সেথ উইটিকার

Writer: Kazi Sabbir Ahmed Category: ছোট গল্প (Short Story) Edition: Dhaboman - First Edition

আমি তখন টরেন্টোর ডাউন টাউনে অবস্থিত একটি সফটওয়্যার স্টার্ট-আপ কোম্পানীতে কাজ করি। আমদের কোম্পানীর প্রোডাক্ট হচ্ছে এক ধরণের 'ডিসিশনিং ইন্জিন' সফটওয়্যার যেটা ফিনান্সিশাল ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যবহৃত হয়। আর্থিকভাবে সুলভ এবং সহজ ব্যবহারবিধি, এই দুই বিশেষণের কারণে অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের ক্লায়েন্টদের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। প্রত্যেক ক্লায়েন্টের নিজস্ব কিছু রিকুয়্যারমেন্ট থাকে, যেটা আমাদের মূল সফটওয়্যারের অংশ নয়। ফলে সফটওয়্যারকে একেক ক্লায়েন্টের জন্য একেক রকম ভাবে কাস্টোমাইজড করতে হচ্ছিল। ফলে ক্লায়েন্টদের সংখ্যার সাথে পাল্লা দিয়ে কোম্পানীর আকারও বৃদ্ধি পেতে থাকে।

সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট প্রক্রিয়ার একটি অংশ হচ্ছে 'মর্নিং স্ট্যান্ড-আপ মিটিং'। একদিন সকালে এই সেশনে টিম ম্যানেজার টেইট-এর সাথে চল্লিশোর্ধ এক লোকের আগমন। টেইট তাকে পরিচয় করিয়ে দিল - "সিলভিও পাইভা হচ্ছে আমাদের নোতুন ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার"। আমাদের সবার চোখ একসাথে ঘুরে স্থির হলো সিলভিও-র মুখের উপর। মোটা-সোটা শরীরে আঁটসাঁট কোট-টাই নিয়ে বেশ বিব্রত সে। নিজের পরিচয় দেয়ার চেষ্টা করল সে - কথায় সাউথ আমেরিকান টান বেশ স্পষ্ট।

অন্য যে কোন স্টার্ট-আপ কোম্পানীর মতন আমাদের এখানেও নোতুন লোকের যেমন রিক্রুট হচ্ছে হরহামেশা, তেমনি আবার পুরাতন লোকেরাও চলে যাচ্ছে হুটহাট করে। অনেক সময় দেখেছি যে আমার পাশের ডেস্কে বসা  লোকটি হঠাৎ আমাকে জানালো যে আজই তার শেষ দিন এখানে। প্রথম প্রথম খুব অবাক হতাম এই কালচারে, পরে অবশ্য অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছি। ফলে আমার কাছে টিমে কোন লোকের জয়েন করা কিংবা চলে যাওয়া, কোনটারই তেমন গুরুত্ব ছিল না।

পরের দিন সিলভিও এলো অন্যান্য সবার মতন জিন্স আর টি-শার্ট পরে, প্রথমদিনের তুলনায় অনেকখানি সহজ আর সাবলীল সে তার আচরণে। দায়িত্ব বুঝে নিয়ে কাজ শুরু করা ততটা সহজ ছিল না তার জন্য, কারণ বিজনেস এনালিস্ট জন ম্যাকগাওয়ান শুরু থেকেই অসহযোগিতা করে আসছিল। সিলভিও ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার হিসেবে জয়েন করলেও তার মাল্টি ডাইভার্সড স্কিলসেট-এর কারণে সে কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের ইউনিক্স  আর ডেটাবেস সিস্টেম অ্যাডমিনদের বেস্ট ফ্রেন্ড-এ পরিণত হলো। ধীরে ধীরে কোম্পানীর ভিতর সে তার অবস্থান শক্ত করে নেয়। এমন সময় কোম্পানীর সি-ই-ও ড্যারেন জানায় যে এক গুরুত্বপূর্ণ ফিনান্সিশাল কোম্পানী আমাদের সফটওয়্যারের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেছে, কিন্তু এতে 'মালটি-লিঙ্গুয়াল' বৈশিস্ঠ যোগ হবে। এই ফিনান্সিশাল কোম্পানীটি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে সে তার নাম প্রকাশ করতে পারছে না। শুরু হয় আমাদের নোতুন প্রজেক্ট -আমাদের সফটওয়্যারকে আবার গোড়া থেকে তৈরী করা। সময়ের সাথে তুমুল পাল্লা দিয়ে এই কাজ শেষ করতে হবে পরের বছর মার্চ মাসে। দেখতে দেখতে ডিসেম্বর চলে আসে।

