জীবন সাথী

লেখক: সুজয় দত্ত Category: ছোট গল্প (Short Story) Edition: Dhaboman - Eid 2022

 

ফল খেয়ে ফলের আঁটি যেখানে সেখানে ছুঁড়ে ফেলার অভ্যাসটা ছোটবেলায় অনেকের মতো আমারও ছিল। শুধু দুটো ব্যতিক্রম ছাড়া। লিচু আর কাঁঠাল। লিচুর বীচিতে আলপিন গেঁথে তার মধ্যে কাগজ বা তালপাতার ঈষৎ বাঁকানো ব্লেড ঢুকিয়ে পাখা বানাতাম আমরা। সে-পাখা দমকা হাওয়ায় বনবন করে ঘুরত। আর কাঁঠালবীচি পোড়া বা চচ্চড়ি খেতে বাড়ীশুদ্ধ সবাই ভালবাসত।  তাই ওদুটো ছিল মূল্যবান সম্পদ। আমের আঁটি  সেরকম না। ভাল করে চোষা হয়ে গেলে বাড়ীর বারান্দায় বা ছাদে দাঁড়িয়ে কচি হাতে যত জোর আছে সব দিয়ে মাঠে পুকুরে নালায় রেললাইনে -- যেখানে পারতাম ছুঁড়ে দিতাম।  

কচি হাতের নিশানা তো, মাঝেমাঝে ফস্কে গিয়ে বাড়ীর বাগানেই পড়ত ওগুলো। কাক এসে ছোঁ মেরে নিয়ে যেত। একটা বোধহয় নেয়নি। সেবার বর্ষায় দেখি কচি কচি লালচে খয়েরী পাতা-অলা একটা চারা বাড়ীর পুবদিকের পাঁচিলের কাছে। সেই বয়সে গাছপালায় আগ্রহ আমার খুব একটা ছিলনা। ওই, মা যখন বাগানে ঘুরে ঘুরে পুজোর জন্য জবা, অপরাজিতা, টগর আর বেলফুল তুলত, আমিও হয়তো একটু সাহায্য করতাম, আর পেয়ারা বা পেঁপে গাছে ফল ধরলে ঢিল মেরে মেরে সেগুলো পাড়ার চেষ্টা করতাম। কিন্তু কেন জানিনা ওই সদ্য মাথা তোলা চারাটার ওপর শুরু থেকেই আমার কেমন একটা মায়া পড়ে গেল। ভরা বর্ষায় জলটল তো আর দিতে হতনা, শুধু প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে কৌতূহল নিয়ে দেখতাম কতটা বাড়ল। মা হেসে বলত, "সারাদিনে তুই যতটা বাড়িস, ও-ও ততটা বাড়ে। তুই যদি লক্ষ্মীছেলে হয়ে যা দেব সব খেয়ে নিস্, দেখবি ও কেমন তরতর করে লম্বা হয়।" বাবার তখন জোয়ান বয়স, শক্তসমর্থ হাতে নিজেই বাগানটার পরিচর্যা করত, অবাঞ্ছিত গাছগাছালি আর আগাছা উপড়ে উপড়ে ফেলত। বলল, "বাজার থেকে তো ভালজাতের আম ছাড়া আনিনা, এও মনে হচ্ছে সেরকমই গাছ।" ব্যস, রয়ে গেল সে বাগানের একধারে।

ক্লাস ফাইভ থেকে সিক্সে ওঠার পর যখন সকালবেলার বদলে দুপুরে স্কুলে যাওয়া শুরু হল, ততদিনে আমি বুঝে গেছি মা ওটা ঠিক বলেনি। ওই গাছটা আর আমি মোটেই প্রতিদিন সমান সমান বাড়ি না। আমাকে লোকে বলে লম্বা, কিন্তু ও তো আমার চেয়েও লম্বা এখন। চওড়াও। ঝাঁকড়া সবুজ পাতায় প্রাণবন্ত। পাঁচিলের মাথাটা সবে ছাড়িয়েছে, উঁকি মারতে শুরু করেছে পাশের বাড়ীতে। এইসময় থেকে একটা নতুন রেওয়াজ চালু হল। এতদিন মা শুধু বৃহস্পতিবার বাজার থেকে ফুলের প্যাকেটের সঙ্গে যে আমপাতা আসত তাই দিত ঠাকুরকে। এখন প্রতিদিন ওই গাছ থেকে পাতা ছিঁড়ে দিতে আরম্ভ করল। বাগানের অন্য সব গাছের ব্যাপারে উদাসীন হলেও ওই গাছটাকে কেউ কিছু করলে আমার খুব গায়ে লাগত। কখনো কখনো পছন্দসই পাতা বেছে নিতে মা দরকারের চেয়ে বেশী ছিঁড়ে ফেললে আমি প্রতিবাদ করতাম। বলতাম, রোজ আমার চুল আঁচড়ে দিতে গিয়ে বুঝি তুমি সব টেনে তুলে ফেল?

