সস্তা দরের সাকে

লেখক: কাজী মঈনুল হক Category: ছোট গল্প (Short Story) Edition: Dhaboman - Eid 2022

অন্য ল্যাবের কথা জানি না, তবে আমাদের ল্যাবে কারণে-অকারণে পার্টি লেগেই থাকত। পার্টি মানে প্রচুর খানা ও পিনা। প্রথমে হালকা পানীয় বিয়ার দিয়ে শুরু হতো, তারপর একটু একটু করে পানীয়ের মধ্যে অ্যালকোহলের শতকরা হার বাড়ত। এক ব্র্যান্ড শেষ করে যখন নতুন বোতল খোলা হতো তখন সবাই গ্লাসটা ধুয়ে নিত যাতে তারা নতুন ব্যান্ডের স্বাদ-গন্ধ উপভোগ করতে পারে। অবশ্য তখন তাদের স্বাদ-গন্ধ আলাদা করে উপলব্ধি করার মতো সূক্ষ্মবোধ থাকত কিনা এ নিয়ে আমি সন্দিহান বলে গ্লাস ধুতে গিয়ে আমার খুব হাসি পেত। ইনুই সেনসেই (গুরু) এর মধ্যে লাল ও টাল হয়ে ছটফট করছেন। তামুরা সেনসেই যত খান তত বেশি স্বাভাবিক ও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। আর তখন তিনি একে একে সবাইকে ইন্টার্ভিউ করতে শুরু করেন। এ সময়ে আমি বেশ চাপ অনুভব করতে শুরু করি। পড়াশুনা করতে আমার মন্দ লাগে না, কিন্তু এক্সপেরিমেন্টের সরঞ্জাম বানাতে গেলে আমার মেজাজ খিঁচে যায়। আমার পালা যখন এলো তখন তিনি আমার পরীক্ষণ প্রস্তুতির খবরাখবর নেবার পর নতুন বাসায় কেমন লাগছে জিজ্ঞেস করলেন।

হিরোশিমা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সব ছাত্রছাত্রীরা বাইরের দেশ থেকে আসে তাদের জন্য আন্তর্জাতিক হস্টেলে এক বছরের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়। এক বছর পর সবাইকে যার যার বাসা খুঁজে নিতে হয়। ‘ভার্সিটির আশেপাশেই ছাত্রদের ভাড়া দেবার জন্য বেশ কিছু দ্বিতল আপাতো (অ্যাপার্টমেন্ট) গড়ে উঠেছে। এর একেকটা বাসা মানে হলো  তাতামি (মাদুর) মোড়ানো মেঝের একটা ছোট  ঘর যার প্রবেশপথের একপাশে ছোট বাথরুম আর অন্য পাশে রান্নার ব্যবস্থা। আমি এ ধরণের কোনো ঘরে না উঠে একজন বুড়ির বাড়ির বাইরের দিকের অতিরিক্ত ঘরে উঠেছিলাম। হাইপারমার্টে যেতে এই বুড়ির সাথে আমার প্রায়শ দেখা হতো যখন তিনি তার চলনে-বলনে অক্ষম বুড়োকে একটি হুইলচেয়ারে বসিয়ে বৈকালিক ভ্রমণে বের হতেন। এই এক বছরে কন্নিচিওয়া (জাপানি অভিবাদন) ও হাসি বিনিময়ের মাধ্যমে তার সাথে আমার একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। আমাকে দেখলে তিনি হুইলচেয়ার থামিয়ে গল্প করতেন, সে সব কথার চৌদ্দ আনা না বুঝেই আমি ‘হাই’ (হাঁ-সূচক শব্দ) ‘হাই’ করে যেতাম। হস্টেল ছাড়ার সময় হলে আমি বুড়িকে জানালাম যে, আমি থাকার জন্য একটা ঘর খুঁজছি এই হাইপারমার্টের কাছে। বুড়ি বললেন, তুমি আমার বাড়িতে উঠতে পার। আমি বুড়ির বাড়ি চিনতাম। এখান থেকে ল্যাব, হাইপারমার্ট ও সেভেনইলেভেন বেশ কাছে, আবার ভাড়াও অন্য আপাতো থেকে অর্ধেক। আমি খুশি মনেই রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু উঠার পর বুঝলাম এই ঘরে আমি ছাড়াও অন্য কেউ থাকে। প্রথম দু’ একদিন দরকারি টুকিটাকি জিনিসগুলো যথাস্থানে পেতাম না, খুঁজতে খুঁজতে যেখানে থাকার কোনো সম্ভবনা নেই সেখানেই পেতাম। এ নিয়ে মাথার মধ্যে খচ্‌খচ্‌ থেকে গেলেও গা করিনি। আমি সাধারণত ল্যাব থেকে ফিরে সেভেনইলেভেন থেকে কেনা খাবার খেতে খেতে ইংরেজি মুভি দেখতাম ও সস্তা দরের সাকে পান করতাম। একদিন ‘কিলার’ নামের একটা মুভি মনোযোগ দিয়ে দেখছি। এ সময়ে ঘাড়ের উপর কারো ঠাণ্ডা নিঃশ্বাস অনুভব করলাম। তারপর মনে হল, একটা বরফ শীতল হাতে কেউ আমার কোমর জড়িয়ে রেখেছে। আমি উঠে গিয়ে হিটারের তাপমাত্রা দেখলাম। না, সব ঠিক আছে। বসতেই মনে হল, অতি ঠাণ্ডা শরীরের কেউ আমার কাঁধে হেলান দিয়ে আমার সঙ্গে ছবি দেখছে। আমি চিৎকার করে উঠতে গিয়েও পারলাম না। বুড়ি কি জেনেশুনে এই ঘর আমাকে সস্তায় ভাড়া দিয়েছে! সেই থেকে আমি নিশ্চিতভাবে জানি যে, আমি একটা জাপানি পেত্নির পাল্লায় পড়েছি। আমার আগে ভূত-পেত্নিতে বিশ্বাস ছিল না। কিন্তু এখন পেত্নির সাথে সহবাস করতে হচ্ছে, তাই বিশ্বাস না করে উপায় কি! বাংলাদেশে শুনেছি কারো অপমৃত্যু(!)ঘটলে সে নাকি ভূত হয়। জাপানে পেত্নি হবার নিয়মাবলী এখনও জানি না, তবে জানতে হবে। প্রথম কয়েকদিন পেত্নিটা খুব একটা বাড়াবাড়ি করেনি। কিন্তু ইদানীং মুভি দেখার সময় সে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে থাকে আর ঘুমিয়ে পড়ার সময় আমি অনুভব করি তার ঠাণ্ডা সূচাগ্র স্তন, হিমশীতল নিঃশ্বাস আর হিমেল পেষণ।

