বেল্ট কাহিনী

লেখক: কাজী আহমদ পারভেজ Category: ছোট গল্প (Short Story) Edition: Dhaboman - Fall 2017


– তোমার কলারের মাপ কত?
– ষোল। কেন, শার্ট কিনতে চাও বুঝি আমার জন্য? তাও ভাল, বেঁধে রাখার জন্য কোন বেল্ট কেনার কথা ভাব নাই। যেভাবে সময় সুযোগ পেলেই তোমার চারপাশে ঘোরাঘুরি করছি আজকাল, প্রভুভক্ত কুকুর ভেবে বসাটাও অন্যয় ছিল না। আর তাই মাপ জেনে গলায় পরানোর বেল্ট যোগাড় করাটা ভুল কিছু হতো না কিন্তু, কি বল?
– দুষ্টুমি হচ্ছে, না? নিজেকে কুকুর ভাবো বা অন্য কিছু, আমাকে ঘিরে তোমার এই সার্বক্ষনিক ঘুরঘুর করাটা কিন্তু দারুন এনজয় করছি। অনেকদিন পর, দারুন কিছু সময় কাটছে তোমাকে ঘিরে। তাই ভাবলাম কিছু একটা উপহার দেই তোমাকে। কিন্তু তুমি জানি কেমন। একটি মেয়ে উপহার দিতে চাইছে, ভদ্রতা করে একটা না-টা তো বলতে পারো। তা নিয়ে কিছু খুনসুটি চালানো যেতো তখন। তা না, একবারেই বুঝে গেলে কেন মাপ চাইছি, আর সাথে সাথেই রাজিও হয়ে গেলে উপহারটা পেতে। এইটা কিছু হলো?
– দেখো রিতু, এইটা হলো আমার ক্যাডেট কলেজে পড়ার আরেক ডিসএডভান্টেজ। যেকোন কথার সোজা মানে করা। একটু আঁকাবাঁকা অর্থ করে যে সময় সময় লাইফটাকে স্পাইসড-আপ করা যায়, কেন যেন তা মাঝে মাঝে মাথায় খেলে না। আমি বরং তোমার মাপ চাওয়াটা শুনেই শার্ট উপহার পাবার সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে ভাবা শুরু করে দিয়েছিলাম। তাই আর ঐ না না বলে খুনসুটি করার কথাটা মাথায় খেলে নাই।
– তো, কি ভাবলে, শুনি?
– আমি কি এতই বোকা, যে তোমার সাথে কাটাতে আসা এই ছোট্টো টাইম উইন্ডটা এখন ঐসব থিওরি কপচে নষ্ট করবো? তারচেয়ে বরং যে ঘন্টাখানেক সময় হাতে পাচ্ছি, চল তার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করি। আমাদের এই অবস্থাটাকে ঘনিষ্টতা বল বা সম্পর্ক, ক’দিন তা থাকে তার তো কোন ঠিক-ঠিকানা নাই। যে কদিনই থাকুক, আসো এটার রূপ-রস-গন্ধ আরও বেশী বেশী নিতে থাকি। তোমার ঐ প্রশ্নের উত্তর রাতে লিখে রাখবো, পরে পড়ে নিও।
কথাটা বলে আর দেরী করে না সজীব। রিতুর বুকে মুখ গুজে দেয়। একটি ঘন্টা তীব্র আনন্দে কোথা দিয়ে কেটে যায়, ঠাহর করতে পারে না আর কেউই। না রিতু, না সজিব।


বাসায় ফিরে স্ত্রী রূপকথার কাছ থেকে রাত জেগে ল্যাপটপে কিছু জরুরী কাজ করার অনুমতি নিয়ে নেয় সজিব। এরপর বসে রিতুর সেই প্রশ্নের উত্তরটা দাড় করাতে। যা দাঁড়ায় তা এইরকম:
প্রিয়তমেষু:
তুমি যতই বল না কেন, তোমার এই সিঙ্গেল-মাদার ও স্বনির্ভর নারী-উদ্যোক্তা কাম হেড-হান্টার পরিচয়ে তুমি তৃপ্ত, আর আমার সাথে থাকা এই মধুর সম্পর্ক তোমাকে ভরিয়ে দিয়েছে কানায় কানায়, আমার দিক থেকে এর পরিনতি নিয়ে ভিন্ন একটা ব্যাখ্যা কিন্তু আছেই। থাকবেই।
দেখো, আমাদের সম্পর্কটা এই মুহুর্তে যত উত্তপ্ত, যত তীব্রই হোক না কেন, এর কিছু সিরিয়াস দুর্বলতাও রয়েছে। আর এই কারনেই আমার কাছে সম্পর্কটা – যেকোন সময়ে তাসের ঘরের মত হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়তে পারা একটা সম্পর্ক ছাড়া আর কিছু নয়। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, এই ভেঙ্গে পড়ার প্রক্রিয়াটার ইনিশিয়েটর হতে পারো এককভাবে তুমি, অথবা এককভাবে আমি, অথবা আমরা উভয়েই পারস্পরিক আলোচনায় ও সম্মতিক্রমে, এমন কি আমাদের বাইরে তৃতীয় এমন কোন পক্ষের হস্তক্ষেপে এটা হতে পারে, যাঁদেরকে এই সম্পর্কটা এফেক্ট করতেও পারে আবার নাও করতে পারে।
এক এক করে ব্যাখ্যা করি সবগুলো, এবং আগে সবচেয়ে দুরবর্তিটা দিয়েই শুরু করি।
আমাদের এই অদ্ভুত সম্পর্কটা যাঁদের কোনভাবেই এফেক্ট করে না, ধরো তোমার আমার বন্ধুরা, তাঁদের কাছেও কি আমরা এখন পর্যন্ত এই সম্পর্কের কথা বলতে পেরেছি?