ছোটবেলা কারো চিরদিন থাকেনা। সময়ের অমোঘ নিয়মে একদিন আমারও গলার স্বর পাল্টে গেল। চিবুক, গাল আর ঠোঁটের ওপরের জমি উর্বর হয়ে উঠল। এক বসন্তে দেখি, গাছটাতে মুকুল ধরেছে। সারাদিন ভ্রমর আর মৌমাছিদের ব্যস্ত আনাগোনা তাকে ঘিরে। সেবছর আমার প্রিটেস্ট পরীক্ষার ফল বেরোনোর আগেই দেখলাম ওর ডালে ডালে ঝুলছে কচি সবুজ ফল। ততদিনে আমাদের বাড়ীর ছাদের আলসে ছাড়িয়ে গেছে ও, ছাদে দাঁড়িয়ে অনায়াসে নাগাল পাওয়া যায়। আমার কিন্তু হাত বাড়িয়ে টপাটপ পেড়ে নিতে ইচ্ছে করত না সেই কাঁচা আম ---  শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে ভাল লাগত অলস দুপুরের উদাসী হাওয়ায় কেমন ওগুলো দোল খাচ্ছে। মাঝে মাঝে ঝড়ে দুচারটে খসে পড়লে মা তাই দিয়ে আম-ডাল আর অম্বল করত।

প্রতিবছর নয়, একবছর অন্তর ফল হতো ওই গাছে। আমি স্কুলের গন্ডী পেরিয়ে কলেজে যাওয়ার আগে আরও একবার হয়েছিল। তারপর বাড়ী ছেড়ে আমি থাকতে চললাম কলেজের হোস্টেলে। ছুটিছাটায় বাড়ী এলে দেখতে পেতাম  ওকে। ততদিনে বিশাল মহীরুহ হয়ে গেছে ও, বাগানের পাঁচিলটায় ওর গুঁড়ির ভারে ফাটল ধরেছে। শেষকালে সেই পাঁচিল ভেঙে ওকে গোল করে বেড় দিয়ে আবার তৈরী করতে হল। এইসময় আমার এক গরমের ছুটিতে একটা ঘটনা আমাদের সকলকে নাড়িয়ে দিয়ে গেল। আমি তখন কলেজের তৃতীয় বর্ষে। বর্ষা এসে গেছে কলকাতায়। এক বিকেলে আকাশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত যখন ঘন বাদলমেঘে অন্ধকার আর তাকে মুহুর্মুহু চিরে দিচ্ছে বিদ্যুতের ঝলকানি, বাবা বসবার ঘরের পুবদিকের জানালাটা বন্ধ করছিল বৃষ্টি আসবে বলে। আমি তখন পাশের ঘরে। হঠাৎ বাজ পড়ার প্রচন্ড আওয়াজের সঙ্গে ভারী কিছু মেঝেতে সজোরে আঘাত করার শব্দ। আমি আর মা ছুটে পাশের ঘরে গিয়ে দেখি বাবা ছিটকে পড়ে আছে জানলা থেকে বেশ কিছুটা দূরে মাটিতে, আর পাশেই উল্টে আছে গোল টেবিলটা। তাড়াতাড়ি তুলতে যেতেই দেখলাম বাঁ হাতে দারুণ যন্ত্রণা বাবার। সম্ভবতঃ ভেঙেছে। আর বাইরে তাকিয়ে দেখি আমগাছটার একটা বড়, মোটা ডাল একদম ঝলসে গেছে।