তামুরা সেনসেইকে নিশ্চয় বলা ঠিক হবে না যে, আমি প্রতি রাতে একটি পেত্নির সাথে সহবাস করছি। বোধ করি জাপানি পেত্নি তাড়ানোর মন্ত্র তাঁর কাছে জানতে চাওয়াও উচিত হবে না। কুরআনের আরবি মন্ত্র পড়ে তাড়ানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। সম্ভবত জাপানি পেত্নিরা আরবি জানে না। একজন পদার্থ বিজ্ঞানীর ভূতপেত্নির খপ্পরে পড়া যুক্তিযুক্ত নয়, তাতে বিজ্ঞান মিথ্যে হয়ে যায়, সমস্ত গবেষণা, পরীক্ষণ অর্থহীন হয়ে পড়ে। আমি মুখে হাসি টেনে বললাম, ‘বাসাটা একটু নিরিবিলি, হস্টেলের মতো হৈচৈপূর্ণ নয়। এই নির্জনতা একটু অন্যরকম লাগছে।‘ তামুরা সেনসেই এবার মাৎসুসাকার দিকে তাকাতেই আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম আর একটা সাশিমি (কাঁচা মাছ) হাসি (চপস্টিক) দিয়ে তুলে বাটিতে রাখা উয়াসাবি ও সইয়ু দিয়ে মাখিয়ে মুখে তুলে ফেললাম। সাকাগুচি সান দেখলাম মেক্সিকোর শুঁয়াপোকা ডুবানো বোতল খুলে আমার গ্লাসে মদ ঢালছে। টিপসি না হলে এই বোতলের মদ খেতে আমার বমি পেত। কিন্তু এখন পাচ্ছে না। বরং বোতলটা হাতে নিয়ে আমি খুব মনোযোগের সাথে শুঁয়াপোকাটিকে দেখলাম। তারপর গ্লাসে চুমুক দিতেই আমার কণাকে খুব মনে পড়ে গেল আর অনুভব করলাম মাথার মধ্যে শব্দের বুদ্বুদ। আমি ধীর পায়ে পার্টিরুম থেকে বেরিয়ে নিজের ডেস্কের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিই। আমাকে এখন কবিতা লিখতে হবে।  