না, পারি নাই। কেন পারি নাই? কারনটা খুব সহজ। একজন আত্মনির্ভর ক্যারিয়ার উওম্যান হয়েও তোমার অস্বস্তি হয়েছে, ওরা কি ভাববে – সেটা ভেবে। তুমি সিঙ্গেল মাদার এবং মধ্য ত্রিশে থাকা স্বাধীন নারী যে অন্যের জীবন ক্যারিয়ার নিয়ে বড় বড় সিদ্ধান্ত নেয়। তাঁদের ভবিষ্যৎ ঠিক করে দেয়। তারপরেও যত ভাললাগাই জড়িয়ে থাকুক না কেন, তুমি এমন কোন সিদ্ধান্ত নিতে পার না – যা বন্ধুদের চোখে “ভবিষ্যৎ নেই” বলে মনে হয়। রড স্টুয়ার্টের “ইফ লাভিং ইউ ইজ রং…” গানটার কথা মনে পড়ছে। ঐ গানের দুটো কলি “ইওর ফ্রেন্ডস টেল ইউ, দেয়ার’স নো ফিউচার / ইন লাভিং এ ম্যারিড ম্যান…”।
সম্পর্কের সুখ যদিও প্রধানতঃ নিজের জন্য, তারপরেও এমন অনেকেই থাকে যাদের সাথে বিষয়টা শেয়ার করতে না পারাটা কষ্টের। তাই যতদিন ভাল লাগছে, ঠিক আছে, একটা সময়ে কিন্তু এই কাউকে না বলতে পারাটা আমাদের দুজনের জন্যই অসহ্য মনে হয়ে উঠতে পারে শুধু এই ভেবে যে “বন্ধুরা কি ভাববে?”
আমার সমবয়সি বন্ধুরা নানা প্র্যাকটিকাল কারনে হয়তো ততটা জাজমেন্টাল হবে না কিন্তু তোমার বন্ধুরা মাঝ বয়সি এক বিবাহিত লোকের সাথে তোমার এই সম্পর্কের জন্য তোমাকে করুনাই করবে। নিতে পারবে সেই করুনা? মনে হয় না। আর তাই, এই করুনা থেকে মুক্তির উপায় হয়ে দাঁড়াবে সম্পর্কের ইতি টানা।
এবার আসি এফেক্টেড হবে এইরকম তৃতীয় পক্ষগুলোর আলাপে। আমার পরিবার বা তোমার পিতা-মাতা-সন্তান যখন এই অদ্ভুত সম্পর্কের কথা জানবে, তাঁদের মাথায় এই ভেবে আকাশ ভেঙ্গে পড়বে যে এখন আমরা সমাজে মুখ দেখাবো কি করে? খুবই অস্বস্তিকর একটা নিরাপত্তাহীনতা তাঁদের ঘিরে ধরবে।
তাই যেদিন ওঁদের কাছে বিষয়টা জানাজানি হয়ে যাবে, সেইদিন আমাদের এই সম্পর্কটার ইতি টানতেই হবে। আর তা, ওঁদের কথা

ভেবেই।
এবার আসি তোমার আমার দিক থেকে কি কি সমস্যা আসতে পারে সেই আলাপে।
এই রকম অস্বাভাবিক একটা সম্পর্কে প্রথম সমস্যাই হলো উভয় পক্ষের যে কারোই সুযোগ থাকে হঠাৎ করে অতি-সচেতন হয়ে পড়ার। মানে নিজেকে এক্সপ্লয়েটেড ভাবার। ধরো তুমিই প্রথম তা হয়েছো। এর পক্ষে সচরাচর যে কারনগুলি দেখা যায় তার মধ্যে প্রধানটি হলো এটা উপলব্ধি করা যে, “এ আমি কি করছি? এখন যত উপভোগ্যই হোক না কেন ব্যাপারটা, এর গন্তব্য কোথায়?” আর গন্তব্য, তথা ভবিষ্যৎবিহীন এই ভ্রমনে তোমাকে টেনে ঢোকানোর পূর্ণ দায় তখন পড়বে নিজ সংসার সম্পর্কে সচেতনতার অভাব দেখানো দায়িত্বজ্ঞানহীন পুরুষটির, মানে আমার উপরে। সাথে সাথে এই প্রশ্নও স্বাভাবিক ভাবে তোমার মনে আসবে যে, “আমার মত মাত্র সপ্তাহ কয়েক ধরে চেনা এক নারীর জন্য যে লোক ২২ বছরের সংসার নিয়ে বাজী ধরতে পারে, ভবিষ্যতে অন্য কারো জন্য সে যে আমাকে নিয়ে বাজী ধরবে না – সেই নিশ্চয়তা পাচ্ছি কোত্থেকে? কিভাবে??”
