দুরাবস্থার তিন অবস্থা

লেখক: শুজা রশীদ Category: ছোট গল্প (Short Story) Edition: Dhaboman - First Edition

   কোন কারন নেই, কিন্তু গত তিন রাত ধরে দু’চোখের পাতা এক করতে পারছে না রাফি। একেবারে রাত জাগা পাখী। রানী – তার স্ত্রী, তার নাম দিয়েছে হুতোম প্যাঁচা। সারা রাত তার নড়া চড়ায় রানীরও ঘুমের খুব ব্যাঘাত হচ্ছে। সে অসম্ভব চেতে আছে। ছেলেমেয়েরা সকালে স্কুলে যায়। রানীকে ভোরে উঠতে হয়। ভালো ঘুম না হলে তার মাথা ধরে।

কাজে গিয়েও সমস্যা। কম্পিটার প্রোগ্রামিং করে। একটা নতুন এপ্লিকেশন লিখছে। মোক্ষম একটা জায়গায় গিয়ে আটকে গেছে। সহজ ব্যাপার কিন্তু কিছুতেই কাজ করছে না। শালার প্রোগ্রাম সেই যে ঘাড় ত্যাড়া করেছে, হাজার কারসাজি করেও তাকে আর সিধা করতে পারছে না। ভাবতে ভাবতে মাথার দোষ দেখা দেবার অবস্থা। ম্যানেজার ঘন্টায় দু’বার করে তাগাদা দিচ্ছে। যেন তাকে উত্যক্ত করলেই প্রোগ্রাম কাজ করতে শুরু করবে। মনে মনে নানা জাতের অকথ্য গালি দিচ্ছে রাফি। ম্যানেজারকে কিছু, প্রোগ্রামটাকে বেশী, নিজেকেও দু’ চারটে। শালা গবেট!

গভীর মনযোগ দিয়ে কোড চেক করতে করতে হয়ত শেষ দিকে দু’চোখের পাতা একটু লেগে এসেছিল, তখনই ব্যাটা ম্যানেজার এবং ফোনের রিং দু’টোই একসাথে গর্জে উঠল।

“রাফি, শরীর ভালো আছে তো?” ম্যানেজারের প্রশ্ন।

রাফি ফোন ধরল। একে তাড়ানোর এটাই একমাত্র উপায়। “গুরুত্বপূর্ণ কল। ধরতেই হবে। শরীর ভালো।চোখ বুজে চিন্তা করছিলাম। ঘুমাচ্ছিলাম না।”

ম্যানেজার লোকটা মাঝ বয়েসী। অবিশ্বাস ভরা দৃষ্টীতে তাকে দেখে অনীহা নিয়ে সরে গেল।

রাফি ফোন কানে লাগাল। মা। ঢাকা থেকে। বাবা বছর পাচেক আগে মারা যাবার পর মা একাকীই থাকে। রাফির দুই ভাই আছে, তারা বহুতল বাড়ীর দু’টি তলা দখল করে পরিবার নিয়ে বসবাস করে। মা থাকে একটিতে কাজের বুয়া এবং ড্রাইভার নিয়ে। বাকী দু’টি তলা ভাড়া দিয়ে মায়ের চলে। ভাইয়ের বউদের সাথে মায়ের দাঁ কুমড়ো সম্পর্ক। পরস্পরের নাম শুনলেও তারা তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে।

রাফির গলা না শুনে মায়ের মেজাজ খারাপ হল। “কি রে? ফোন ধরে ঘুমিয়ে গেলি নাকি? কথা বলিস না কেন? এতো বয়েস হয়েছে এখনও স্বভাব পাল্টায়নি।”

রাফি একটা দীর্ঘ্নিঃশ্বাস ছাড়ে। এই হচ্ছে তার মা। খোচা না দিয়ে যে একটা বাক্য সম্পূর্ণ করা সম্ভব এটা তার জানা নেই। এই বিশাল পৃথিবীতে মনে হয় হাতে গোনা দু’টি মানুষ যারা তার প্রতি প্রীত – একজন মা নিজে, অন্যজন রাফি। বাবা স্ত্রীকে ভালোবাসতেন। রাফিও মাকে ভালোবাসে। মেজাজ ঠিক রেখে তার সাথে দু’মিনিটের বেশী বাক্যলাপ করা দুঃসাধ্য কিন্তু তারপরও সে মাকে ভালোবাসে। সে সর্বক্ষন নিজেকে স্মরণ করিয়ে দেয় কত কষ্ট করে মা তাকে বড় করেছেন। মায়ের সেই ঋন কখনও শোধ হবার নয়।

