: তাড়া যেভাবে লাগিয়ে রেখেছো! আজ হোমরা, কাল চোমরায়! তোপের মুখে কোনো দিন যে উড়ে যাব, আমি সামান্য কলম পেষা লোক।

: হয়েছে। বাকোয়াজি থামাও।

: কাজের কাজ তো আমার ওই এক। গৃহত্যাগী হওয়া। কাল বললে পারতে। সকালের আয়েশটায় পানি ঢেলে দিলে।

: হয়েছে। আয়েশ কম হয়নি। মেয়েটার তো মাথা গুলে খেয়েছো। আমি জানি ঐশী এসেছে ঢাকায়। তাই কনফিউজড ছিলাম। রাখলাম। বাই।

: তুমি কটা মাথার মুড়ো করো রোজ!

 

রেখে দিয়েছে শেষ কথাটুকু শেষ না হতেই। ট্যানের এখন লম্বা সময় দরকার সাজিয়ে গুছিয়ে নিজেকে তৈরি করতে। এমনটাই স্বভাব। গ্রসারি করতে গেলেও তার ভেবেচিন্তে তৈরি হতে হয়। সৌম্য তো তার একই সঙ্গে রোদ আর বৃষ্টি, রাগমোচন আর শাপমোচন দুই-ই। ভার্সিটি দিনের না ফোটা প্রেম শরীরের সমুদ্রে ছেনে তোলা, কন্ট্রাক্ট আর কমিশনের কেস পাকিয়ে ওঠানো। সিঙ্গেল বন্ধুর বাসায় আড্ডাটা ভালো ক্যামোফ্লেজ।

 

। তিন ।

কিছুটা বিরক্তি নিয়ে উঠে রুমটা ভদ্র করতে করতে ভাবছিল প্রসূন। ক্যাম্পাসে একসময় টান ছিল ট্যানের প্রতি। তারও কম ছিল না। সৌম্য বরাবরই মাঝখানে ছিল দেয়াল হয়ে। দুজনই বুঝত। ট্যান এগুতো না, প্রসূন দ্বিধার দেয়ালে পা ঝুলিয়ে বসে থেকেছে পুরোটা ভার্সিটি জীবন। অবশ্য ওই আমলে রাজনীতি আর লেখক আড্ডার নেশাটাই চড়া ছিল। নইলে যে কোনো খরস্রোতায় নৌকা ভাসান তো দেয়া যেতোই।

কোনো কিছুতে টিকি নাই সৌম্যই বাপের দাপটে অকম্মা থেকে ডাকসাইটে এমপি-মন্ত্রী পদ বাগিয়ে গাড়ি দাপিয়ে পতাকা নাচায়। প্রসূন আটকে আছে কলম আর দ্বিধার বৃত্তে। ট্যানই অবশ্য মাঝেমধ্যে জোরজার করে কিছু প্রজেক্ট এনে তার মুঠিতে গুঁজে দিয়ে যায়। তা না হলে এই ছোট ফ্ল্যাট আর লেজ কাটা সিডানটা পর্যন্ত যাওয়া হতো না অ-বৈষয়িক প্রসূনের।

দেখতে দেখতে সবাই যখন সিঁড়ি ছেড়ে এলিভেটরে জীবন এলিভিয়েট করে নিল। প্রসূন তখনো কয়লাবিদ্যুৎ প্রজেক্টের ভয়াবহতা, শিল্প খাতে এক্সপ্লয়েটেশন উবে গেলে বিকল্প পন্থা না হলে যে মুখ থুবড়ে পড়বে রপ্তানি, ফরেক্স রিজার্ভের অবদান বুঝেও আজ অবধি প্রবাসী শ্রমিক শ্রেণির কোথাও কোনো হেল্প বুথ না থাকার অবিমৃশ্যকারিতা, গভীর সমুদ্রবন্দরের ভাবনায় পিছিয়ে পড়ায় দেশ যে আটকে গেল চোরাবালিতে; এইসব জ্ঞানচর্চার বুলি কপচে আর দু-দশটা গল্প-কবিতা-উপন্যাসের বই সাজিয়ে ক্যারিয়ারের গায়ে ঝাড়বাতি লাগাতে কসরত করেই যাচ্ছে।

