তবুও ঈদ আসে

লেখক: জসিম মল্লিক Category: প্রবন্ধ (Essay) Edition: Dhaboman - Eid 2022

১.

ছোট্ট একটা কক্ষ। আমি দাঁড়িয়ে আছি। বসার জায়গা নেই। চারটা মাত্র চেয়ার। কোথায় বসব! মাথার উপর একটা পুরনো ফ্যান ঘুরছে। কিন্তু সেটা দিয়ে ক্যার ক্যার জাতীয় শব্দ ছাড়া আর কিছু হচ্ছে বলে মনে হয় না। আমার শার্টের তলায় শিড়দাড়া বেয়ে পিড় পিড় করে ঘাম নামছে। আমি টের পাচ্ছি। ওপাশে টিকেট মাষ্টার আলাউদ্দিন আহমেদ বিরক্ত মুখে লোকজনকে বোঝাচ্ছেন পরিস্থিতি। একফাঁকে আমার দিকে একটু তাকালেন। চেহারায় আশ্বাসের কোনো লক্ষন না দেখে আমি ভিতরে ভিতরে আতঙ্কিত হচ্ছি। চারটি চেয়ারের পিছনে আরো চারজন আমরা দাঁড়িয়ে । এরচেয়ে বেশী লোকের সঙ্কুলান ঘরটায় হচ্ছে না। বেড়িয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে।

আমি এসেছি বিআইডাব্লিউটিসির হেড অফিসে। আজ বিশ রোজা। আমি টিকেট বুকিং দিয়েছি প্রথম রোজার দিন। আজ থেকে ঈদের টিকেট দেয়া শুরু হয়েছে। এই অফিস থেকে রকেট স্টীমারের প্রথম শ্রেনীর টিকেট ইস্যু করা হয়। আমার গন্তব্য হচ্ছে বরিশাল। আমি এই ফাঁকে অফিসটার চেহারা সুরত পর্যবেক্ষন করছি। আমার অপেক্ষা করা ছাড়া গত্যন্তর নাই। সরকারী অফিসগুলোর হতচ্ছিরি চেহারা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। পুরোনো ভাঙ্গাচোড়া চেয়ার টেবিল, রং ওঠা টাইপ রাইটার, জং ধরা ফাইল কেবিনেট। একপাশে চা বানানোর সরঞ্জাম। নামাজের ব্যবস্থা। লোকজন বসে বসে কাজের চেয়ে গল্প করছে বেশী, মানুষের দুর্গতি দেখে হাসছে খিল খিল করে।

আমি স্টীমারে জার্নি করাটাই প্রেফার করছি। বছরে একবারই যাওয়া হয়। ঈদের সময় সেটা। স্টীমার জার্নিটা বেশ নিরাপদ এবং আরামদায়ক। এর আগে যেতাম লঞ্চে। কিন্তু লঞ্চের অভিজ্ঞতা অতি ভয়াবহ। একবারের একটা ঘটনা বলি। সেটা ঠিক ঈদের আগের দিন। মহাখালী থেকে রওয়ানা হয়েছি দপুর তিনটায়। লঞ্চ ছাড়ার কথা সন্ধ্যা ছটায়। মহাখালী থেকে সদরঘাট যেতে তিনঘন্টা সময় আমার কাছে যথেষ্ট মনে হয়েছে। সেটা ১৯৯৪ সালের কথা। তখন কী আজকের মতো এতো লোক ছিল ঢাকায়! এখন আড়াই কোটি কোটি তখন ছিল এক কোটি।

জগন্নাথ কলেজের কাছে এসে দেখি আর যাওয়ার উপায় নাই। অনড় পাথরের মতো সব থেমে আছে। মনে হচ্ছে এখানেই অনন্তকাল থাকতে হবে। আমরা টুস্ট্রোক অটো রিকশায় বসে আছি। সেটা থেকে ভক ভক করে নোংরা ধোঁয়া ছাড়ছে। চোখ মুখ জ্বলে যাচ্ছে বিষাক্ত ধোঁয়ায়। আমার দুটো শিশু ছেলে মেয়ে সাথে। ছেলেটা বমি করে মাখামাখি করে ফেলেছে ধোঁয়ায় অতিষ্ঠি হয়ে। মানুষ পিঁপড়ের মতো ছুটছে পায়ে হেঁটে। সে এক কঠিন অবস্থা। এদিকে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আমার বুকের মধ্যে টিক টিক করে উঠল। হাতে আছে মাত্র চলি­শ মিনিট। জেসমিনকে বল­াম আজকে নির্ঘাত লঞ্চ ফেল্। চলো এর চেয়ে আমরা ফিরে যাই। সময়মতো ঘাট পর্যন্ত পৌঁছতে পারবো না। জেসমিন বলল, গিয়েই দেখি না।

২.