রুমে ঢুকে দেখি নিত্তা সান মেঝেতে আধশোয়া হয়ে আছে। ইনুই সেনসেইসহ আমরা ছয়জন এই রুমটা ভাগাভাগি করে থাকি। এই নিত্তা সানই আমাদের রুমের এমমাত্র মেয়ে সদস্য। তারও পার্টিতে থাকার কথা ছিল, কখন্‌ যে ফিরে এসেছে খেয়াল করিনি। নিত্তার সাথে আমার বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে সিগারেট খাবার সুবাদে। রুমে কফি মেকার থাকা সত্ত্বেও আমি বাইরে গিয়ে ভেন্ডিং মেশিন থেকে কফি কিনি আর আকাশ দেখতে দেখতে সিগারেট টানি। নিত্তা প্রায়শ আমার সাথে যুক্ত হয়। এখানে ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে বড় হলে সবাই মদ খায়। মদ খাওয়া এখানকার সংস্কৃতি। সন্তানরা ছুটিতে বাড়ি গেলে মা-বাবার জন্য মদ কিনে নেয়। এখানকার অনেক ছাত্র ও অধ্যাপককে সিগারেট টানতে দেখেছি, কিন্তু নিত্তা ছাড়া এখনও কোনো মেয়েকে আমি সিগারেট খেতে দেখিনি। সে প্রতিদিন হিরোশিমা থেকে গাড়ি ড্রাইভ করে সাইজোতে আসে। হিরোশিমা ইউনিভার্সিটির মেডিক্যাল ফ্যাকাল্টি ছাড়া আর সবই এই সাইজোতে। সাইজো সিটি থেকে বেশ দূরে হওয়ায় এখানকার পরিবেশ বেশ গ্রামীণ। নিত্তা বেশ লম্বা, সুন্দরী আর তার  চেহারায় পোশাকে চলনে বলনে নাগরিক ছাপ স্পষ্ট। আমি কারণে অকারণে অনেকবার হিরোশিমা গিয়েছি, কিন্তু সেখানেও মেয়েদের সিগারেট খেতে দেখিনি। একদিন এ নিয়ে প্রশ্ন করায় সে বলে যে, সে যে সিগারেট খায় তা তার বয়ফ্রেন্ডও জানে না। অথচ তার বয়ফ্রেন্ড সিগারেট খায়। আমি প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে তাকাতেই সে বলে, ‘আমাদের সমাজে মেয়েদের ধূমপান করাকে সহজভাবে নেয় না। সামাজিক মূল্যবোধের কারণে এখানকার মেয়েরা অনেকভাবে অবদমিত। জাপানি পুরুষরা চরমভাবে মে’ল সোউভিনিস্ট। মুখে অস্বীকার করলেও এখনো কনফুসিয়াসের প্রবচন এদের মাথার মধ্যে গেঁথে আছেঃ মেয়েরা অল্প ব্যসে বাবাকে মান্য করবে, পরিণত হলে স্বামীকে আর বার্ধ্যক্যে পুত্রকে। তুমি চিন্তা করতে পারবে না এখানকার স্বামীরা তাদের স্ত্রীদের সাথে কিরকম ঠাণ্ডা আচরণ করে, এমনকি তাচ্ছিল্য করে। চাকরিক্ষেত্রেও রয়েছে ভয়াবহ বৈষম্য। বড় কোনো পদে তুমি মেয়েদের দেখবে না।‘ সে একটু কাঁপা কাঁপা হাতে বেঞ্চির পাশে রাখা বড় স্তম্ভক ছাইদানিতে  সিগারেটের ঝুলে থাকা লম্বা ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি কি কখনো জাপানিদের বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেছ?’ সে আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলতে থাকে, ‘তাহলে দেখতে পেতে গৃহকর্ত্রী রান্নাবাড়া, ধুয়ামুছা, খাবার পরিবেশন সব কিছু করে যাচ্ছেন হাসিমুখে, কিন্তু খাবার টেবিলে অতিথির সাথে বসছেন না।‘ আমি জাপানি সমাজের অনেক ভিতরকার কথা, এর ইতিহাস, দ্বন্দ্ব, আধুনিক প্রবণতা এর কাছে একটু একটু শিখছি। সে আমাকে ইংরেজিতে অনূদিত বিভিন্ন সময়ের জাপানি সাহিত্য পড়তে দেয়। আমি সেগুলো বেশ মন দিয়েই পড়ি এবং সময় পেলে এ সব নিয়ে আলোচনাও করি। নিত্তা আমার সাথে প্রচুর বকবক করলেও জাপানি সহপাঠীদের সাথে তার আচরণ খুবই চুপচাপ ও ঠাণ্ডা। নিত্তাকে কোনোভাবেই নারীবাদী কিংবা বিদ্রোহীগোছের কিছু বলা যাবে না, বরং আর সব জাপানি মেয়েদের মতই সেও নম্র ও অনুগত। কিন্তু সে আত্মসচেতন যা অন্য মেয়েদের মধ্যে খুব একটা সুলভ নয়।

নিত্তাকে ঠাণ্ডা মেঝেতে শুয়ে থাকতে দেখে আমি বুঝতে পারছিলাম না আমার করণীয় কী। আমি কি পার্টিতে ফিরে গিয়ে তামুরা সেনসেইকে খবরটা দেব! সেক্ষেত্রে সে হয়ত অপ্রস্তুত হবে। অনেকটা সিদ্ধান্তহীনভাবে আমি তার মাথার কাছে গিয়ে জাবড়ে বসি আর তার কপালে হাত রেখে বলি, ‘তোমার কি খারাপ লাগছে।‘ সে খানিকটা জড়িত গলায় বলে, ‘একটু। তবে বিশ্রাম নিলে ঠিক হয়ে যাব।‘ আমি কি তার মাথাটা কোলের উপর টেনে নেব! সেটা কি বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে! আমি চুপচাপ তার চুলে আলতো করে আঙ্গুল বুলাতে থাকি। সে একটু ধাতস্ত হয় ও কথা বলতে শুরু করে।

--- তুমি কি এখন বাসায় ফিরে যাবে? সেখানে গিয়ে কী করবে?