বাবার সে-হাত আর আগের মতো শক্ত হয়ে জোড়া লাগেনি কখনো। কমজোরীই রয়ে গেছিল। আর গাছের সেই ন্যাড়া ডালটা কাটতে গিয়েও কাটা গেলনা, কারণ বাড়ীর ঠিক সামনে যে বৈদ্যুতিক পোস্টের তার খাটানো আছে, ওই ডালের শাখাপ্রশাখা তাতে এমনভাবে জড়িয়েছে যে কিছু করতে গেলেই অনর্থ হবে। এর বছরদুয়েক বাদে আমার জীবনে যে অধ্যায়টা শুরু হল, তাতে অন্য অনেককিছুর সঙ্গে ওই গাছটা থেকেও অনেক দূরে সরে গেলাম আমি। প্রবাসে পাড়ি দিলাম উচ্চশিক্ষার জন্য। কিছুদিন অন্তর অন্তর ফোনে কথা বলার সুযোগ হত যখন বাড়ীতে, অল্প সময়ের সেই আলাপচারিতায় এত অন্য কথা জমে থাকত যে গাছের  প্রসঙ্গ উঠতেই না। আর এমনই ভাগ্য, আমার লম্বা ছুটিতে বাড়ী আসা ঘটনাচক্রে সবসময়ই হত সেই বছরগুলোয় যখন গাছটায় ফল ধরে না। তবে দেখে পুলকিত হতাম যে মা নিজের হাতে আমের জেলি আর আচার বানিয়ে বয়ামে ভরে রেখে দিয়েছে আমার জন্য। এরকমই এক ছুটিতে বাবার কাছে জানলাম, বাগানের নতুন মালি বলছে গাছটার শেকড়ে নাকি পোকা ধরেছে, ওষুধ দিতে হবে। একটু মনখারাপ নিয়েই ফিরে গেছিলাম সেবার --- আগে তো কখনও এরকম শুনিনি। হায়, তখন যদি জানতাম এটা স্রেফ মন খারাপের প্রথম পর্ব ----          

সেবছর শীতটা শুনেছিলাম খুব জাঁকিয়ে পড়েছে কলকাতায়। তার সঙ্গে দিনের পর দিন মেঘলা আকাশ আর ঘন কুয়াশা। বাবার আবার সারাবছর ভোরবেলা উঠে বাগানে পায়চারী করার অভ্যাস। একদিন ফোনে শুনলাম কথা বলতে গিয়ে কাশছে। আমার উদ্বেগকে তেমন পাত্তা দিলনা, বলল দুদিন বাদে আপনিই ঠিক হয়ে যাবে। দুদিন কেন, দুসপ্তাহ পরেও সে-কাশির যাবার নাম নেই। বরং তার ঘনঘনত্ব বাড়তে লাগল। শুকনো কাশি, সঙ্গে হালকা জ্বর। মাকে বললাম যেন এক্ষুণি পাড়ার ডাক্তারকে একবার দেখিয়ে নেয়। আমার তো শুনে ভাল মনে হচ্ছেনা। তিনদিন পর খবর পেলাম ডাক্তার বলেছেন ব্রংকোনিউমোনিয়া। দুই ফুসফুসেই ছড়িয়েছে। ওষুধ শুরু হল, কিন্তু দেখা গেল সারছে না কিছুতেই। বাড়ীর একটু দূরেই বড় হাসপাতাল। পাড়ার ডাক্তারের সুপারিশে সেখানকার বিশেষজ্ঞকে দেখাতে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তিনি জানালেন এ সাধারণ সংক্রমণ নয় --- নাছোড়বান্দা জীবাণু। সুতরাং ভোগান্তি আছে।