“ঘুমাই নি মা। উলটো পালটা কথা বল কেন?” সে সহিষ্ণু কন্ঠে বলে। “আমার ম্যানেজারের সাথে কথা বলছিলাম।”

“একদম মেজাজ দেখাবি না,” মায়ের পালটা তেজ। “বেয়াদপ ছেলে! মায়ের একটা খোজ খবর পর্যন্ত নিস না। আমাকে ঠেলে ঠেলে ফোন করতে হয়।”

“তোমাকে না দু’দিন আগেই ফোন দিলাম?” বিরক্ত কন্ঠে বলে রাফি। তার বয়েস হয়েছে চল্লিশ। মা ভাব দেখায় যেন সে এখনও চার।

“দু’দিন? গুনতে ভুলে গেছিস নাকি? গাধা! আটদিন আগে ফোন দিয়েছিলি। দশ মিনিট পরে লাইন কেটে গেল। ইচ্ছে করে কেটে দিয়েছিলি। ভেবেছিস আমি বুঝি না?” মা গজরাতে থাকে।

মনে মনে প্রমাদ গোনে রাফি। “যাহ, কি যা তা বল? লাইন কেটে দেব কেন? আমাদের ফোণ লাইনে সমস্যা আছে। মাঝে মাঝে লাইন কেটে যায়। যাক ওসব। তোমার শরীর কেমন বল?”

“আমার শরীরের খোজ তোকে করতে হবে না,” মা ঝাঝিয়ে ওঠে। “তোর দুই বান্দর ভাইয়ের ব্যাবস্থা কর নইলে মায়ের মরা মুখ দেখবি।”

রাফি বিচলিত হল না। এসব নিত্যদিনের ব্যাপার। “আবার কি হয়েছে?”

“তোর কি মাথায় গোবর ঢুকেছে?তোকে তো একশ’বার বলেছি দুই ছাগল বাড়ীটার বারোটা বাজানোর চেষ্টা করছে। দেখে দেখে বজ্জাতদের বাড়ী ভাড়া দেয়, তারা সময় মত ভাড়া দেয় না। বাড়ির মেরামতের কাজ করানো দরকার, করাবে না। কাজ কর্মের নামে অষ্টরম্ভা। দুই জনে দুই তলা নিয়ে গ্যাট হয়ে বসে আছে। ভাড়া দিলে কতগুলো টাকা পাওয়া যেত ভেবে দেখেছিস?”

রাফি প্রথম বাক্যের পর আর কিছু শুনবার চেষ্টাও করেনি। এই সব কথা বার্তা তার মুখস্ত হয়ে গেছে। তার দুই অপগন্ড ভাইদের সাথে সে শেষ কবে কথা বলেছে তার মনেও পড়ে না। তাদের সাথে ইজ্জত রেখে কথা বলা দুষ্কর।

“হু, খুবই খারাপ কথা,” রাফি তাল দেয়।

“তুই তো ঐ সব বলেই খালাস। গুড ফর নাথিং!”

“মা!” রাফি রাগ দেখায়। “বাজে কথা বলবে না। আমি গুড ফর নাথিং? তোমাকে কে দেখ ভাল করে?”

“আমার কামের বুয়া,” মা সোজা সাপ্টা জানিয়ে দিল। “তুই শেষ কবে আমাকে দেখতে এসেছিলি? বছর পাঁচেক তো হবেই।”

“দুই তিন বছর হবে,” রাফি কমিয়ে বলে। দেশে যেতে তার ভালো লাগে না। বেশী ভীড়। গরম। ধুলা বালি। কোথাও কোন সিস্টেম নেই। লাগামহীন ঘোড়া।

“একদম মিথ্যে বলবি না,” মা ধমকে ওঠে। “পাঁচ বছর। তোর বাবা মারা গেলে এসেছিলি।”

কাজে ফেরা দরকার। “ঠিক আছে মা, আমি ওদের দু’জনের সাথে কথা বলব।”

“কথা বলতে হবে না,” মা জোর গলায় বলে। “তুই দেশে এসে সব ঠিক ঠাক করে দিয়ে যা।”

থমকালো রাফি। এইটা নতুন আবদার। “আমি কি করে আসবো মা? আমার চাকরী বাকরি আছে না?” রাফি সতর্ক কন্ঠে বলে।

“মা বড় বা চাকরী বড়?”