--- সস্তা দরের সাকে খাব আর মুভি দেখব।

--- তুমি কি জাপানি মুভি দেখ? দেখো না। খুব নোংরা।

---  জাপানি ভাষায় আমার করুণ অবস্থা তুমি তো জান। তাই জাপানি মুভি দেখার সাহস করি না। আজ বাসায় ফিরে গিয়ে ‘সিটি অফ অ্যাঞ্জেলস’ দেখব।

--- তুমি কি ‘ফ্রেঞ্চ কিস’ দেখেছ? খুব মজার।

এ সময় তাকে স্বাভাবিক মনে হয়। আমি তখন উঠার কথা ভাবছি। আমি আমার হাতটা তার মাথা থেকে সরাতেই সে আমার হাতটা টেনে নিয়ে বুকের মধ্যে রাখে। আমি সচকিত ও আড়ষ্ট হয়ে পড়ি। এ সময় যে কেউ পার্টি থেকে ফিরে আসতে পারে। কিন্তু নিত্তা নির্বিকার গলায় বলে, ‘আমি মদ খেয়ে অনেক কিছু করি যা স্বাভাবিক অবস্থায় মনে করতে পারি না।‘ আমি বাইরে কারও পদধ্বনি শুনতে পেয়ে শশব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়াই। ঘরের মধ্যে হং ঢুকছে। হং চীনের মানুষ, ইউরোপে ডক্টরেট করেছে। এখানে পোস্টডক করছে। নিত্তাকে মেঝেতে আর আমাকে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার চোখে কিছুটা সন্দেহ ফুটে ওঠে। আমি অনেকটা কৈফিয়ত দেবার ভঙ্গিতে বলি, ‘ওর খারাপ লাগছে, সেনসেইকে খবর দেয়া দরকার। তুমি কি পারবে? আমি এখন বাসায় যাচ্ছি।‘ তারপর হন হন করে বাইরে বেরিয়ে আসি।

বাসায় ফিরে প্রতি দিনের মতো আজও আমি মুভি দেখতে বসি। মেগ রায়ান এই মুভিতে একজন ডাক্তার আর নিকোলাস কেজ ফেরেশতার ভূমিকায় অভিনয় করছে। টান টান গল্প। সহজেই মনোযোগ কেড়ে নেয়ার কথা। কিন্তু বার বার আমি অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি। গল্পের খেই হারিয়ে ফেলি বলে রিওইয়ান্ড করি। নিত্তাকে কিছুতেই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছি না। তার পার্টি থেকে বেরিয়ে আসা, মেঝেতে শুয়ে থাকা, পার্টিচলাকালীন তার আচরণ ইত্যাদি নিয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করি। জট খুলতে গিয়ে আরো জট পাকিয়ে ফেলি। হঠাৎ একটা হাসির শব্দে আমার তন্ময়তা কেটে যায়। আমি টিভিস্ক্রিনে তাকাই। না, সেখানে কোনো হাসির দৃশ্য নাই। তখনই কেউ যেন কানের কাছে পরিষ্কার জাপানিতে বলে, ‘আনাতা ওয়া তাইহেননা কুরো ও সুরু কোতা নি নারুইও‘ আমি যেটুকু জাপানি জানি তা দিয়ে এর মানে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না আর ভয় পাবার কারণে যুক্তিবোধও কাজ করছিল না। আমি অস্বাভাবিক কন্ঠে চিৎকার করে করে বলি, ‘কে! কে!’ আমি কি তখন বাংলায়- ইংরেজিতে নাকি জাপানি ভাষায় চেঁচিয়ে উঠেছিলাম আজও তা মনে করতে পারি না। নিকোলাস কেজ তখন অনেক অনেক উপর থেকে মাটিতে পড়ে মানুষের মতো ব্যথা অনুভব করতে পেরে বুঝতে পারে যে, সে আর ফেরেশতা নয়, মানুষ হতে পেরেছে আর মানুষ হতে পারার আনন্দে সে বিকারগ্রস্তের মতো হাসতে থাকে। তার এই হাসিতে আমি একটু ধাতস্ত হয়ে বুঝতে পারি, এ নিশ্চয়ই পেত্নিটা হবে। এতক্ষণ আমি তার অস্তিত্ব টের পাই নাই। আগে কখনও সে আমার সাথে কথাও বলে নাই। ল্যাবে সবাই আমার সাথে ইংরেজিতে কথা বলে, কিন্তু পেত্নিটা বলছে জাপানিতে, ও নিশ্চয়ই বাংলা জানে না। আমি জাপানিতে বলার চেষ্টা করি, ‘তুমি কি আছ? তোমার নাম কি?’ না, তার কোনও সাড়াশব্দ পাই না। যাক, তাহলে আপদ বিদায় হয়েছে! কিন্তু ঘুমিয়ে পড়ার আগে আমি অনুভব করি তার ঠাণ্ডা শরীরের শক্ত পেষণ।

