পয়লা বৈশাখ বা পহেলা বৈশাখ পড়ে ইংরেজী ১৪ ই বা ১৫ ই এপ্রিলে। দিনটি বাংলা বর্ষপঞ্জি বা ক্যালেন্ডারের প্রথম দিন; নানা অনুষ্টানে ভরপুর, বাঙ্গালীর প্রাণের নববর্ষ। এটাই একমাত্র অনুষ্ঠান যেটিতে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, আমির, ফকির, আবালবৃদ্ধবনিতা নির্বিশেষে প্রতিটি বাঙ্গালী একাত্ম হয়ে, সমান উৎসাহে প্রাণঢালা আনন্দে ভেসে যায়।
ভারতীয় উপমহাদেশে অবাঙ্গালীরা অন্যান্য দিনে ও অন্যন্যভাবে নববর্ষ উদযাপন করে। তামিলদের পুথান্ডু মোটামুটি বাঙ্গালীর নববর্ষের কাছাকাছি, মানে বৈশাখে, তেলেগুর উগাদী চৈত্র মাসে, মালিয়ালম পুথুভর্ষম হয় আগষ্ট মাসের মাঝামাঝি। শিখরা বৈশাখী পালন করে কারণ ওই সময় থেকে তাদের “খালসা”র জন্মলগ্ন শুরু হয়েছিল। বৈশাখীকে আসামে বলা হয় “রঙ্গলী বিহু”, কেরালায় বলা হয় “পুরম বিষ্ণু”। বৌদ্ধরা একে বিশাকা/ বিশাখা পুজা বা বুদ্ধ পুর্ণিমা বলে। থাইল্যান্ডে এটা বিশাখা বুচা, ইন্ন্দোনেশিয়াতে ওয়াইশাখ এবং শ্রীলঙ্কা ও মালয়তে দিনটিকে বলা হয় ওয়াসাখ।
পয়লা বৈশাখ বাঙ্গালীদের উৎসব হলেও বাংলাদেশ ও পশ্চিম বঙ্গে এর উদযাপনের পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। পশ্চিমবঙ্গে, সময়টাতে বিয়ের ধুম পড়ে যায়। আগের মাস অর্থাৎ চৈত্র মাসে দোকানে দোকানে “বিগ সেল” দেওয়া হয়। নতুন নতুন ব্যবসা ওই দিন থেকে শুরু হয়। নতুন বছরের নতুন হিসাবের বই বা হালখাতাও ঐদিন থেকে শুরু হয়। কালীঘাটের মন্দিরে পুণ্যার্থীরা ভীড় করতে থাকে দেবতার আশীর্বাদের জন্য। সারা দেশ জুড়ে নানা ধরণের মেলা হয়। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো ”নন্দন”, মানে রবীন্দ্রসদন মাঠের বাংলা সঙ্গীত মেলা। ইদানিং দিনটি আর একটু জমকালো করে যাপন করার চেষ্টা হচ্ছে।
তবে পয়লা বৈশাখের নববর্ষ বাঙ্গালীর জীবনে যে কি এবং কতটা, তা দেখতে হলে বাংলাদেশে যেতে হবে। এই নববর্ষ উদযাপন প্রধানতঃ পল্লী বাংলার জীবনযাত্রাকে তুলে ধরার নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে সঙ্ঘটিত হয়। বাড়ী বাড়ী ভুরি ভুরি খাবার, বিশেষ করে ভর্তা, কাঁচা মরিচ ও ইলিশমাছ ভাজা দিয়ে পান্তা, ও নানা ধরণের পিঠা ও মিষ্টির আয়োজন থাকে। মেলায় যাত্রা, পালাগান, কবিগান, জারিগান, গম্ভীরাগান, গাজীর গান ইত্যাদির অনুষ্ঠান হয়। বাউল, মারফতি, মুরশিদী, ভাটিয়ালী গানও হয়। আবার লাইলি-মজনু, শিরি-ফরহাদ, ইউসুফ-জুলেখা এবং রাধা কৃষ্ণের পালাও পরিবেশিত হয়। আজকাল গ্রামের চেয়ে শহরে নববর্ষ খুবই ঢক্কানিনাদ করে পালন করা হচ্ছে। ঢাকায় রমনা পার্কের বটতলায় বিপুল সংখ্যক লোক জমা হয় ছায়ানট পরিবেশিত রবীন্দ্রনাথের “এসো হে বৈশাখ” গান দিয়ে বর্ষবরণের মনমুগ্ধকর সঙ্গীতানুষ্ঠানের মাধ্যমে। একই রকম অনুষ্ঠান শিল্পকলা অ্যাকাডেমী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও হয়। এছাড়া টিভিতেও নানারকমের অনুষ্ঠান থাকে।
