আহত নদীর মত

লেখক: আনজুমান রোজী Category: ছোট গল্প (Short Story) Edition: Dhaboman - Eid 2022

 

 

পলা একা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায় ছোট্ট এক শহরের দিকে। শহর তো নয় যেন ছোট্ট গ্রাম। গ্রামে নাগরিক জীবনের সবরকম সুযোগ সুবিধা আছে বলে একে শহরও বলা যেতে পারে। পশ্চিমা দেশের গ্রামগুলো এমনি। কোথাও মানুষের কোলাহল নেই। শুধু বাতাসের মৃদুমন্দ শব্দ। এখানে শুনশান নিরবতায় পাখপাখালিও  ধ্যানে বসে থাকে। পলা এমন পরিবেশে ছুটে আসে বুকভরে নিঃশ্বাস নিতে, প্রশান্তির ছোঁয়া পেতে।

মনের সৌন্দর্যকে ধরে রাখার সবরকম কসরত হলো, নির্জনতা খুঁজে বেড়ানো। পলা  তা-ই করে বেড়ায়। এই খুঁজে বেড়ানোটাও এখন একধরণের নেশার মতো হয়ে গেছে। স্টিয়ারিং এর উপর এক হাত রেখে শিথিল মেজাজে গাড়ি চালাচ্ছে পলা। নির্জন পথ। পথের দুপাশে সবুজ দিগন্ত। এমন নির্জনতায়  নিজেকে পেয়ে বসে। শুরু হয়ে যায় নিজের সাথে নিজের কথা বলা। ধীরেধীরে জেগে উঠে পলার  ভেতরের  'আমিত্ব'।

একাকিত্বকে পলা সাদরে বরণ করে নিয়েছে। নিজের মধ্যে ডুবে একধরণের আনন্দ কুড়ায় সে।  কল্পনার ডালপালা ছড়িয়ে সেখানে মায়াজাল বিস্তার করে। তার একাকী জীবন নিস্তরঙ্গ নদীর মতো নিরবচ্ছিন্ন বয়ে যায়। কখনো নিজেকে সময়ের উপর ছেড়ে দেয়, আবার কখনো মনের ডাকে সাড়া দিয়ে ছুটে যায় এখানে সেখানে। একেবারে মন্দ সময় কাটছে না। কে বলে, একাকী জীবন গোরস্তানের মতো!

পলা এখন বুঝতে পারে,  হৃদয়ের ভেতর গভীর থেকে আরও গভীরে চলে গেলে কম ভয়, বিচ্ছিন্নতা এবং একাকিত্বের সংসারে বাস করা সম্ভব। একাকিত্ব কিম্বা নির্জনতায় মন শক্তি অর্জন করে এবং নিজের উপর ঝুঁকতে শিখায়। আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। আবার একাকিত্বের  সবচেয়ে খারাপ বিষয় হলো এটি নিজেকে নিজের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। তাও ভালো নিজের কাজের জন্য তো অন্যের কাছে কোনো জবাবদিহি করতে হয় না!

 লেকের পাশে এসে গাড়ি পার্ক করে ধীর পায়ে জলের দিকে হেঁটে চলে পলা। এটি অন্টারিও লেক। জলের শিথিলতা মনকে আরো উদাস করে তোলে। ঝিরিঝিরি বাতাসে পাতাদের নাচন দেখতে দেখতে  পলা জলের কাছে চলে যায়। একটা বড় পাথর খণ্ড দেখে তার উপর গিয়ে বসে। মাথা থেকে একাকিত্বের ভাবনাটা আর যাচ্ছে না। নিষ্পলক চেয়ে থাকে জলের দিকে। মনের অজান্তেই সেখানে ভেসে উঠে একটি মুখ। গুরুগম্ভীর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এক মানুষ। সুপুরুষ বটে। ভাবনাটা আসলে তাকেই ঘিরে। কিন্তু বোঝাপড়াটা চলছে নিজের একাকিত্বের সঙ্গে। 

চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকায় পলা। নিজ মনে রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর একটা কথা বিড়বিড় করে বলে উঠে, “একা থাকার এই ভালো লাগায় হারিয়ে গিয়েছি, নিঃসঙ্গতা আমাকে আর পাবে না।” আসলে একাকী জীবনযাপনেই তো সমস্ত স্বাধীনতার সূচনা! এমন স্বাধীনতার আস্বাদ কে হারাতে চায়! তারই মাঝে যে পলার বিচরণ! অথচ  হৃদয় কুটিরে শোভন নামের মানুষটি কেবলই উঁকিঝুঁকি দিয়ে যাচ্ছে।

এলোমেলো ভাবনায় পলা ডুবে যায়। আজ যে কি হয়েছে তার, বুঝতে পারছে না। অবচেতন মনে নিঃসঙ্গতা, একাকীত্ব, নির্জনতা এসে ভর করছে। ভাবনার খেই হারিয়ে ফেলছে। যতই নিজের পথচলার ছন্দটা ধরতে যাচ্ছে ততই ছন্দহীন হয়ে যাচ্ছে। তবে কি তার একাকিত্বের আনন্দে শোভন ঝড় তুলছে! পলা বুঝতে পারে সব। তারপরও নিজের সাথে নিজের এই দ্বন্ধে কেমন যেন ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে!