প্রতিদিনের মতো আমি ল্যাবে যাই আর বিরতির সময়ে সিগারেট খেতে খেতে নিত্তার সাথে আগের মতোই গল্প করি। কিন্তু আমরা সে রাতের পার্টি প্রসঙ্গে কোনও কথা বলি না। সে আমাকে জাপানি ছাত্রছাত্রীদের আঁকা একটা চিত্রপ্রদর্শনী দেখাতে নিয়ে যায়। সব ছবিগুলোর মধ্যেই নতুনত্ব আছে। একটা ছবি আমাকে বিশেষভাবে মুগ্ধ করে। সেখানে দেখানো হয়েছে একটি নাগরিক মেয়েকে --- উন্মুক্ত প্রকৃতির সংস্পর্শে এসে তার শরীর ও মুখের অভিব্যক্তিতে উত্তেজনা ফুটে উঠেছে। আমি নিত্তাকে বলি, ‘আমি এই ছবির শিল্পীর সাথে কথা বলতে চাই।‘ সে তাকে খুঁজে আনে। অল্প বয়সী একটা মেয়ে। পরিচিত হবার পর আমি তাকে বলি, আমার যদিও টাকাপয়সা খুব একটা নেই, তবু আমি ছবিটা কিনতে চাই।‘ সে আমাকে বলে, যেদিন প্রদর্শনী শেষ হবে সেদিন এসো, আমি তোমাকে এই ছবিটি উপহার দিতে চাই।‘ আমরা তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে আসি। আমি সাধারণত সবার আগে ল্যাব থেকে বেরিয়ে পড়ি। কিন্তু পেপার প্রেজেন্টেশন থাকায় সেদিন বেরোতে খুব রাত হয়ে যায়। বেরোবার সময় খেয়াল হয় নিত্তা তখনও ল্যাবে। আমাকে উঠতে দেখে সে বলে, ‘আজ সকুদো(ক্যাফেটারিয়া)তে খেয়ে নিতে ভুলে গেছি। তুমি কি আমার সঙ্গে কোনও রেস্টুরেন্টে যাবে?’ আমি বলি, ‘আনন্দের সাথে।‘ আমাকে সে এখানকার একটা বিখ্যাত রেস্টুরেন্টে নিয়ে যায় ওকোনোমিয়াকি খেতে। তারপর আমরা একটা বারে যাই। বার থেকে যখন বেরিয়ে আসি তখন নিত্তা টলছে। ও ড্রাইভ করতে পছন্দ করে বলে ওর গাড়িটা ম্যানুয়েল। কিন্তু এই অবস্থায় পাহাড়ি উঁচুনিচু আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে হিরোশিমা যাওয়া কতটা নিরাপদ! এ কথা তাকে জানাতেই সে বলে, ‘কেন!’ তুমি তোমার বাসায় আমায় থাকতে দেবে না!’ এই বার থেকে আমার বাসা খুব একটা দূরে নয়। নিত্তা তার গাড়ি বারের পার্কেই ফেলে রেখে আমার সাথে হাঁটতে শুরু করে। আকাশে তখন চাঁদ মাথার উপর উঠে এসেছে। সারা পৃথিবী হয়ত জ্যোৎস্নায় ডুবে গিয়ে স্বপ্ন দেখছে। নিত্তা গুন গুন করে গান গাইতে শুরু করে। এই গানের কথা ও আগেও আমাকে বলেছে। অর্থটা এ রকমঃ আমরা যখন ঘুমিয়ে পড়ি তখন আমরা কোথায় যাই!/ হয়ত তখন স্বপ্ন দেখি আকাশ জুড়ে তারার মেলা।/ এখনও তা-ই আকাশ জুড়ে।/পৃথিবীটা কাঁপছে তারই স্নিগ্ধ আলোয়।/  তবে কি আমরা ঘুমিয়ে আছি! / স্বপ্নে আছি!/