আমরা নিরুপায় হয়ে অটোরিক্সা থেকে নেমে দুটো রিক্সা নিলাম। রিক্সা বাংলাবাজারের ভিতর দিয়ে কিভাবে যেনো আমাদের ঘাট পর্যন্ত পৌঁছে দিল। গিয়ে দেখি লঞ্চ ঘাটে নাই। মানুষের ভিড় এড়াতে মাঝ নদীতে নোঙ্গর করে রেখেছে। এখন কী করি! কিভাবে এখন লঞ্চে উঠবো! এদিকে কুলিদের টানাটানিতে বাক্স খুলে সব কাপড় চোপড় রাস্তায় গড়াগড়ি। আমি আবার বল­াম চলো ফিরে যাই। ওই মাঝ নদীতে এতো ছোটো বাচ্চা নিয়ে কিভাবে উঠবো! জেসমিন বলল, এতদুর এসে ফিরে যাবো! চেষ্টা করে দেখিইনা। ঘাটের লোকজন টানাটানি করে আমাদের উঠিয়ে দিল খেলনা টাইপ একটা ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকায়। আমাদের দেখা দেখি আরো কয়েকজন হুরমুর করে উঠে বসলো নৌকায়। নৌকা ছাড়লো। তাকিয়ে দেখি লঞ্চের কোথাও কোনো জায়গা নেই। শুধু মানুষ আর মানুষ। মনে হচ্ছে মানুষ দিয়ে একটা জলযান বানানো হয়েছে। এদিকে হুড়োহুড়িতে আমাদের নৌকা ডুবে যাবার মতো অবস্থা। জেসমিন ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠলো। যেকোনো সময় নৌকা  ডুবে যাবে। তাহলে কী আজকেই বুড়িগঙ্গায় সলীল সমাধি হবে! কেনো এতবড়ো বোকামী করলাম! আমাদের করুন অবস্থা দেখে সেদিন টহলরত নৌ পুলিশের একটা স্পীড বোট দ্রুত ছুটে এসে আমাদের উদ্ধার করল। সেই তরুন নৌ অফিসারটির কথা আমি কখনও ভুলবো না।

এই ঘটনার পর থেকে আর লঞ্চে জার্নি শেষ। আজকাল লঞ্চ জার্নি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। অতি মুনাফার লোভে লঞ্চ মালিকরা কোটা সিস্টেম চালু করেছে। তারা আইনের কোনো তোয়াক্কা করে না। মানুষের জীবনেরও কেনো মূল্য নাই। এরা ঘাট শ্রমিক থেকে লঞ্চ মালিক হয়েছে। এরা ডাকাত ছাড়া আর কিছু না। দু’ঘন্টা ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে আমি। আলাউদ্দিন সাহেব আর একবার অসহায়ভাবে তাকালো আমার দিকে। আমি ইশারায় জানালাম ব্যস্ত হবেন না ভাই সাহেব, আমি আছি। আমি বারোটায় এসেছি। মাঝখানে আলাউদ্দিন সাহেব একবার গেলেন নামাজ আদায় করতে। সাড়ে তিনটার দিকে আমার সুযোগ হলো কথা বলার।

কী খবর বলেন ভাই। দেখলেনতো অবস্থা।

টিকিট নিতে এসেছি।

আলাউদ্দিদন সাহেব খাতা খুলে কী যেনো দেখলেন। তারপর আমতা আমতা করে বলে­ন, আপনি তো বুকিং দিয়েছিলেন কিন্তু টিকিটতো দিতে পারবো না!

আমি ঘাবরে গিয়ে বল­াম কোনো!

টিকিট সব চলে গেছে।

এইটা আপনি কী বলে­ন! চলে গেছে মানে! কোথায় গেছে!!

আপনার জন্য দুটো রেখেছিলাম কিন্তু চেয়ারম্যান স্যার বললেন কাউকে আর টিকিট না দিতে। তার কোটায় রেখে দিয়েছেন, যদি কোনা মন্ত্রী মিনিষ্টার যায়!

তাহলে উপায়! আমি কী ঈদ করতে যেতে পারবো না!

আমি নিরুপায় স্যার।

আমি একটু রেগে বললাম, এইটা তো ঠিক হইলো না। টিকিট আমার চাই।

আলাউদ্দিন সাহেব আমাকে যেকোন কারনেই হোক পছন্দ করেন। তিনি বলে­ন, আপনি একটু কষ্ট করে চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে যান।

আমি বললাম সামান্য একটা টিকিটের জন্য তার কাছে যাবো!

প্লীজ।

৩.