ক্রিসমাসের সময় সাধারণত সবাই লম্বা ছুটিতে যায়। আমি যেহেতু দুই ঈদের সময় ছুটি নেই, তাই এই সময়টায় অন্যদের ছুটির সুযোগ করে দিতে নিজে কোন অতিরিক্ত ছুটি নেই না। সিলভিও ছুটিতে যায়নি। নিরিবিলি এই সময়টায় তাকে ঘনিষ্ঠ ভাবে জানার সুযোগ হয়। ইতালীতে জন্ম নেয়া সিলভিও-র বাড়ী হচ্ছে ব্রাজিলে। ইহুদী পিতার যোগসূত্রে ইসরাইলের সেনাবাহিনীতে সার্ভিস দিয়েছে তরুণ বয়সে। দুই কন্যার জনক, কিন্তু বিবাহিত জীবনে স্ত্রীর সাথে বনিবনা হচ্ছে না। বর্তমানে ডিভোর্স কেস চলছে। জীবনকে নোতুন করে সাজানোর জন্যে ভিজিট ভিসা নিয়ে টরেন্টোতে আসে। রেজুমি হাতে নিয়ে বিভিন্ন কোম্পানী ঘুরে যখন আমাদের রিসেপশন ডেস্কে আসে তখন তার পকেটে অবশিষ্ট ছিলো কয়েকটি খুচরো ডলার। তাই মরিয়া হয়ে ডেস্কে বসা লরি অ্যান-কে জিজ্ঞেস করে - "তোমরা কি কানাডিয়ান ছাড়া অন্য কাউকে ইন্টারভিউতে ডাকো না? আমি দুই সপ্তাহ ধরে টরেন্টোর বিভিন্ন কোম্পানীতে রেজুমি দিয়ে যাচ্ছি কিন্তু এখন পর্যন্ত একটা কলও পাইনি"। "দেখি তোমার জন্য কি করতে পারি" বলে লরি অ্যান কিছুক্ষণ পরে ভিতর থেকে টেইট-কে নিয়ে আসে ইন্টারভিউ নেয়ার জন্য। কোম্পানীর মালিক ড্যারেন-এর স্ত্রী লরি অ্যান-ও কিন্তু আমার ইন্টারভিউ সেট করেছিলো, সেই কাহিনী আরেকদিনের জন্য তোলা রইল।

ছুটির পরে আবার ঝড়ের গতিতে আমাদের কাজ এগিয়ে চললো যাতে কোনভাবেই প্রোডাক্ট রিলিজের ডেডলাইন ফস্কে না যায়। এই রকম অবস্থায় অনেকেই সহজে স্ট্রেসড আপ হয়ে জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। বহুল প্রচলিত ডিজাইন নীতি  KISS (Keep It Simple, Stupid) ফলো করতে বলায় এক ডেভেলপারের উপর আরেক ডেভেলপার মারমুখী হয়ে উঠে। আবার দেখা গেলো, এক ডেভেলপারের সাথে কেউ সহজে কথা বলে না,কারণ তার গা থেকে নাকি দূর্গন্ধ বেরোয়। আবার একজনের বিরদ্ধে অভিযোগ সে নাকি তার ডেস্কে বসে নেইল ক্লিপ করে। ম্যানেজার হিসেবে সিলভিও এইসব উদ্ভট পরিস্থিতি সফলতার সাথে সামাল দিতে লাগল।

বিশাল এই কর্মযজ্ঞের মাঝে হঠাৎ সিলভিও-কে যেতে হলো ব্রাজিল, ফ্যামিলি ইমার্জেন্সীর কারণে। ফিরে আসার পর তার ভিতর বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করি - অধূমপায়ী সিলভিও দেখি পুরোপুরি স্মোকারে পরিণত হয়েছে। এফিডেভিট করে নিজের নাম পরিবর্তন করে 'সেথ উইটিকার' করেছে। কোন এক নির্জন মুহুর্তে জানতে চাইলাম ঘটনা কি? কোর্টে স্ত্রীর সাথে তার ডিভোর্স হয়ে গেছে, যেটা সে নিজেই চাচ্ছিল। কিন্তু সে বুঝতে পারেনি তার মেয়েরা এতে এতখানি ভেঙ্গে পড়বে। তারা ভাবছে সে তাদেরকেও ত্যাগ করেছে। আরো একটা ব্যাপার তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে, ডিভোর্স দেয়ার পর তার চার্চ তাকে 'পারসন নন গ্রান্টা' ঘোষণা দিয়েছে। অথচ এই চার্চেই সে ছোটবেলা থেকে ভায়োলিন বাজিয়ে এসেছে।

দেখতে দেখতে সফটওয়্যার তৈরী হলো নির্ধারিত সময়ের আগেই। ফলে কিছুটা মন্থর হলো আমাদের কাজের গতি। ততদিনে সিলভিও-কে আমরা তার নোতুন নামে ডাকতে অভ্যস্থ হয়ে উঠলাম। মাঝে মাঝেই আমি তাকে সংগ দিতে একসাথে কফিশপে যাওয়া শুরু করলাম। তখন কাজের কথার বাইরে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ হতো। এমনই এক দিনে আমি কথায় কথায় বলছিলাম, চাইনিজ ভাষায় কিন্তু কোন অ্যালফাবেট নেই, তারা লিখে মূলত ছবির মতন এক ধরণের প্রতীকের সাহায্যে। অনেক সময় দুটি আলাদা শব্দের প্রতীক মিলে একটি সম্পূর্ণ নোতুন শব্দ তৈরী করে। যেমন, 'ভালো' লিখতে হলে প্রথমে লিখতে হয় 'কন্যা'-র প্রতীক তারপর 'পুত্র'-র প্রতীক - তবে চাইনিজদের বিশ্বাস হচ্ছে প্রথমে 'কন্যা' তারপর 'পুত্র' হওয়াটা সৌভাগ্যের ব্যাপার।

'প্রথমে যদি কারো 'পুত্র' হয়ে মারা যায়?' - মুখে মৃদু হাসি কিন্তু চোখে গভীর বিষাদের ছায়া নিয়ে সেথ তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। সে আগে কখনও আমাকে বলেনি যে তার দুই মেয়ের আগে এক ছেলে হয়ে মারা গিয়েছিল। আমি তাড়াতাড়ি কথার প্রসংগ পাল্টানোর চেষ্টা করতে গিয়ে আবিস্কার করি যে কাজটা কত কঠিন।