না পারল বিল্পবী হতে, না হলো পুরস্কারে রঙিন লিখিয়ে। না হলো হাফিজের মতো শৌখিন জিগোলো। ভিতরে কোথায় যে তার এত বিবেক আর দেশপ্রেমের  দড়িদড়া আগলানো খুঁটি! সাড়ে চার দশকের জীবনে আজো আবিষ্কার করা হয়নি সেসবের সমুদ্রতল।

কাল সন্ধ্যার গায়ে গায়ে অফিস থেকে ঘরে ফিরবার মুখে ইমরান পথ আগলে বলছিল, কি হে বিপ্লবী! স্টিয়ারিং আর এক্সেলেটরেই সমাজতন্ত্র আটকে ফেলেছো বুঝি! তাড়া ছিল ঘরে ফেরার। বেশ বিরতিতে এমন অপেক্ষার সন্ধ্যায় যেমনটা তার থাকে। পরে কথা হবে খোলনলচে খুলে। এইটুকু বলবার পর বলেছিল, এখন রিকশাওয়ালা থেকে ব্যাংক-বীমাওয়ালা কেউই এক দিন কি এক ঘণ্টার জন্যও নিজের ইঁদুর দৌড় থামিয়ে পথে নামবে না তার নিজের ভাইবোনটির জন্যেও। আগে তো এই ছক উল্টে দিতে হবে। তারপর কিছু হওয়া না হওয়ার সম্ভাবনা।

 

। চার ।

টুংটাং শব্দ হতেই দরোজা খুলে দেখে ট্যান দাঁড়িয়ে আছে অপ্সরীর মতো। কে বলবে তার বয়স পঁয়তাল্লিশ! ত্রিশ-বত্রিশ ঠাহর করতেই সংশয়ে আটকে যাবে যে কেউ। একটু কি আফসোস হয় ভেতরে ভেতরে!

আপন মনে হেসে ওঠে প্রসূন। দেখে লহমায় পড়ে ফেলে ট্যান। চোখের  ভেতর ঘূর্ণি উড়িয়ে বলে ওঠে, এই রাতের পরও চোখেমুখে অতো প্রেম ঝিলিক মারছে। বিষয়টা কি!

ভেতরে কিঞ্চিৎ আড়ষ্ট হলেও মুখের হাসিটা আরো চওড়া হলে, হো হো করে হেসে ওঠে প্রসূন। ট্যানের ভেতরটা ছলকে ওঠে। সেই হাসি। বুক কাঁপত। অবশ্য কেঁপেই গেছে শুধু। হাসিটা অমন কমই হাসে প্রসূন, সেই আদি থেকে।

হয়েছে হয়েছে। আর পেপার স্প্রে কোরো না। কোথায় আলসেমিতে জাবর কাটব ছুটির দিনটায় আয়েশে ঘরে বসে! সেই সাধে দিলে জল ঢেলে। বসে শান্ত হও। সাজানো বাগান সাজানোই থাক। তছনছ করবার লোক এই এলো বলে।

হয়েছে হয়েছে। ঝড়ের রাতের পর এইসব বুলি কপচিও না। আমি এসে থাকব বললে তো সন্ধ্যায়ই পালাতে।