আমার মাথা ঠিকঠাক কাজ করছিল না। আমি নিত্তাকে কোথায় ঘুমোতে দেব! এখানে সবাই সাধারণত মেঝেতে বিছানা পেতে ঘুমায়। আমি একটা খাট যোগাড় করেছিলাম --- হাসপাতালে যে ধরণের খাট থাকে। তবে রঙটা সাদা নয়, কালো। আমার অতিরিক্ত কোনও বিছানা নেই। যা হোক, মাত্র একটা রাতের ব্যাপার কাটিয়ে নেয়া যাবে। আমি তাকে আমার পাজামা পরতে দিয়ে বাইরে এসে সিগারেট ধরাই। ড্রেস বদলে সে বাইরে এসে আমাকে ঘুমোতে ডাকে। আমি তাকে খাটে ঘুমিয়ে পড়তে বলি। ‘আর তুমি,’ সে আমাকে জিজ্ঞেস করে। ‘আমি মেঝেতে একটা চাদর বিছিয়ে নেব,’ উত্তরে বলি। সে আমার গলা জড়িয়ে আদুরে গলায় বলে, ‘না, না, তা কি করে হয়! আমরা একসঙ্গে এই খাটে ঘুমোব।‘ আমাকে ইতস্তত করতে দেখে সে বলে, দেখো, এত চাপ নিও না। সকাল হলে আমি সব কিছু ভুলে যাব।‘ আজ আমি কোথাও পেত্নিটার সাড়াশব্দ পাই না আর তার  ঠাণ্ডা শরীরের পেষণও আমাকে সহ্য করতে হয় না।

সকালে আমার ঘুম ভাঙার আগেই দেখি নিত্তা চলে গেছে। কিন্তু বিষয়টা এখানেই শেষ হয়ে যায় না। এর পর থেকে সে প্রায়ই আমাকে এখানে সেখানে ঘুরতে নিয়ে যায়, বারে গিয়ে মদ খায় আর নানা অজুহাতে আমার বাসায় রাত কাটায়। দিনের বেলার স্বাভাবিক নিত্তা আর রাতের মাতাল নিত্তা যেন দুই আলাদা মানুষ, তারা যেন দু’জন দু’জনকে চেনে না। নাকি না চেনার ভান করে! আমার খুব ইচ্ছে করে এই দুই অচেনা নিত্তাকে পরিচয় করিয়ে দেবার। ইদানীং রাতে নিত্তা না থাকলে পেত্নিটা আমার সাথে জাপানি ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করে। আমি তার কিছু বুঝি, কিছু বুঝি না। কিন্তু বুঝার চেষ্টা করি। আমাকে এই ভাষাটা মনোযোগ দিয়ে শিখতে হবে। আজকাল একটা কথা সে প্রায়ই বলে, ‘ওই নেকিটা একদিন তোমাকে খুব ডুবাবে।‘ আমি যে ডুবছি তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ডুবতে আমার মন্দ লাগছে না। কিন্তু আমি কি কেবল একাই ডুবছি?

এভাবে দেখতে দেখতে একটা বছর পার হয়ে যায়। নিত্তাসহ অন্য দু’জনের গ্রাজুয়েশন উপলক্ষ্যে আজ পার্টি। আমাদের ল্যাবে তার আজ শেষ দিন। দিনের বেলায় সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে সে আমাকে জানিয়েছে, সে আর তার বয়ফ্রেন্ড ইউরোপ ঘুরতে যাবে। ফিরে এসে সিদ্ধান্ত নেবে, সে কোনও কোম্পানিতে চাকরি নেবে নাকি গবেষণা করবে। দিনের বেলায় সে তার বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে অনেক কথা বললেও রাতে মাতাল হয়ে সে ভুলেও তার সম্পর্কে একটা কথাও বলে না। অথচ এমনটা অনেকবার হয়েছে  “অপ্রমত্ত” অবস্থায় সিগারেট খেতে খেতে  আমরা অন্য যে সব প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলতাম পরে মদ খেয়েও তা নিয়ে আলোচনা করেছি; এক্ষেত্রে দুই নিত্তার প্রকাশের ভঙ্গিতে পার্থক্য থাকলেও বিশ্বাসের জায়গায় অমিল থাকত না। আর একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করেছি, নিত্তা মদ খাবার সময়ে কিংবা মাতাল হয়ে কখনও সিগারেট খায় না। অপ্রমত্ত নিত্তার কথা বলার ভঙ্গিতে হয়ত খানিকটা অস্থিরতা, শূন্যতাবোধ কিংবা হতাশা লুকিয়ে থাকে, কিন্তু মাতাল নিত্তা শান্ত, স্নিগ্ধ, কমনীয়। আমার কেন যেন মনে হয়, এই দুই নিত্তা ক্রমাগত পরস্পরকে ঠকিয়ে যাচ্ছে। আমি এই দুই নিত্তাকে ভালবাসি বলে কি তাদের মধ্যে যোগসূত্র নির্মাণ করতে চাই নাকি আমার ব্যক্তিগত কোনও উদ্দেশ্য আছে? তার সাথে আমার সম্পর্ক কি কেবল বন্ধুত্বের? বন্ধুত্বের সীমা কিভাবে নিরূপিত হয়? জাপানিদের সাথে যেটুকু মিশেছি তাতে মনে হয়েছে, তারা দুনিয়ার সমস্ত মানুষকে দুইভাবে দেখে --- এক, নিহনজিন (জাপানি) --- দুই, গাইজিন --- ভদ্রভাষায় গাইককুজিন মানে বিদেশী। এই ধরণের বিভাজন হয়ত সব জাতির মধ্যেই থাকে; কিন্তু জাপানিদের এ ব্যাপারে বাতিকগ্রস্ত মনে হয়। জাতিগত সমসত্ত্বতা আর ভৌগলিক বিচ্ছিন্নতা কি এই ম্যানিয়ার মূল উৎস? নিত্তা হয়ত অন্য জাপানিদের মতো প্রথাগত হবে না। তবু নিশ্চিত হবার জন্য আমি তার সাথে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বা individualism নিয়ে কথা বলি। সে আমাকে জানায়, ‘নতুন প্রজন্ম যে সামাজিক বলয় থেকে বাইরে এসে নিজস্ব অভিব্যক্তি, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, আত্মান্বেষণ ইত্যাদি নিয়ে ভাবছে না তা নয়, কিন্তু এটাকে আমাদের পিতামাতারা মনে করে আমরা জাপানিত্ব হারিয়ে ফেলছি। “individualism” এর শাব্দিক মানে দাঁড়ায় “কোজিন-সুগি” আর এটাকে তারা মনে করে, এটি ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধ এড়িয়ে এক ধরণের স্বার্থপরতা কিংবা আত্মকেন্দ্রিকতার সুখ। সুতরাং এটাকে আমরা এখন আর “কোজিন-সুগি” না বলে “শুতাইসেই” বা “subjectivity” বলি; এ দিয়ে আমরা বুঝাতে চাই যে, আমরা সক্রিয় বিষয়, অন্যের জীবনের নিষ্ক্রিয় বস্তু নই।‘ 