আমি গেলাম। গিয়ে দেখি তিনি ব্যস্ত। তার পিএ বলল, দেখা হবে না। স্যার ব্যস্ত আছেন। আমি লোকটার চোখের দিকে পলকহীন তাকিয়ে থেকে একটা কার্ড দিয়ে গম্ভীরভাবে বল­াম, এটা দিন। তিনি কি মনে করে ভিতরে গেলেন। ফিরে এসে বলে­ন একটু বসেন স্যার। আমি মনে মনে আশার আলো দেখলাম। কিছুক্ষন পর আমার ডাক পরলো। চেয়ারম্যান সাহেব কিছুক্ষন খাজুরে আলাপ করে নিজের গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করলেন। তারপর ইন্টারকমে ফোন করে আলাউদ্দিন সাহেবকে বলে­ন, আমাকে রাউন্ডট্রিপ টিকিট দিতে।

এই যে মানুষের ঈদে ঘরে ফেরার ব্যকুলতা এর কোনো তুলনা হয় না। শত কষ্ট সহ্য করে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রিয়জনের সাথে মিলিত হওয়ার এই তাড়না সত্যি অসাধারন।

কিন্তু আমরা যারা দূর প্রবাসে থাকি আমাদের ঈদ কেমন?।

এখানেও রোজা আসে, তারাবি হয়, ইফতার পার্টি হয়। সবকিছুই হয়। কিন্তু কোনোভাবেই তা দেশের মতো না। দেশে যেমন রোজা শুরু হলেই একটা উৎসবের আমেজ তেরী হয়। ইফতার পার্টি, আজকাল হয় সেহরি পার্টি এবং তা হোটেলে। কেনা কাটা, ঈদের বোনাস, লাইটিং, ঈদ ফ্যাশন, ঈদ সংখ্যা পত্রিকা,  টিভিতে ঈদের বিশেষ অনুষ্ঠান, সিনেমা হলে নতুন সিনেমা মুক্তি পাওয়া কত কি। প্রবাসে এসব কিছুই নেই। প্রবাসে ঈদের দিনটা উইকএন্ডে হবে কিনা এই নিয়ে চলে গবেষনা। কারন উইকডেজে হলে ঈদের দিন কাজে যেতে হবে। বাচ্চাদের যেতে হবে স্কুলে। এবার অবশ্য স্কুল বন্ধ থাকবে। কারন  তখন সামারের ছুটি হয়ে যাবে। দেশে যখন সবাই ঈদ উৎসবে মেতে থাকবে তখন প্রবাসে আমাদের থাকতে হয় কাজের জায়গায়। কারন এবার ঈদ হবে কাজের দিন। কখন ঈদের দিনটা চলে যায় টেরও পাওয়া যায় না। বাসে সাবওয়েতে বসে বা গাড়ির ড্রাইভিং সীটে হাত রেখে আর চোখের জলে বাবা মা ভাইবোনদের কথা মনে পড়ে যায়। যারা বাবা-মা কে হারিয়েছেন বা হারিয়েছেন কোন আপনজনকে তাদের কথা বেশি বেশি মনে পড়ে এই দিনে। প্রবাসে অনেক সন্তান হারা মা লুকিয়ে কাঁদেন। তার যাদু আর ফিরবে না এই আনন্দের দিনে।

যাদের বৃদ্ধ মা-বাবা, ভাই-বোন রয়েছে দেশে, কোন এক নির্জন মুহূর্তে সে-কি চোখের পানি ফেলবে না! কেউ কেউ ঈদের দিন কাজের মধ্যেই আনমনা হয়ে পড়বে। বাসে, সাবওয়েতে চলার সময় খুব গোপনে একটু কেঁদে নেবে। অনেকেই ঈদের দিন আপনজনদের ফোন করবে। সার্কিটগুলো ব্যস্ত হয়ে পড়বে। যে মায়ের একমাত্র মেয়ে বা একমাত্র ছেলে বিদেশ থেকে ফোন করবে সেই মার কণ্ঠ জড়িয়ে আসবে আবেগরুদ্ধ কান্নায়। যে ব্যক্তি অনেকদিন তার স্ত্রী-সস্তানকে রেখে এসেছেন তার বুকটা খা খা করবে! আমি যেমন আমার মায়ের সাথে কথা বলতে পারবো না। আমার মা আর ফিরবেন না। এই বেদনা আমাকে তাড়িয়ে বেড়াবে।

আনন্দ বেদনার ঈদের নাম হচ্ছে প্রবাস ঈদ। অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও নিজের মতো করে আনন্দ খুঁজে নেয় প্রবাসীরা। এখানেও রোজা হয়, ইফতার পার্টি হয়, তারাবির নামাজ হয়, ঈদের নামাজ পড়ে, কোলাকুলি করে, বেড়াতে যায় বন্ধুর বাড়িতে। কিন্তু তারা প্রিয়জন থেকে অনেক অনেক দুরে। তাদের শূন্যতা কিছু দিয়ে পূরন হবার নয়।