রাফি এবার চমকালো। এই জাতীয় আবেগঘন কথাবার্তা মা সহজে ছাড়ে না। সমস্যা নিশ্চয় খুবই ঘনীভূত। “শুধু তো চাকরী বাকরি না, ঘর সংসারও তো আছে, নাকি?” সে বোঝানোর চেষ্টা করে।

“সব নিয়ে আয়। ক’দিন বাচবো কে জানে? সারাটা জীবন তো দূরে দূরে থাকলি। ক’দিন এসে আমার একটু সেবা কর।” মা এক নিঃশ্বাসে বলে। “তোদেরকে জন্ম দিয়ে বড় করেছিলাম কি শেষ বয়েসে সবার লাথি ঝাটা খাবো বলে?কাজের বুয়াটা বিদায় হয়েছে, ড্রাইভার বদমাশটা সারাক্ষন বেতন বাড়াও নইলে গেলাম বলে ভয় দেখাচ্ছে। আমাদের দুই বেগম সাহেবা তো আমার ছায়াও মাড়ান না। আমি কি বিষ খাবো? বল? না হয় তাই খাই। এই জীবন নাশ করি।”

এই মরেছে! পরিস্থিতি যা ভেবেছিল তার চেয়েও খারাপ।

“কাজের বুয়া চলে গেছে?” রাফি ঢোক গিলে জানতে চায়। মহিলা দশ বারো বছর ধরে ছুটা কাজ করছিল, মাঝে মাঝে বাসায় থাকতও। খানিকটা নিজের মানুষের মত হয়ে গিয়েছিল। বলা যায় তার উপস্থিতির জন্যই মায়ের একাকীত্ব খানিকটা কাটত।

“বেটি দূর হয়েছে, ভালো হয়েছে।“ মা রাগী গলায় বলল। “একটা কাজ করতে বললে দশটা কথা শোনায়। যেন উনি বেগম সাহেবা আর আমি ওনার কাজের লোক। ঝাড়ু ছুড়ে মেরেছি তাই অহংকারে লেগেছে। দূর হয়েছে।”    

“ওকে ছাড়া তোমার চলে না। খমাখা ঝাড়ু মারলে কেন?” বিরক্ত কন্ঠে বলে রাফি।

“চলবে না কেন? আমার তিন ছেলে আছে না? তুই আয়। বউ ছেলেমেয়ে সব নিয়ে আয়।” মা জেদ ধরে।

ম্যনাজার ফিরে এসেছে। রাফি ফোন কেটে দিল।

 

বাসায় ফিরতে বধুয়ার কুটিল চাহনি। “তুমি নাকি মাকে বলেছ কাজ কর্ম ফেলে সবাইকে নিয়ে দেশে চলে যাবে?”

মা এবার ডিপ্লোমেসিতে নেমেছে। ইতিমধ্যে রানীর কানেও এই কথা লাগানো হয়ে গেছে। মরীয়া হয়ে উঠেছে। দুই ভাইয়ের উপর রাগ হচ্ছে তার। ঐ গাধা দুটা যদি কোন কাজে আসে।

“কথা বলছ না কেন?” রানী বিরক্ত কন্ঠে বলল।

“আরে কাজের বুয়া ভেগেছে।কেমন বিপদ চিন্তা করেছ? আরেকটা বিশ্বাসী কাজের লোক পাওয়া কি চারটিখানি কথা?”

“তুমি তাহলে দেশে গিয়ে মায়ের সেবা করবে?”

রানীর কন্ঠে কি বিদ্রুপ? ঠিক বোঝা গেল না। “আরে, মা ই বলল। যাবো বললেই কি যাওয়া যায় নাকি?”

“ভালই হবে,” রানী বলল। “চল যাই। তুমি বড় ছেলে। তোমার তো একটা দায়িত্ব আছে।”

রাফি মনে মনে প্রমাদ গোনে। এ আবার কি পরীক্ষা? “সত্যি?”