আমি পার্টি থেকে আগেভাগেই বেরিয়ে আসি। আমার খুব অস্থির লাগে। ঘন্টাখানেক দিকভ্রান্তের মতো এদিক-ওদিক হাঁটাহাঁটি করে বাসায় যাই। গ্লাসে না ঢেলেই সস্তা দরের সাকে খেতে থাকি। মুভি ছাড়তে আলস্য লাগে বলে বিছানায় আধশোয়া হয়ে পড়ে থাকি। এভাবে কতক্ষণ পড়েছিলাম জানি না। সম্বিত ফিরে পাই পেত্নির ঠাণ্ডা স্পর্শে। ও গলায় খুব সহানুভূতি এনে বলে, ‘এত ভাবছ কেন! নেকিটা তোমার সাথে দেখা করতে আসবে।‘ পেত্নিটাকে তখন আমার খুব আপন মনে হয়, ওকে খুব ভালবাসতে ইচ্ছে করে। আমি তাকে কাছে টেনে নিই আর তার ঠাণ্ডা শরীরটাকে আদর করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ি।

আমি আজ নিত্তার জন্য অপেক্ষা করে আছি বলে ঘর থেকে বের হইনি। শনিবার সাধারণত আমার ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়; কিন্তু আজ ঘুম ভেঙেছে বেশ আগে। তবু চোখ বন্ধ করে মড়ার মতো পড়ে আছি আর পেত্নির কথা মতো নিত্তার জন্য অপেক্ষা করছি। গত রাতে আমি তার জন্য সাদা ওয়াইন, টেকিলা ও ফুল কিনেছি। ও সাদা ওয়াইন পছন্দ করে। ওটা নাকি সাসিমির সাথে ভালো যায় আর লাল ওয়াইন বীফের সাথে। আমি এ সবের পার্থক্য খুব একটা বুঝি না। আমি বোধ হয় CH3-CH2-OH পছন্দ করি, এ কারণে সস্তা দরের সাকেতে আমার অসুবিধা হয় না। নিত্তা কোনও সাকেই পছন্দ করে না। আমি চিংড়ি ও নারকেল দিয়ে নিত্তার জন্য বাংলাদেশের একটা পদ রান্না করেছি, এ ছাড়া কিছু জাপানি খাবার ও চিজ কিনেছি। আমার দু’কান সজাগ হয়ে আছে দরজায় নিত্তার করাঘাত শোনার জন্য। আমি গতিহীন জড়বস্তুর মতো থেমে আছি বলে হয়ত আমার সময় থেমে আছে। দরজায় ঈপ্সিত শব্দ শুনতেই আমি লাফিয়ে উঠে দরজা খুলি। নিত্তা আমার দিকে তাকিয়ে বিষন্ন হাসি হেসে আমাকে প্রায় ঠেলে সরিয়ে ভিতরে ঢোকে। এই প্রথম সে মাতাল না হয়ে আমার বাসায় এসেছে। সে খাটের উপর বসে একটা সিগারেট ধরায়। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তুমি যে সব সাকে খাও সে সব আছে?’ আমি একটু হেসে বলি, ‘তুমি নিশ্চয়ই আজ নাস্তা করনি? চল, আজ আমার সাথে ‘ব্রাঞ্চ’ করবে। আর আমি যে সাকে খাই তোমাকে কে বলেছে?’ তাকে কি একটু অপ্রস্তুত দেখায়? কিন্তু সে চটপটে ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে, ‘ব্রাঞ্চ কি?’ আমি বলি, ‘ব্রেকফাস্ট আর লাঞ্চ একসঙ্গে’। তারপর কুতাৎসুর উপরে খাবার সাজাতে থাকি আর ‘ফ্রেঞ্চ কিস’ মুভিটা ছেড়ে দিয়ে তাকে খেতে ডাকি। ও ওয়াইনে চুমুক দিয়ে আমার রান্না করা পদটা চেখে বলে, ‘অপূর্ব।‘ তারপর জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি সেদিন পার্টি থেকে পালিয়ে গেলে কেন?’ 