অবশেষে শীত পেরিয়ে বসন্তে বাবা খানিকটা সুস্থ হল। তবে দুর্বলতা কাটল না। কয়েকমাস বাদে সেবছর ডিসেম্বরে কোনোরকমে ছুটি জমিয়ে অল্প কদিনের জন্য কলকাতা গেলাম। বাবা আগের বছর শীতকালে যে কান্ড বাধিয়েছিল, সেই ভয়ে  ঠান্ডা থেকে যথাসম্ভব বাঁচিয়ে রাখলাম। কিন্তু এবার দেখি নতুন উপসর্গ। হাঁটাচলা বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, দিনরাত বাড়ীতে বসে থাকায় পায়ের গাঁটে গাঁটে ধরল ব্যথা। শুনেছি আর্থ্রাইটিস আমাদের বংশগত। ডাক্তার পায়ের কতকগুলো ব্যায়াম শিখিয়ে বললেন আরো বাড়াবাড়ি হলে ওষুধ দেবেন। অন্যদিকেও ভাল খবর নেই। সেই যে বছর দেড়েক আগে গাছটার শেকড়ে ঘুণ ধরেছিল, মাটি খুঁড়ে ওষুধ-টষুধ দিয়েও খুব একটা উপকার হয়নি। মালি জানাল শেকড়ের একাংশ নাকি ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। তাই বোধহয় আগের চেয়ে একটু যেন নিস্তেজ এখন। শুনলাম এবছর গরমে ফলও  দিয়েছে কম।

তার পরের বছর জ্যৈষ্ঠ্য মাসে আরেক বিপত্তি। আমাদের বাড়ীর পাঁচিলের পূর্বদিকের জমিটা এতদিন ফাঁকা ছিল, ঝোপঝাড় আর বড় বড় ঘাসে ভর্তি, গরু-ছাগল চরতে আসত মাঝে মাঝে। হঠাৎ একদিন কলকাতায় সাপ্তাহিক ফোনালাপের সময় শুনলাম জমিটার মালিক জঙ্গল সাফ করাচ্ছে, শিগগিরই বাড়ীর ভিত খোঁড়া শুরু হবে। এখন, পাঁচিলের ধারের আমগাছটার সিংহভাগ যেহেতু সেই জমিতেই ঝুঁকেছে, ওটা থাকলে  বাড়ীর দোতলা তোলা অসম্ভব। তাই বাবাকে অনুরোধ করা হয়েছে গাছটা কাটিয়ে ফেলার। এর উত্তরে বাবা কী বলেছে সেটা ফোনে না শুনলেও চলত, কারণ আমি জানি কী প্রতিক্রিয়া হবে। আমারও যে সেই একই কথা। বাড়ীর দোতলা তো আর এখুনি উঠছে না। আগে একতলা হোক, প্রতিবেশীরা এসে উঠুক, তারপর ভবিষ্যতে দেখা যাবে। কিন্তু শুনলাম সেই লোকটি নাছোড়বান্দা --- দোতলার রাস্তা পরিষ্কার না করে বাড়ী তৈরীতে হাতই দেবে না। বলেছে বাবাকে নাকি কিচ্ছু চিন্তা করতে হবেনা, তারাই পয়সাকড়ি খরচ করে কাঠুরে ডেকে কাটিয়ে নেবে। এমনকী সমস্ত আমকাঠ বয়ে এনে আমাদের বাগানের একপাশে বা সিঁড়ির তলায় রেখে দিয়ে যাবে। ভাল আমকাঠের বাজারে দাম আছে। শুধু অনুমতিটুকু পেলেই ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলা যায়। আমি আর কী বলব --- বুঝলাম সেই হবু বাড়ীঅলার পক্ষে হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব নয়  প্রস্তাবটা আমাদের কানে কীভাবে বাজছে।  যেন চন্দনকাঠের চিতার দাম এবং মৃতদেহ নিয়ে শোভাযাত্রার খরচ দিয়ে  দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে কেউ আমাদের কোনো আত্মীয়কে খুন করার অনুমতি চাইছে।