বলার কোনো মানে হয় না। তবুও বলি। আমাদের প্রতিটা ইঞ্চি পরস্পরের চেনা, তবু কোনো দিনই আমরা শেষ সীমানায় পৌঁছুতে চাইনি। চাইলে হতেই পারত। দুই কুড়ি না দুই শ বারই। ব্যাপারটা তোমার কাছে অবিশ্বাস্য না হলেও দুর্বোধ্য ঠেকবে, আমি নিশ্চিত। কিন্তু এটা এমনই। এমনটা আমরা চলতে দিচ্ছি বলেই এটা এমন থেকে গেছে। হয়তো পরস্পরের ছুঁয়ে থাকা, পুনঃপুন পুনরাবিষ্কারের মতো একটা কিছুতে আমরা অর্গ্যাজমের চেয়েও বেশি কিছু পেয়ে যাচ্ছি। বিষয়টা আমার কাছেও হেয়ালির মতো লাগে কখনো কখনো। আমি বুঝে উঠি না আমাদের ভয়ংকর অপ্রতিরোধ্য টানটার কেন্দ্রবিন্দু কোথায়! বুঝতে অবশ্য যাই না বেশি। কারণ এটা মরমে মরমে বুঝে গেছি যে, এ সম্পর্কটায় অনুভূতির সূত্র বোধের অপার কোথাও লুকিয়ে আছে অধরা হয়ে। হয়তো ওটাই এত বেশি তীব্র করে রেখেছে টানটাকে।

বেশ। প্রেম বিষয়ে একটা বারমুডা হয়েই থাকো তোমরা। অবিশ্বাসের কিছু নেই। আমি তোমার সাত সমুদ্র তেরো নদীর খবরই জানি। তুমি সব সময়ই অকপট। সো অবিশ্বাসের কোনো প্রশ্ন এখানে নেই। তবে সত্যিই দুর্বোধ্য!

তাহলে এবার ফুটি। কাবাব মে হাড্ডি হবার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।

ওকে হানি। বলে তানিশাও উঠে আসে দরোজা অবধি। লিন্ডা ইভানজেলিস্টাররে মতো লঘু পায়ে মিহি শাড়ির আঁচল উড়িয়ে আসতে আসতে পাকা বাচিক শিল্পীর মতো অনুচ্চ স্বরে সলিলোকির ঢঙে সে বলতে থাকে-

‘ভাসান যে দাও

তারে কি জানাও

কোথায় জোছনার ভাও

কোথায় চান্দের নিজ গাঁও’

দরোজা পেরিয়ে লিফটমুখো হতে গিয়ে চমকে যায় প্রসূন। ওর পুরোনো লেখার সেই লাইনগুলো আজো কি অবলীলায় আউড়ে গেল তানিশা!

 

হাতটা ঢেউয়ের মতো দুলিয়ে বাই বলতে বলতে লিফটের বাটন টিপে দাঁড়ালো। অন্যমনস্কতায় কয়েক কদম উল্টো দিকে হেঁটে করিডর সীমান্তের কাচ গলিয়ে নিচে তাকাল। সম্বিত ফিরল তখনই, সৌম্য গেটের বাইরে গাড়ি ছেড়ে ভেতরে ঢুকছে।

লিফট বাদ দিয়ে খুব ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নামতে পা বাড়ালো প্রসূন। এখন দেখা হোক, অনিচ্ছার কুশল বিনিময় হোক, এমনটা চাইছে না সে একটুও।

 

। পাঁচ ।

অতনুকে ফোন করল সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে। শোন, ব্রেকফাস্ট করেছিস? ওকে, তাহলে চলে আয় স্কাই টোয়েন্টি ওয়ানে। গ্রাস টার্ফের রুফ টপে। বাটারমিল্ক প্যানকেক উইদ ফ্রুটস, সাথে ক্যানাডিয়ান মেপল সিরাপ। শেষে এক্সট্রা লার্জ আমেরিকানো। ব্রেকফাস্ট অন মি। দোস্ত, জাম্প ইনটু ইয়োর ট্রাউজারস অ্যান্ড রাশ। তোর বাড়ির ছাদ থেকে লাফ দিলেও পারিস। ইউ ডোন্ট নিড টু ক্লাইম্ব ডাউন অ্যান্ড টেক আ ওয়ক, ম্যান। আমার বড়জোর পনেরো মিনিট লাগবে। ছুটির দিন সকাল বলে কথা।