আজকাল বহির্বিশ্বেও, বিশেষ করে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, আমেরিকা, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পুর্ব এশিয়া ও পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের বাঙ্গালীরা, দেশের অনুকরণে পিঠা উৎসব, পান্তা ইলিশ, ভর্তা, ভাজির উৎসব ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে ।
এই বাংলা সন বা বঙ্গাব্দের সূত্রপাত কিন্তু কোন বাঙ্গালী করেননি। বাবার দিক থেকে চেঙ্গিস খান ও মায়ের দিক থেকে তামারলেন সম্প্রদায়ের রক্তে যার জন্ম, সেই মোগল সম্রাট বাবরের সুযোগ্য নাতি, মহামান্য বাদশাহ আকবরের আদেশে অনেক গবেষণা করে এই বাংলা ক্যালেন্ডার বা পঞ্জিকার সুত্রপাত হয়। ১৫৮৫ খ্রীষ্টাব্দের ১০ বা ১১ই মার্চ মোতাবেক ৯৬৩ হিজরী সনের ১০ইং রবিউল আউয়াল দিনটি “তারিখে ইলাহি” নামে প্রথম প্রবর্তিত হয়। তখন সম্রাট আকবরের শাসনামলের ২৯ বছর চলছে। অভিষেকের এতোদিন পরে এই পঞ্জিকার প্রবর্তন করা হলেও, কার্য্যতঃ তারিখ গণনা শুরু হয় অভিষেকের দিন থেকেই। ১৫৫৬ সালের ৫ইং নভেম্বর পাণিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে ইসলাম শাহের মহাপরাক্রমশালী সেনাপতি, হিমুর বিপুল ও দুর্ধষ্য সৈন্যদল ইতিমধ্যে দিল্লী ও আগ্রা দখল করে নিয়েছিল। ওদের প্রচন্ড শক্তির কাছে হেরে যাওয়াটা প্রায় অবশ্যম্ভাবী ছিল। তার মানে মুঘল সাম্রাজ্যের পতন এবং মুঘলদের ভারতবর্ষ থেকে চিরতরে বিদায় নেওয়া। কিশোর আকবর, তাঁর বিচক্ষণতা, দৃঢ় মনোবল, শৌর্য্যবীর্য ও অতি সুযোগ্য অভিভাবক বৈরাম খাঁর সুপরামর্শ কাজে লাগিয়ে সুকৌশলে এই যুদ্ধে জয়লাভ করেন। এভাবেই মুঘল সাম্রাজ্য অনিবার্য্য পতন থেকে রক্ষা পায়। এই ঐতিহাসিক জয়কে চিরস্মরণীয় করে রাখা ও আকববের অভিষেককে সম্মান প্রদর্শন করার উদ্দেশ্যেই “তারিখে এলাহি”র গণনা এইদিন থেকে শুরু হয়েছিল।
হিজরী ক্যালেন্ডার অনুযায়ী খাজনা আদায় করা হতো বলে বাংলার কৃষকদেরকে নিদারুণ মুসিবতের মধ্যে পড়তে হতো। কারণ হিজরী ক্যালেন্ডার চান্দ্রমাস বা লুনার ক্যালেন্ডার এর উপর ভিত্তি করে প্রস্তুত হয়েছিল। হিজরি ক্যালেন্ডারে ৩৫৪ দিনে বর্ষপূর্তি হয়। কিন্তু সৌরমাস বা সোলার ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বছর পূরণ হয় ৩৬৫ দিনে। অর্থাৎ প্রতিবছর ১০ বা ১১ দিনের তফাৎ থেকে যায় বছরের শেষ মাথায়। এভাবেই প্রতি তিন বছরে চান্দ্রমাস, সৌরমাস থেকে একমাস করে এগিয়ে যাচ্ছে। ফলে দেখা যায় রমজান মাস কখনো খ্রীষ্টমাস, কখনো বুদ্ধপুর্ণিমা, কখনো ইহুদিদের হানুকা, কখনো দুর্গা বা স্বরস্বতী পূজার সময় গিয়ে পড়ছে।