---  ভালো লাগছিল না। তাই বেরিয়ে পড়েছিলাম।

--- কিন্তু সেটা তো অভদ্রতা।

--- আমরা তৃতীয় বিশ্বের মানুষ। একটু গ্রাম্য তো হবোই।

আমি প্রসঙ্গ বদলাই। জিজ্ঞেস করি, ‘কবে ইউরোপ যাচ্ছ?’

--- খুব শিগগির।

--- ভালো। খুব ভালো। এনজয়।

তাকে খুব গম্ভীর দেখায়। আমি তার গ্লাসে টেকিলা ঢালতে ঢালতে বলি, ‘সিগারেটটা ছেড়ে দাও। নাহলে খুব বিপদে পড়বে।‘ তাকে আরও গম্ভীর লাগে। তারপর নিজের মনে জাপানিতে বলে, ‘নানি ও সুরু নো গা তাদাশি নানোকা –‘ [কোন্‌টা করা যে ঠিক হবে --]

আমি পেত্নির কাছ থেকে বেশ খানিকটা জাপানি শিখে ফেলেছি। তাই তার কথা বুঝতে আমার কোনও অসুবিধা হয় না। আমি আস্তে আস্তে বলি, ‘মদ খেয়ে তুমি আমার সাথে যে সব করতে ভালবাস, অথচ অন্য সময়ে ভুলে থাকতে চাও সে সব তুমি আর ভুলে থাকতে পারছ না। নিশ্চয়তার কারাগার আর অনিশ্চয়তার ফুটপাত নিয়ে তুমি খুব দ্বন্দ্বে আছ।‘

--- তুমি অনিশ্চয়তার ফুটপাত নও, তুমি আমার ডানা মেলার আকাশ।

--- আকাশে তো আর নীড় বাঁধা যায় না। ক্লান্ত ডানাকে বিরাম দিতে নীড় দরকার।

--- আমি যদি তোমার সাথে থেকে যেতে চাই ----

--- নেশা কেটে গেলে তুমি তো এ কথা ভুলে যাবে।

---ভুলে যেতে পারলে আজ আমাকে তোমার কাছে আসতে হোতো না।

আমি নিত্তাকে ভালবাসি। সে আমার সাথে এখানে রাত কাটালে আমাকে পেত্নিটার ঠাণ্ডা অত্যাচার সহ্য করতে হয় না। কিন্তু আমি জানতাম যে, তার বয়ফ্রেন্ড আছে। তাই সে আমার সাথে সব সময়ের জন্য থেকে যেতে পারে কখনও ভাবিনি। ভালো লাগায় আমার মন ভরে যায়। একই সাথে অনেক ধরণের চিন্তা এসে ভিড় করে। আমি চিন্তাগুলোকে বাড়তে না দিয়ে বলি, ‘তুমি ইউরোপ ঘুরে এসো। এতে তোমার আর তোমার বয়ফ্রেন্ডের মধ্যে যে দূরত্বটুকু আছে তা ঘুচে যাবে।‘

--- তুমি কি আমাকে তাড়িয়ে দিতে চাইছ?

--- না, আমার ডিগ্রি শেষ হতে আরও দুই বছর লাগবে। এই সময়টা আমি তোমার অপেক্ষায় কাটাব। আমার ভিতরের স্বার্থপর মানুষটা চাইছে, তুমি ফিরে এসো। কিন্তু আমার ঔচিত্যবোধ কামনা করছে, তোমরা সুখি হও।

--- আজ রাতটা তোমার সাথে থাকতে দেবে?

--- আগে তোমার ল্যাবে কাজ থাকত বলে এখানে থেকে যেতে পারতে। এখন কোন্‌ অজুহাতে থাকবে?

ও চলে যাবার সময় দোরগোঁড়ায় দাঁড়িয়ে আমরা অনেকক্ষণ চুমু খাই। সন্ধ্যে নামছে। লাইটটা জ্বালান দরকার। কিন্তু আমি অন্ধকারে একা একা শুয়ে থাকি আর পেত্নিটার ঠাণ্ডা হাতের স্পর্শের অপেক্ষা করতে থাকি।