ইগনিশন চাপিয়েই প্লেয়ারটা চালু করে দিল প্রসূন। ধীরেসুস্থে গেট পেরিয়ে গাড়িটা নিয়ে রাস্তায় না নামতেই বেজে উঠল, ডেভিড গিলমোর আর রজার ওয়াটার্সের লেখা, পিঙ্ক ফ্লয়েডের গলা। উইশ ইউ ওয়্যার হিয়ার। ভাসিয়ে নেবার আগেই একটু সামলে নিল নিজেকে। সামান্য ট্রাফিকের অলস পথে পাঁচ মিনিট বাড়তি সময় নিল পৌঁছাতে।

অতনু নিচতলার লবিতেই বসে ছিল। না অধৈর্য হয়নি। ঘুম ঘুম ভাবটা কাটাতে বরং একটু কাজেই লেগেছে বুঝি বাড়তি সময়টা। সোজা একুশ তলার ছাদে। রুফটপ ওপেন এয়ার রেস্টুরেন্ট। দূরে দুই পাশে দুই টেবিলে দুই গ্রুপ বসে আছে কিছুটা অগোছালোভাবে। তার মানে আর্লি রাইজারস। নাশতার পালা শেষ।

ঢুকবার প্রান্তেই নিরিবিলি কোনায় একটা টেবিলে বসে পড়ল ওরা। অর্ডার করে একে অন্যের পেছনে কপট আক্রমণ শানিয়ে শুরু। এ রকম অর্থহীন এলোমেলো আলাপই চলবে দুই বন্ধুতে। এমনটাই চলে। তিরিশ বছরের সখ্য। একজন গোছানো সংসারি, অন্যজন আধুনিক নগর বাউল। হয়তো কেমিস্ট্রিটা ভালো জমে দুজনে এ জন্যই।

আলাপ চলছিল রাজনীতির বন্ধ্যা সময় নিয়ে। কেন এই তিন দশকে একজন নতুন নেতাও জন্মালোনা এ দেশে। এমন কি খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনা থেকেও উঠে এল না নিদেনপক্ষে অন্তত একজন।

খাওয়া টেবিলে সার্ভ করতে না করতে লেগে পড়ল দুজন। প্যানকেকটা ঠাণ্ডা হয়ে গেলে এর স্বাদ কিছুটা হলেও বিগড়ে যায়। নড়েচড়ে বসা আর খাওয়া শুরু করার মধ্যে বেয়ারা সরে যেতে চোখে পড়ল অন্য প্রান্তের বড় টেবিলটায় সবাই উঠে দাঁড়িয়ে বেরিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। হ্যাঁ, উল্টোদিকে মুখ করে দাঁড়ানো, মাইল্ড অলিভ গ্রিন শাড়িটা সামলে ব্যাগ গোছাচ্ছে ঐশী। বাকি পাঁচজনের চারজনই মেয়ে। ওর পুরোনো বান্ধবীরাই হবে। সফট মাস্টার্ড কালারের সামার স্যুট আর লাইট ব্রাউন ট্রাউজার পরা পঞ্চমজন রবিন। চকচকে চৌকো মুখচোখ থেকে তার খুশি ছলকে উঠছে। গেল বছর বিয়ের কথা হচ্ছিল ঐশীর সঙ্গে। বাবা-চাচা দুজনের পছন্দের পাত্র। ঐশী এড়িয়েই যাচ্ছিল। বিয়ের বয়স পালাচ্ছে না, এসব ছুতায়।

অকপটে বলেছিল ঐশীই। প্রসূন শুনেছে। একবার শুধু হাসতে হাসতে বলেছিল, ওয়ান্স ম্যারেড পাত্র তো আর বাসায় মেনে নেবে না নিশ্চয়। বাবাকে কষ্ট দেয়াটাও তোমার দুঃসাধ্য একটা ঝক্কি। নিজেকে ঠকিয়ে আর কত দিন পার করবে! বিষয়টা ভাব। প্রত্যুত্তরে ঐশী দীর্ঘক্ষণ শুধু চুপ হয়ে ছিল। আর কথা বাড়ায়নি প্রসূন। ওই প্রথম, ওই শেষ। মাঝে একবার শুধু টেক্সট এক্সচেঞ্জের সময় লিখেছিল, ‘চাচা খুব লেগে আছে। এখন মা-ও যোগ দিয়েছে। বাচ্চাকাচ্চা, সংসারের নৈমিত্তিক জীবনটা তো আমি কখনোই চাইনি। ভাবিওনি। এসব খুবই জ্বালাচ্ছে। তোমার কাছে আসব আমি এ সপ্তাহটা গেলেই।’ ব্যাস। তাও প্রায় সাত মাস আগের কথা।