“সত্যিই। চল যাই। মাস কয়েক থেকে আসি।”

“বাচ্চাদের স্কুল?” রাফির মাথায় কিছুই ঢুকছে না।

“ছুটি নিয়ে গেলেই হবে। ওখানে গিয়ে বাসায় পড়বে।” রানী মিষ্টী হেসে বলল।

“মন্দ বল নি। কাজে না হয় ছুটি নিয়ে চলে যাই। আনপেইড ভ্যাকেশন। দেশে গিয়ে কিছু একটা কাজ কর্ম পাওয়া যাবে। আমার অনেক বন্ধু বান্ধব বড় বড় পোস্টে আছে।”

রানীর হাসি হাসি মুখ ঝট করেই কঠিন হয়ে উঠল। “ফাজলামী করছি, ফাজলামি। ঠাট্টাও বোঝ না? তোমার মা কি করে আশা করে আমরা সব ছেড়ে ছুড়ে দেশে গিয়ে তার কাজের বুয়া হব?”

রাফি বলতে পারতো মায়ের সেবা করা তার দায়িত্ব কিন্তু চেপে গেল। এই জাতীয় কথা বার্তা আজকাল কৌতুকের মত শোনায়। এই ধরনের চিন্তা ভাবনা করাটাও পাপ। অর্ধেক পৃথিবী পেরিয়ে এসে ঘরের মায়া করলে কি চলে? মায়ের যদি পুত্রের সেবা পাবার এত সখ থাকে তাহলে প্লেনে চড়ে উড়াল দিয়ে কাছে চলে এলেই হয়। তাতো আবার চায় না। দেশে বসে না পচলে তার চলছে না। পচুক। রাফি কিচ্ছু করতে পারবে না।

রাতে ফোন করল। মাই ধরল। বারো বার বাজবার পর। “কি রে, ফোন করেছিস কেন? এই সাত সকালে কেউ কাউকে ফোন করে?”         

ভনিতা না করে আসল কথা পাড়ল রাফি। “মা, আমি এখন আসতে পারব না। অনেক সমস্যা। তুমি মন খারাপ কর না।”

মা ধমকে উঠল, “তোর কি কোন কান্ডজ্ঞান আছে?রাতে ঠাট্টা করে কি বলেছিলাম সেটা ধরে বসে আছিস?”

“ঠাট্টা! তুমি চাও না আমি আসি?” মনে একটু খোচাই লাগল রাফির। নিজের মাও বেঁকে বসেছে। শালা প্রোগ্রামের কি দোষ?

“খবর্দার আসবি না। কাজের বুয়া ফিরে এসেছে। আমি একা থাকলে ও কোন ঝামেলা করে না। মানুষ জন এলে কাজ বেড়ে যায়, ওরও মেজাজ বাড়ে।” মা মুখ ফিরিয়ে কাজের বুয়াকে লক্ষ্য করে ঝাঝিয়ে ওঠে, “ভালো করে ঝাড়ু দাও। না দিলে দূর হও। তোমাকে না হলেও আমার চলবে। আমার বড় ছেলে বউ বাচ্চা নিয়ে চলে আসবে। আমার পা ধরছে আসার জন্য। বড় বউমা এলে তোমাকে লাথি মেরে তাড়াবে। সে আবার কাজের মানুষের মেজাজ সহ্য করতে পারে না। বুঝেছ?”

এবার রাফিকে লক্ষ্য করে বল্ল, “শোন, ব্যাস্ত এখন আমি। পরে ফোণ করিস। রাখি।”

মা ফোণ রেখে দেয়। যাক, একটা সমস্যা আপাতত মিটেছে। যদিও মনের মধ্যে খচ খচ করছে। কাজের বুয়াকে ঘায়েল করবার জন্য নিজের সন্তানকে ব্যবহার করাটা কি ঠিক?

তার দুচোখ ভরে ঘুম আসছে। প্রোগ্রামটা এখনও ঠিক করতে পারেনি। রাত জেগে চেষ্টা করতে হবে। রানী তাকে ঘুমাতে ডেকে বিছানায় চলে গেছে। কম্পিউটারের সামনে বসে টেবিলে মাথা গুজে দিয়ে সারা রাত গভীর ঘুম দিল রাফি। একটা ছোট খাট স্বপ্নও দেখে ফেলল। কাজের বুয়া ঝাড়ু হাতে ছুটে আসছে। “বেয়াদপ পোলা, মায়ের সেবা করস না। আমার হইছে যত ঝামেলা!”