বিষয়টা কীভাবে কিছুদিনের জন্য ধামাচাপা দেওয়া যায় আর এই অবশ্যম্ভাবী আত্মীয়বিয়োগ অস্থায়ীভাবে হলেও ঠেকিয়ে রাখা যায়, আমি সেই  নিয়ে ভাবনাচিন্তা করতে করতেই একদিন খবর পেলাম যা ভয় পাচ্ছিলাম সেটা ঘটে গেছে। বাবার সঙ্গে বেশ একটু ঝগড়াই হয়ে গেছে জমির মালিকের। একদিন নয়, দুদিন। প্রথমদিন চাপান-উতোর, দ্বিতীয়দিন উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়। বিদেশে যে ক্লিশেটা প্রায়ই শোনা যায়, সেই "ওভার মাই ডেডবডি" গোছের কিছু একটা বলে বসেছে সেদিন বাবা। উত্তরে শুনতে হয়েছে প্রয়োজনে অন্য রাস্তায় হাঁটার হুমকি। এটা জানার পর আমার পক্ষে অবিচলিত থাকা মুশকিল। ফোনে বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম গাছটা তো আর আগের মতো নেই -- গোড়া-পচা, ডাল-ঝলসানো, আধা-নিস্তেজ, আগের মতো ফলবানও নয়। ওটাকে আর আঁকড়ে থেকে বোধহয় লাভ নেই। ঝামেলাই বাড়বে শুধু। ওপ্রান্ত থেকে যে জবাব ভেসে এল, তা আমাকে অনেকদিনের জন্য চুপ করিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট, "হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমারও তো হাঁটু ফোলা, হাঁপানির রোগ, প্রেসারের রোগ -- দুটো ঝামেলাই একসঙ্গে বিদায় কর।“

গাছ কাটা নিয়ে বাবার সঙ্গে সেই শেষ কথোপকথনের পর মাসদুয়েক আর বলার মতো কিছু ঘটেনি। পাশের জমির মালিক সম্ভবতঃ মিউনিসিপ্যালিটির কাছ থেকে বাড়ীর প্ল্যানের সবুজ সংকেত আদায় করতে গিয়ে লালফিতেয় ফেঁসে গেছে, তাই সাময়িকভাবে চুপচাপ। সেবার শ্রাবণ মাসে কলকাতায় খুব বৃষ্টি হচ্ছে শুনলাম -- অন্য বছরের তুলনায় বেশীই। সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে আমি যেখানে থাকি, সেখানেও 'সামারের' দ্বিতীয়ার্ধটা দেখলাম বৃষ্টিতে বৃষ্টিতে সিক্ত। প্রকৃতির এতো অশ্রুবর্ষণ দেখলে কেন জানিনা মনের ভেতরটায় নানারকম আশংকা জাগে। ঝড়জলের মধ্যে মা একা একা অসুস্থ বাবাকে নিয়ে কী করে সব সামলাচ্ছে -- এইসব চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকে মাথায়।  কাজের ফাঁকে ফাঁকে। কাজের চাপও এবার প্রচুর। ভাদ্রের এক মেঘলা সকালে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে আমার অফিসে কাজে ডুবে আছি, এমন সময় মোবাইল মুখর হয়ে উঠল। আরেঃ, এ যে কলকাতার নম্বর!  কী ব্যাপার? মা তো এই সময়ে ফোন করে না। ফোনের ওপ্রান্তে দেখলাম মা নয়, দিদি। তারপরেই যেটা শুনলাম, তাতে এক লহমায় ওলোটপালোট হয়ে গেল সবকিছু। আচমকা স্ট্রোক হয়েছে বাবার -- আমি এক্ষুণি একবার এলে বড় ভাল হয়।