 

। ছয় ।

চোখের সামনে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। বাহুর পাশ থেকে উপচে আছে ঐশীর স্তন। বাদামি বৃন্তটা কথার ঝাঁকুনিতে মাঝে মাঝেই প্রসূনের হাতে এসে টোকা দিয়ে যাচ্ছে। চুলের গন্ধ নাক ডুবিয়ে নিচ্ছে সে চোখ বুজে। মুখোমুখি শুয়ে অন্য হাতটায় আগলে আছে খোলা পিঠের উপত্যকা। থেকে থেকে আঙুলগুলো হেঁটে যাচ্ছে কটির বাঁক ঘুরে নিতম্বের স্ফীত উষ্ণতায়। টুকরো টুকরো কথায় তখন তন্দ্রার হাতছানিতে মেঘের ভেলায়। খুব করে কাছে টানতেই হঠাৎ কেমন অন্য রকম হয়ে উঠেছিল ঐশী। এত দিনের বরফ ভেঙে হয়তো শেষ দরোজাটা খুলতে চাইছিল। দ্বিধান্বিত রাতের শেষ প্রহর ওভাবেই একসময় টুকরো নিদ্রায় হারিয়ে গিয়েছিল।

অতনুর ডাকে সম্বিত ফিরল যখন, ঐশীর আঁচলটা মিলিয়ে গেল দৃষ্টির বাইরে। বুঝে উঠল না, ও কী দেখেছে! যদিও কোনোভাবেই আজ প্রসূনের বাইরে ব্রেকফাস্ট করতে আসার কথা না। ভাবনাতেই আসবে না- এখানে একই ফ্লোরে জনাকীর্ণ রুফটপে অন্য টেবিলে প্রসূন বসে থাকবে। অসমাপ্ত প্যানকেক রেখে ডাবল স্ট্রং আমেরিকানোর তেতো স্বাদে চুমুক দিতে দিতে গা ছেড়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল সে। অতনু উল্টোমুখ হয়ে বসা। খাচ্ছে এক মনে। তার মানে দেখতে পায়নি। ঐশীও মনে হয় না দেখেছে।

কয়েক চুমুকে বড় কফি মগটার ধোঁয়া ওঠা তরল মাঝামাঝি আসতেই ফোনটা মৃদু শব্দ করে উঠল। মেসেজ বক্সে ভেসে আছে তিন অক্ষরের একটা নাম। শী। ঐশীকে ওই নামেই টেক্সট করে প্রসূন।

‘দুপুরের ফ্লাইটে ফিরে যাচ্ছি। পরে কথা হবে।’

বাড়ন্ত দিনের বাড়তি কোলাহল ছাপিয়ে দিতে গার্ডেন স্পিকারে তখন একটু উঁচু স্বরে বাজছে ‘দ্য ল্যুমিনারস’-এর ‘স্লিপ অন দ্য ফ্লোর’।

গানের আড়ালে মিইয়ে যাওয়া শব্দে আবার আলো জ্বলে উঠলে মেসেজ স্ক্রিনে ভেসে ওঠে এক জোড়া শব্দ। শী লিখেছে।

‘তুমি জানতে!’

 

লেখক পরিচিতি: মূলত কবি, তবে গল্প ও প্রবন্ধ লেখেন। রচয়িতা নামে অধুনা প্রতিষ্ঠা করেছেন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। জাতীয় কবিতা পরিষদের সূচনাকালীন সক্রিয় তরুণ। অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সর্বশেষ গল্পগ্রন্থ যদ্যপি প্রেম যদ্যপি প্রণয়।