অতএব, সময় থাকতেই সাবধান হও, হে নারী। আর সম্ভব হলে গোটাও তোমার পাততাড়ি যত তাড়াতাড়ি পারো……
কী, ভুল বললাম কি কিছু?
মজার ব্যাপার হলো, এইরকম অসম সম্পর্কে থাকা পুরুষটিরও, এইক্ষেত্রে আমার – একই রকম অভিযোগ করার সুযোগ কিন্তু থাকে আর তা উত্থাপন করার মধ্য দিয়ে একতরফাভাবে নারীটিকে, মানে তোমাকে দোষারোপ করে ডাম্প করা খুবই সম্ভব আর তা এই কথা ভেবে: “একি ডাকিনী-যোগিনীর খপ্পরে পড়লাম যে কিনা আমার বাইশ বছরে তিল তিল করে গড়ে তোলা স্ত্রী-কন্যাসহ সংসারটিকে ভুলিয়ে দিল? যে মেয়ে আরেকটি নারী, তার সন্তান, আরেকটি সংসারের অস্তিত্ব থাকা না থাকা নিয়ে সচেতন না, সে যে ভবিষ্যতে আমাকে আরও গ্রাস করবে না, অন্য কারো যোগসাযোগে আমার অস্তিত্ব বিপন্ন করবে না, সেই নিশ্চয়তা কে দেবে আমাকে?” তাই সময় থাকতেই পাততাড়ি গোটানো ভালো। বের হয়ে আসা প্রয়োজন এই মোহমায়া থেকে।
যদিও একটু বেশী তাত্ত্বিক আলাপ হয়ে যাচ্ছে, তবে যে কথাটা বলতে চাইছি তা হলো – এখন যত কাঙ্খিত, প্রেমময় বা উত্তপ্তই হোক না কেন আমাদের সম্পর্কটা, এটাও সত্যি যে দু’দিন আগে হোক বা দু’দিন পরে হোক – এর একমাত্র পরিনতি হলো ভাঙ্গন। শুধু দেখার বিষয় হলো, কবে ঘটছে তা।
ডার্লিং, আমি জানি, অচিরেই আমাদের এই সম্পর্কটা ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেবে। আর তাই, তুমি যখন কিছু উপহার দিতে চাইছো, ভেঙ্গে পড়া একটা দুর্দান্ত সম্পর্কের স্মৃতি-চিহ্ন হিসাবে সেটা নিয়ে নেয়াই হলো ঠিক কাজ।
তুমি না থাকলেও তোমার ঐ স্মৃতি চিহ্নের উপরে হাত বুলিয়ে কিছু স্পর্শ-সুখের পরশ তো পাওয়া যাবে। তবে শার্ট না। ওতে ভেজাল অনেক। প্রথমেই পরিবারের কাছে জবাবদিহিতা করা – কে দিল, কেন দিল, ইত্যাদি? এটা যদিওবা সামাল দেয়া যায়, অচিরেই শার্টটা হয়ে পড়বে পুরনো। স্মৃতি-চিহ্ন হিসাবে পুরনো শার্ট রেখে দেয়াটা মোটেও সহজ কোন কাজ হবে না।
এরচেয়ে তুমি বরং আমাকে একটা বেল্টই উপহার দাও। সারাক্ষন পরে থাকা যায় তা কারো প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই। আর ওটার দিকে তাকিয়ে ভাবা যায়, বেল্ট না – তুমিই যেন কোমর জড়িয়ে ধরে আছো আমার। অনেক যখন পুরনো হয়ে যাবে তা, মানে ব্যবহারের অযোগ্য – কোন প্রশ্নের উত্তর না দিয়েও মেটালিক পার্টগুলো স্মৃতি-চিহ্ন হিসাবে রেখে দেয়া যাবে আরও বহু বহু দিন।

