বারুদের গন্ধ নিয়ে যেদিন সবটুকু জ্যোৎস্না ডুবে গেল তোমার বুকে
চৈত্রের উত্তপ্ত রাতে স্তব্ধ হলো আমার দিনরাত্রির হিসেব-নিকেশ,
বুভুক্ষু অন্ধকারে তোমার চোখে জ্বলে উঠেছিল শত নক্ষত্রের আহ্বান
হৃদস্পন্দনে বল্গাহীন ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি, প্রকম্পিত হয় চরাচরের নিস্তব্ধতা,
আমি শঙ্কিত, প্রাণপণে ব্যথিত আকাশ লুকাই তোমার অগোচরে।
তুমি বলেছিলে,
কোনো এক সিঁদুররাঙা বিকেলে
বসন্তের সুগন্ধি নিয়ে আসবে বীর্যের অন্ত্যমিলে
যুদ্ধ শেষ হলে--আমার সবুজ জমিনে ঝরাবে দারুণ কৃষ্ণচূড়া।
জীবন-মৃত্যুর ভয়াল তমসার অবসানে অবশেষে যখন
ফিরে এলো রণক্ষেত্র থেকে বিজয়ী সব চিবুক স্বাধীন পতাকা হাতে,
জীবনের সেই উত্তাল সমুদ্র-তরঙ্গে কোথাও দেখি না তোমাকে
তোমার প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষা খুলে দিল প্রলম্বিত অন্ধকারের জানালা।
আমি তোমাকে খুঁজি, রণক্ষেত্রের ধোঁয়া-ধূলি মাখা ওঁদের ঝাঁকড়া চুলে,
দাড়ি-গোঁফের অন্তরালে; বুলেটের খোসা মাড়িয়ে বিজয়ের অট্টহাসিতে;
ওঁদের চোখের তারায় তারায়, ভরা বর্ষায় পদ্মার স্রোতের মতো
কলরবে, আমি তোমাকে খুঁজি;
নবান্নের খইয়ের মতো ওঁদের ঠোঁট থেকে
ঝরে পড়া প্রতিটি অভিজ্ঞতার অক্ষরেও খুঁজেছি অনেক--
কোথাও দেখি না তোমার নীল শার্ট; গভীর জলে
বুনোহাঁসের মতো তোমার বহুকালের অনাদ্র চোখ।
কোনো কাগুজে তালিকায় নেই তুমি, নেই কোনো সনদে
সরকারি, বেসরকারি কিংবা ব্যক্তিগত ডায়রিতে, পাইনা তোমাকে
বেওয়ারিশ লাশের সারিতে, গণকবরে, পরিত্যক্ত ক্যাম্প কিংবা বাঙ্কারে
নদীর ধারে ধারে, বনে-বাদাড়ে, শ্মশানে-গোরস্থানে স্তূপীকৃত করোটি ও হাড়ে
শত্রুর ঘাঁটিতে, পত্রিকার পাতায় পাতায়, কোন উপাধিতেও নেই তুমি
আমি অপেক্ষা করতে থাকি, কান পেতে থাকি তোমার অশ্বক্ষুরের।
আজও ধ্রুপদী অভ্যাসে সবুজ আঁচল মেলে রাখি তোমার প্রত্যাবর্তনের
অপেক্ষার পাত্র চুমুক দিয়ে আকণ্ঠ পিপাসায় ছুঁয়ে যাই তোমার নির্বাক অস্তিত্ব
বিবর্ণ হয়ে ফিরে গেছে কত কাকাতুয়া-বিকেল; বিমূর্ত নকশায় লেপ্টে গেছে কত বসন্তদিন
আমি অপেক্ষায় আছি আজও--
বহু দিনরাত্রির যাত্রা শেষে একজোড়া ক্লান্ত পা,
কাদাজলে মাখানো একটি তামাটে শরীর
কোনো এক সিঁদুররাঙা বিকেলে,
আমার ধূসর জমিনে হঠাৎ ঝরাবে বহু রজনীর অনাহারী ঠোঁটের সুতীব্র চুম্বন
সেদিন আকাশ খুলে অঝোরে ঝরবে তুমুল জ্যোৎস্না, বিজয়ের বিলম্বিত অশ্রু।