ঢাকা ক্লাব থেকে বের হয়ে গাড়িটা ডানদিকে বাঁক নিয়ে শাহবাগের দিকে এগিয়ে যায়।
সুমিত রায়ের আর কিছু ভালো লাগেনা। সবই ঠিকঠাক তবু কোথায় যেন পিছুটান। কি যেন মনে করতে চাইছে কিছুতেই মনে আসছে না। একবার ঘড়ি দেখে নিল। ঘড়ির কাঁটা ইতিমধ্যে রাত বারোটা অতিক্রম করেছে। আজ বাড়ী ফেরার তাড়া নেই। একয়দিন ব্যবসার কাজে শরীরের উপর ভীষণ ধকল গেছে। শরীর বলে কথা। লোহা দিয়েতো গড়া নয়। গড়ে তিন চার ঘন্টার বেশি ঘুমোতে পারেনি। ঠিকাদারি ব্যবসার মতো জঘন্য আর কিছু নাই। বহুবার ছেড়ে দিতে চেয়েছে। সুমিত ছাড়তে চাইলে কি, এই ভুত একবার যার ঘাড়ে চাপে তার নিস্তার নেই। টাকার মোহও কম নয়। পাগলা ঘোড়ার মতো ছোটায়। যত্তসব খারাপ কাজ। একে ঘুষ দাও ওকে ঘুষ
দাও। ভাবে এর চেয়ে নিজে ঘুষ খাওয়া অনেক ভালো। শুধু কাজ কাজ আর কাজ। যেন জন্মটা হয়েছে শুধুমাত্র কাজের জন্যই। গাড়ির স্টিয়ারিইংটা আজ আর একেবারে কথা শুনতে চাচ্ছেনা। চোখটাও ক্ষণে ক্ষণে ঝাপসা হয়ে আসছে। মনটা ভাল ছিলনা তাই ভদকা দু-এক পেগ বেশি পড়েছে। সুমিত ভাবে ঠিকমতো বাড়ি পৌঁছাতে পারলেই হয়। আর ঐ মেজাজটা খিচড়ে থাকলে সব রাগ যেয়ে পড়ে নবীনার ওপর। বিয়ে হয়েছে তাও কেমন করে যেন কুড়ি কুড়ি বছর পার হয়ে গেছে। আর সেই সূচনা থেকেই সুন্দরী বউয়ের উপর মোটামুটি বাষ্প-শকট চালিয়ে এসেছে। হ্যাঁ এক বাক্যে অপ্সরী বলা চলে। নবীনা এতটাই আকর্ষণীয় যে এখনও অনেক যুবকের মনের অতলে খরস্রোতা নদীর মতো স্রোতের জন্ম দেয়। হয়তো চমক দেয় শিরা-উপশিরায়। আজ বুকের ভেতর থেকে, মনের গহীন অরণ্য থেকে, হৃদয় অতল থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে গানের কথা। বিশ্বাসের উপলব্ধির কথাগুলো ভেঙে-ভেঙে আসছে। অনেকটাই জড়িয়ে যাচ্ছে। তবু সুমিত সুরে সুরেই গেয়ে যায় "চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে। অন্তরে আজ দেখব যখন আলোক নাহি রে। তোমায় নিয়ে খেলেছিলেম খেলার ঘরেতে। খেলার পুতুল ভেঙে গেছে প্রলয় ঝড়েতে"
সুমিত যেন আর পারছেনা গানের কথা কোত্থেকে কোথায় চলে যাচ্ছে। কোন গান থেকে কোন গানের দিকে ধাবিত হচ্ছে বুঝতে পারছেনা। যখন থাকে অচেতনে এ চিত্ত আমার। আঘাত সয়ে আঘাত তব - নানা পরশ তব সেইতো পুরস্কার। হ্যাঁ নবিনার দেয়া আঘাতটা এই মুহূর্তে যেন আদরের পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে। নবিনা এভাবে হঠাৎ বেঁকে বসবে আর অ্যাবাউট টার্ন করে বাপের বাড়ি চলে যাবে সুমিত ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারেনি। সেই যে গেল দেখতে দেখতে দু-সপ্তাহ হয়ে গেল। কখন যে এতটা সময় পেরিয়ে গেল বোঝা গেল না অবশ্য বুকের মাঝে একটা চিকন বেদনা শত কাজের ভেতর যন্ত্রণায় বিক্ষত করেছে বারেবারে। কি করবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। বারবার ফোন করেছে কিছুতেই ফোন ধরেনি। হুট করে হাজির হয়ে জোর করে নিয়ে আসবে সে সাহস পায়নি।