লেখাটা শেষ করে দীর্ঘক্ষন খুটিয়ে খুটিয়ে পড়ে সে। তারপর সেন্ড বাটন টিপে বেডরুমে ঢোকে। ততক্ষনে রূপকথা ঘুমিয়ে কাদা হয়ে গেছে। নিঃশব্দে গিয়ে ওর পাশে শুয়ে পড়ে সজিব কারন মাথার মধ্যে তখনো যে রিতুর বসবাস। কিন্তু ঘুম আসে না চোখে। প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির হিসেব কষতে কষতে কি এক বিষাদ এসে ভর করে তার দেহে এবং মনে।


পরদিন সারাদিন ভীষন ব্যস্ততায় কাটে সজীবের। রিতুকে গতরাতে পাঠানো নোটটার কথা সেভাবে আর মনেও পড়ে না। মোবাইলে রিমাইন্ডার বেজে উঠলে খেয়াল হয়, রিতুকে আজ পারসোনার সামনে থেকে তুলে নিয়ে যাবার কথা আরেক অভিসারে। ত্রস্ত ভাবে হাতের কাজ শেষ করেই ছুট লাগায় সে। পারসোনার সামনে পৌছে কল দেয় সজিব।
– পৌছে গেছি।
– পাঁচ মিনিট, আমি নামছি।
পাঁচ মিনিটকে তার পাঁচ ঘন্টা বলে মনেহয় যখন অপেক্ষারত অবস্থায় রূপকথার ফোন পায়।
– তুমি কোথায়?
– এই তো বেরুচ্ছি। কেন?
– না মানে ঢালিতে এসেছি শপিং করতে। মনে হলো তোমার গাড়ি পারসোনার সামনে দাঁড়ানো। ভাবলাম চুল কাটতে এসেছো নাকি? শেষ হয়ে থাকলে এখানে আসতে বলতাম। আমাকে একটু কেনাকাটায় হেল্প করতে।
– একই রকমের কত গাড়ি আছে। কোনটা না কোনটা দেখেছো। যাক ওসব। আজ একটু দেরী হবে। ডিনার করেই আসবো। কোন টেনশন করো না, কেমন? বাই।
ফোন কেটে দিতেই পারসোনা থেকে বেরিয়ে আসে রিতু। সদ্য চর্চিত অবয়ব, চুল নিয়ে এগিয়ে আসা রিতুকে দেখে তার মনে হয় যেন কোন অপ্সরি নেমে এসেছে নন্দন কানন থেকে। সজিবের মনে হয় রিতু পথ দিয়ে হেটে হেটে ওর দিকে আসছে না বরং সে নিজেই এখন একটা পথ হয়ে গেছে আর রিতু ওর বুকে পা রেখে রেখে এগিয়ে আসছে ওরই দিকে। প্রতিটা পদক্ষেপ তার হৃদপিন্ডের ধ্বনির সাথে মিলে মিশে এক অবর্ণনীয় ঐক্যতান সৃষ্টি করছে যেন।
হঠাৎ সম্বতি ফিরে পায় সজিব, যখন ছুঁয়ে দেয়ার মত দুরত্বে এসে দাঁড়ায় রিতু। লক্ষ করে, ওর হাতে একটা প্যাকেট।
– এই নাও তোমার ব্রেক-আপ পরবর্তি স্মৃতি-চিহ্ন। পারসোনায় ঢোকার আগেই নীচের ঐ এপেক্স থেকে কিনলাম। মেটালিক পার্টটা ডিটাচেবল। তার মানে বেল্টটা ছিড়ে গেলেও অন্য কোন বেল্টে লাগিয়ে ব্যবহার করতে পারবে ওটা। মেটালিক পার্টে অনেকগুলো ঠোটের ছোয়াও দিয়ে দিলাম। আমরা যখন আর একসাথে থাকবো না, শুধু কোমর জড়িয়ে ধরা না, আরও অনেক বেশী কিছু মনে পড়বে এই বেল্টের দিকে তাকিয়ে। কি, খুশী তো?