রুদ্ধশ্বাসে কোনোরকমে টিকিট কেটে প্লেনে চড়ে বসলাম। দীর্ঘ যাত্রা। প্রতিটা পল-অনুপল যেন একেকটা বছর। মনে প্রতি মুহূর্তে একটাই প্রশ্ন। পৌঁছে কি তাহলে আর বাবাকে --- ? না, তা হয়নি, কলকাতায় পৌঁছে দেখতে পেয়েছিলাম বাবাকে। তবে বাড়ীতে নয়, হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে। একগাদা জটিল যন্ত্রপাতির কাছে আত্মসমর্পণ করে শুয়ে থাকা অসহায় একটা শরীর। সেদিন সন্ধ্যের দিকে একটু সংজ্ঞা ফিরল যখন, বুঝলাম আমায় দেখে চিনতে পারল না। মুখে বললাম আমি কে। তখন নিজের দুর্বল, সূচিবিদ্ধ হাত দিয়ে চেপে ধরল আমার দুহাতের মুঠি। বাইরে তখন অঝোরে বৃষ্টি।   চারিদিক ভিজে। ভেতরটাও ভিজে -- চোখের বৃষ্টিতে। সেই বিনিদ্র রাতটা কাটালাম আমি, দিদি আর মা -- সোফায় বসে, পাথরের মূর্তির মতো। অবশেষে সকাল হল, কিন্তু আলো কোথায়? আকাশেও আলোর দেখা নেই, ঘন কাল মেঘে ঢাকা, সঙ্গে বৃষ্টি আর ঝোড়ো হাওয়া। হাসপাতাল থেকেও কোনো আশার আলো নেই। দিন যত গড়াল, বাড়তে লাগল ঝড়ের তীব্রতা। বিকেলে ফোন এল রোগীর অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে, এখুনি একটা দামী জীবনদায়ী ওষুধের তিনটে ডোজ কিনে দিতে হবে। ছুটলাম সঙ্গে সঙ্গে। একটা ছাতা নেওয়ার কথাও মাথায় এল না। সেই যে পা রাখলাম হাসপাতাল চত্বরে, সেদিন আর বাড়ী ফিরিনি। আই সি ইউ-এর যান্ত্রিক শীতলতায় জীবনযুদ্ধে লড়ছে একজন, আর সে-ঘরের বাইরে বসে মনের সঙ্গে যুদ্ধ করছি আমি। প্রকৃতিতেও তখন যুদ্ধ চলছে -- প্রবল ঝড়ের সঙ্গে গাছপালাদের। হাসপাতালের দু-একটা খোলা জানলা দিয়ে নজরে আসছে সে-দৃশ্য। নুয়ে নুয়ে পড়ছে উঁচু উঁচু নারকোল আর সুপারি গাছগুলো।

সব যুদ্ধই একদিন শেষ হয়। এক্ষেত্রেও ভোরের দিকে সব শান্ত হয়ে গেল। হ্যাঁ, সবকিছু। আই সি ইউয়ের ভেতরে হার্ট মনিটরের ওঠানামা, বাইরের উথালপাথাল ঝড়, এবং কী আশ্চর্য্য -- আমার মনও। আজও ভাবি, সেই রাতে ডাক্তার যখন নতমুখে এসে জানালেন তাঁদের যুদ্ধ শেষ এবং তাঁরা পরাজিত, কী করে ভাবলেশহীন গলায় তাঁদের চেষ্টার জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেছিলাম, "বাড়ীতে মাকে খবরটা দিয়ে আমি এখুনি আসছি সব সইসাবুদ আর পাওনাগন্ডা মেটাতে"। হাসপাতাল চত্বর থেকে বেরিয়ে বাড়ীর দিকে হাঁটতে শুরু করলাম যখন, মনে কোনোরকম অনুভূতি নেই, আবেগের সমুদ্রে আছড়ে পড়ছে না কোনো ঢেউ। হাঁটতে হাঁটতে বাড়ীর কাছাকাছি এসে দেখি চারিদিকে যুদ্ধের ধ্বংসাবশেষ। কোনো বাড়ীর জানলা ভেঙেছে, কোনো বাড়ীর পাঁচিল ধসেছে, কারো আবার উড়েছে চিলেকোঠার করুগেটেড টিনের চাল। আর সেই যুদ্ধক্ষেত্রে র মাঝে ভূমিশয্যা নিয়েছে এক বিশাল মহীরুহ। তার ঝাঁকড়া সবুজ ডালপালা এখনও ভোরের মৃদু হাওয়ায় আন্দোলিত হচ্ছে -- যেন কত জীবন্ত। আমাদের পাঁচিলের ধারে তার শেকড়ের জায়গাটায় এক বিশাল শূন্য গহ্বর। সেদিকে চোখ পড়তে মনে হল নিজের বুকের ভেতরটার কথা।

মা আমাকে দেখে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত চেহারায় বেরিয়ে এসে তাড়াতাড়ি গেটের তালা খুলে বলল, "দেখ না কী কান্ড ! কাল রাতে আমগাছটা --"। উত্তরে আমার ভেতর থেকে কে যেন বলে উঠল, "হ্যাঁ, তাই তো হবে, তাই তো হওয়ার কথা --"