যেমন একরোখা তাতে আবার হিতে-বিপরীত না হয়। নবীনাকেই বা কি করে দোষ দেয়। গভীরভাবে ভেবে দেখে দোষ দেয়া কি সঠিক হবে? এই মুহূর্তে নিজেকে দোষী মনে হচ্ছে। একেবারে নিজেকে 'নপংশুক' এই শিরোনাম কি দেয়া যায়? সেই অর্থে হয়তো না। কি করবে এমন কোন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নাই যে যার পরামর্শ না নিয়েছে। তাতে বিশেষ কাজ হয়নি। পুরোটাই হয়তো এক মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা। ভাবছে ভাবতে ভাবতে ভাবনার জগতে নিমজ্জিত হয়ে কখন যে গাড়ি পার্ক করে সিঁড়ি দিয়ে চারতলার অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে পড়েছে তার নেশার ভূবনে বলতে পারবেনা। শোবার ঘরের পাশেই একটা লাগোয়া ঘর আর এটাই তার মিনি বার। একান্ত নিজস্ব একতিয়ারে। সুমিত ছাড়া এই ঘরে ভুলেও কেউ প্রবেশ করেনা । ফ্রিজ থেকে কনকনে ঠান্ডা বিয়ার বের করলো। পান করছে প্রবল আকর্ষণে। এ যেন এক পরমা সুন্দরীকে গোগ্রাসেই আত্মস্থ করা । ভাবল , হ্যাঁ ঠিকইতো নবীনার মত মেয়ে ওর সাথে কোন দুঃখে বসবাস করতে যাবে ? যখনই দৈহিক আকাঙ্ক্ষা জেগেছে, উত্তপ্ত হয়েছে ও সেই উত্তাপ পুরোপুরি প্রশমিত করা তো দূরে থাক জল ঢেলে কিছুটা শীতল করাও তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। কখনো মনে হয়েছে তার ভেতর বাঘের মত উদগ্র উত্তেজনা লাগামহীনভাবে জাগ্রত হচ্ছে । কিন্তু বসন্ত আসার আগে ফুল ফোটার মুহূর্তে বসন্ত বিদায় । নবীনার সামনে আসলে কোন অজানা কারণে এক স্থবিরতা তাকে বরফশীতল করে দিয়েছে বারেবারে । আজকে তার এই মাদকাসক্তিটা সে জন্যই দায়ী। দু সপ্তাহ আগের সেরকম একটি ব্যর্থতা নবীনা আর সুমিতকে যেন দুই ভিন্ন গ্রহে ছিটকে ফেলে । বরং তাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেছে যা এর আগে কখনোই করেনি। এসমস্ত ভাবতে ভাবতে কত ক্যান বিয়ার যে সুমিত গিলে খেয়েছে বলতে পারবে না। কেবল আড়ষ্ট কন্ঠে আউড়ে যাচ্ছে গালিবের গজল
"না পিনা হারাম হেয় না পিলাওয়ানা হারাম হেয়
পিনে কে বাদ হওশমে আনা হারাম হেয়"।
হাত-পা টোলছে উঠে দাঁড়াতে পারছেনা। ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে শোবার ঘরের দিকে। শূন্যে ভাসছে । দেহের যেন কোন ওজন নেই। কোনও বিষাদ অনুভব করছে না, কোনও নীল বেদনা বোধ করছেনা। উল্লাসে মন ভরে আছে। আনন্দে আত্মহারা। হঠাৎ চমকে গেলো। থমকে দাঁড়ালো শোবার ঘরের দরজার সামনে এসে। ভূত দেখার মত ভয় পেলে যেন। এক মুহূর্ত। এরপর প্রবল উত্তেজনা। অরণ্য উন্মাদনা, আকাঙ্ক্ষা। এক-পা, দু-পা করে এগিয়ে যায়। কী সুন্দর অপূর্ব অপ্সরী, ভুত বলবে না পেত্নী বলবে নাকি পরিস্থানের পরি বলবে। ঢং ঢং ঢং নিস্তব্ধ নীরবতা ভেঙে দূর প্রান্ত থেকে কোনো ঘড়ি কাহার ঘড়ি জানান দিল রাত দুটো। স্বর্গের সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে কামদেবী। সারা অঙ্গে আদিম ইচ্ছার অগ্নিয়গিরি জ্বলে ওঠে দাউ দাউ। অনেক পুরনো আমলের বাড়ি সুমিতদের। সুমিত পরিষ্কার দেখতে পেল লাল শাড়ি পরা এক অসম্ভব সুন্দরী নারী ভেন্টিলেটরের ভেতর থেকে মাথা গলিয়ে বিছানায় লাফিয়ে পড়ল। শূন্যে ভাসছে। ওমা এত হাওয়া কোত্থেকে। বাতাসে উড়িয়ে নিচ্ছে সবকিছু। জানালার পর্দা উড়ছে। ভূতবধূর কৃষ্ণ কালো চুল যেন ঢেউ তুলেছে খরস্রোতা মেঘনায়, বেসামাল