কৃষকদের একমাত্র রোজগার তাদের ক্ষেতের ফসল। সৌর ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ফসলটা একটা নির্দিষ্ট মাসে প্রতিবছর ওঠে, যদিও কয়েকদিন এদিক ওদিক হয়। ফসল বিক্রী করে সেসময়ে তাদের হাতে পয়সা আসে এবং সেভাবেই তারা খাজনা দিতে সক্ষম হয়। কিন্তু চান্দ্রমাস অনুযায়ী যদি ফসল ওঠার ৬ মাস আগে বা পরে বছর শেষ হয়, তখন তো কৃষকদের হাতের পয়সা খরচ হয়ে চরম দুর্ভোগের মধ্যে দিন চলছে। খাজনা দেবে কোত্থেকে? বাদশা আকবরের সভাসদ, মন্ত্রী ও বিখ্যাত আকবরনামা রচয়িতা পন্ডিত আবুল ফজল হিসাব করে দেখতে পেয়েছিলেন, যে সময়ে হিজরী সালের ৩১ বছর শেষ হয়, ঐ একই সময়ে সৌরসাল বা সোলার ক্যালেন্ডার গণনা অনুযায়ী ৩০ বছর শেষ হয়। অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে ফসল হচ্ছে ৩০ বার, আর খাজনা আদায় করা হচ্ছে ৩১ বার। মহামতি আকবরের কাছে মনে হয়েছে, এতে প্রজাদের উপর অধর্ম ও জুলুম করা হচ্ছে। অতএব তিনি এক ফরমান জারি করলেন যে, এমন একটা ক্যালেন্ডার তৈরী করতে হবে যাতে ফসল উৎপাদনের সময় বা অব্যবহিত পরে বছরটাও একই সময়ে শেষ হয়। এ ব্যাপারে তিনি সুবিখ্যাত পন্ডিত ও জ্যোতিষী, আমির ফতেহউল্লাহ শিরাজীকে নিযুক্ত করে এই দুরূহ কাজের ভার দেন।
শিরাজী সাহেব অনেক গবেষণা ও পরিশ্রমের পর সৌরমাস আর চান্দ্রমাস-এর সংমিশ্রণে যে নতুন ক্যালেন্ডারের প্রবর্তন করেন সেই সালের প্রথম নাম হয়েছিল “ফসলি সন” বা “এগ্রিকালচারাল ইয়ার”। পরবর্তীকালে এরই নাম হয় “বঙ্গাব্দ” বা বেঙ্গলী নিউ ইয়ার, যেটা এপ্রিলের মাঝামাঝি পড়ে। আকবরের রাজত্বকাল থেকেই এই ব্যবস্থার প্রচলন হয় যে বছরের শেষ মাসের শেষ দিনের মধ্যে খাজনা ছাড়াও যার যত বকেয়া ধার দেনা থাকে, সবই পরিশোধ করতে হবে। পরের দিন, অর্থাৎ নববর্ষ থেকে যাবতীয় হিসাব পত্র নতুন খাতায় লেখা হবে। তখন থেকে এটার নাম হয়, ”হালখাতা”। বকেয়া টাকাপয়সা পেয়ে মহাজনরা খুশী হয়ে খরিদ্দারকে মিষ্টিমুখ করাতেন। অনেক অনেক জায়গায় এই উপলক্ষে উৎসব ও মেলার আয়োজন করা হতো। বাঙ্গালীর জীবনে এই দিনটি এখন জাতীয় দিবসের রূপ নিয়েছে। প্রধান দুই কেন্দ্র, বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া, আজ পৃথিবীর যে কোন কোণে, যেখানে বাঙ্গালীরা আছে, সবাই যারপর নাই খুশী হয়ে, পরম উৎসাহে এই দিনটি পালন করে চলেছে।