শাড়ির আঁচল খসে পড়ছে বারেবারে। রিনিঝিনি কাঁচ ভাঙা হাসির শব্দে সুমিত আকাশচুম্বী রোমাঞ্চিত হচ্ছে। সুমিত যতই জাপ্টে তাকে ধরতে যাচ্ছে হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে সব। এক পরাবাস্তব জগতে সুমিতের অনন্ত সাঁতার। উত্তপ্ত হলো উগ্র যখন দেখলো ভূতবধূর বাতাসে উড়ছে ব্লাউজ, কখন যেন কারুকাজময় চিকেনের ব্রা খসে পড়েছে। দুগ্ধফেনোনিভ নগ্নবক্ষ চুড়ায় বাদামি বোতাম থেকে গলে পড়ছে জোৎস্না। আবার সেই হাসির বন্যা ভাসিয়ে নিচ্ছে ব্যর্থ অতীত। এখন শুধু বর্তমানের অমিও সোপান বেয়ে উঠে পড়া। মুখ যেন মুখ নয় আগুনের গোলা। ফুলে ফুলে উঠছে নাসারন্ধ্র দারুন উত্তাপে। যেকোনো মুহূর্তে যেন বাঘিনী ঝাঁপিয়ে পড়বে সুমিতের ওপর। একেবারে কিছু নেই। এ অতিপ্রাকৃতিক এই ভুতবধূ। শূন্য অথচ শূণ্য নয়। ব্লাউজ নেই, শাড়ি নেই, পেটিকোট নেই, পেন্টি নেই এক ঠায় দাঁড়িয়ে আছে কেবল নিজস্ব সম্পদ নিয়ে। সুমিতের দুরুদুরু কাঁপছে হৃদয়। ভয় নয় অন্য রকম রোমাঞ্চ যার স্বাদ জীবনে সে কখনো পায়নি। ভুতের দিকে এগিয়ে আসতে কেমন একটা লজ্জা। লজ্জায় চোখ বুজে থাকে। বুঝতে পারে কে যেন খামচে ওর বোতাম ছিঁড়ে ফেলে। এরপর আবার নিস্তব্ধ নীরবতা। চারদিক চারিধারে কেউ নেই। চোখ খুলতেই দেখে কিছু দেখা যায় না। কৃষ্ণ সাগরে ভাসছে দ্বীপ। এ কি মুখ নেই, দেহ নেই, কিচ্ছু নেই। একজোড়া যুবতি স্তন যেন মর্মরে গড়া। এগিয়ে এসে মিলে গেছে তার বুকে। অনুভব করছে উত্তাপ এবং শুভ্র কোমলতা। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে তাই ছাড়িয়ে নিলো নিজেকে। অদ্ভুত ভুতুড়ে ভুবনে সুমিতের একটুও ভয় করছেনা আবার ব্ল্যাকআউট। কোথাও কেউ নেই। ভেল্কিবাজির মত শূন্য হয়ে গেল সব। হারাবার বেদনায় যখন কিছুটা বিমর্ষ তখন একজোড়া রক্ত জবা ঠোঁট ভাসতে ভাসতে এসে তার ঠোঁটে সাঁড়াশির মতো চেপে বসল। অনেকক্ষণ শুষে নিলো প্রাণের কোষ। ভীষণ আন্দোলিত সুমিত। এরপর অন্ধকার থেকে ক্রমশঃ আলোর পরশ। ফেডআউট থেকে পর্যায়ক্রমে ফেডইন। জুম আউট জুম ইন অথবা মিডশট থেকে ক্লোজআপ। অনাহুত ভূত রানীর সাথে এক আদিম খেলা। ওদের স্পর্শকাতর' পঞ্চেন্দ্রিয়গুলো ভীষণ জাগ্রত। অমাবস্যার অন্ধকারে এক উদ্ধতো পালতোলা জেলে নৌকা নোঙ্গর করে এক ধবধবে দ্বীপে। ভুতের সঙ্গে সুমিতের অদ্ভুত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর আনন্দ অবগাহন। এর পর অচেতন ঘুন। ভোরের জানালা গলিয়ে হিমেল হাওয়া আর পাখির ডাকে সুমিত রায়ের ঘুম ভাঙে। তার শয্যার পাশে আলুথালু হয়ে যে পড়ে আছে তাকে দেখে অন্তহীন বিস্ময়ে মূর্ছা যাবার জোগাড়। এই তব নব মেঘদূত অপূর্ব অদ্ভুত। নবীনা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম তৈলচিত্র যা পিকাসোর যেকোনো অংকনকে নির্দ্বিধায় হার মানায়। মেঝেতে পড়ে আছে দুধ সফেদ ব্লাউজ। কারুকাজ ব্রা এবং পেন্টি। জলপাই রঙের জামদানি শাড়ি বিছানা থেকে গড়িয়ে নেমে গেছে বহুদূর যেন শান্তির সোপান। আর নবীনার নিরাভরণ পড়ে থাকা দেহলতা, ঠোঁটের কোণে ধ্রুব তারার মতো ফুটে থাকে পরিতৃপ্তির হাসি। সব মিলে চাঁদের ভেলায় এক অতুল ভাস্কর্য।