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগেই পলা গাড়িতে ওঠে। এসময় অনেকে সান্ধ্যভ্রমণে আসে। নির্জনতায় ভেদ পড়ছে দেখে পলা উঠে পড়ে। ফেরার পথে ফোনটা বেজে উঠলো। শোভনের কল। বসতে চায় কোনো এক কফিশপে। আনমনে পলা বলেই ফেললো, 'ঠিক আছে।' আচমকা এভাবে রাজী হওয়াতে অবাকও হলো একটু। স্মিতহাস্যে নিজেকে ভৎর্সনা করে। গাড়ির কাচগুলো নামিয়ে দেয়। ফুরফুরে বাতাসে চুল উড়ছে, মনও উড়ছে।

 কথার পৃষ্ঠে কথা বলার চমৎকার কৌশল জানে শোভন। আকর্ষণটাও থাকে টানটান। কথার বিষয়  বৈচিত্রে চৌকস পাণ্ডিত্য আছে তার। পলা মুগ্ধ হয়ে শোভনের কথা  শুনে। যে কোনো বিষয়ে যুক্তি খণ্ডনের চেয়ে শোভনের পাণ্ডিত্যে নিজেকে সে সমর্পণ করে। ভেবেছিল এভাবেই দিন গড়িয়ে যাবে। বন্ধুত্বের খাতিরে দু'জন দু'জনার দিকে হাত বাড়িয়েছিল। আজ যেন সেই বন্ধুত্বের পথ অন্যদিকে মোড় নিচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের মতো পলা ভাবে, 'ঘরেও নহে, পারেও নহে, যে জন আছে মাঝখানে- সন্ধ্যাবেলা কে ডেকে নেয় তারে!'

 

পরেরদিন শোভনের সঙ্গে পলা দেখা করার জন্য নির্ধারিত কফিশপের দিকে রওনা দেয়। বুকের ভেতরে ভয় আর উৎকণ্ঠা নিয়ে কফিশপে গিয়ে বসে। চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখে শোভন তখনো আসেনি। মনে মনে নিজেকে একটু ধিক্কার দেয়। ভাবে, এভাবে আগেভাগে আসাটা ঠিক হয়নি। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে আধাঘন্টা আগেই  চলে এসেছে। বুকের দুরুদুরু শব্দে পলা অনুভব করে সেখানে এক মত্ত আগন্তক রক্ত কণায় ঝড় তুলছে।

চোখের নিমিষে শোভনও চলে এলো। শোভনই কফির অর্ডার দেয়। মুখোমুখি কফিশপে অনেক কথার আলোড়নে দুজনই চুপচাপ। কী কথা দিয়ে যে শুরু করবে, এমনটাই ভাবছে দুজন। শোভন একটু নড়েচড়ে বসে হঠাৎ করেই বলে ফেলে,

-আমরা কি এক সঙ্গে পথ চলতে পারি না!

কণ্ঠ যতদূর পারা যায় খাদে নিয়ে কাঁপা কাঁপা সুরে শোভন প্রস্তাব দিয়ে ফেলে।

আচমকা প্রস্তাবটা পেয়ে পলা আঁৎকে ওঠে। পর মুহূর্তেই কোনোরকম চিন্তা না করে তড়িৎগতিতে  জিজ্ঞেস করে,

-আপনি এ পর্যন্ত কত মেয়ের সঙ্গে  সেক্স করেছেন?  সংখ্যা বলতে পারবেন?  নাকি অগণিত!

এমন উদ্ভট প্রশ্ন শুনে বিব্রতবোধ করতে লাগলো শোভন। হাতের কাছে কফিকাপটা নিয়ে নাড়াচ্ছে। কফিতে চুমুক দিতেও যেন ভুলে গেছে। এদিকে পলা উত্তর শোনার জন্য পলকহীন তাকিয়ে আছে। শোভন  নরম কণ্ঠে বলে,

-হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?  বিশ্বাস হচ্ছে না আমাকে? 

-বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা নয়।  সত্য জানতে চাচ্ছি।

-সত্য জেনে কি করবেন? 

-বোঝার চেষ্টা করবো, আপনি হৃদয়ের কাঙ্গাল নাকি শরীরের কাঙ্গাল!

-যদি বলি দুটোরই কাঙ্গাল!

বলেই শোভন উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে পলার দিকে। ঝুঁকে বসা অবস্থা থেকে পলা সোজা হয়ে বসে। বলে,

-সেক্ষেত্রে কোন অংশে কাঙ্গলিপনা বেশি সেটা বুঝতে  হবে।

-সেটা না হয় পরখ করে দেখে নিতে পারেন! 

বলেই শোভনের চোখ চলে গেলো পলার বুকের দিকে। যেখানে ক্লিভেজটা দেখা যাচ্ছে। দৃষ্টিটা স্থির হয়ে আছে দেখে পলা অস্বস্তিতে পড়ে। অযথা অপ্রস্তুত-চোখ ঘুরিয়ে আশেপাশের মানুষগুলোকে দেখে নেয়। এরপর  নিরবে কফি কাপে চুমুক দিয়ে চুপ করে বসে থাকে পলা।

শোভন আবার বলতে শুরু করে,

-সম্পর্ক হয়েছিল বেশ ক'টা। 

-তারপর?

-তারপর আর কি?  টিকেনি।

-একবারও কি নিজেকে জিজ্ঞেস করেছেন কেন সম্পর্ক টিকেনি?

-মানসিকতায় মিলেনি তাই হয়নি।

-আমার সঙ্গে মিলবে বলে মনে করছেন? 

-এখন পর্যন্ত তাই মনে হচ্ছে।

পলা কণ্ঠে দৃঢ়তা নিয়ে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে,

-আমি কিন্তু এখনই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমাদের সম্পর্ক টিকবে না।

ভীতসন্ত্রস্ত কণ্ঠে শোভন জিজ্ঞেস করে,

-কেন এমন  মনে হচ্ছে?

-কারণ,  আপনি নিত্য নতুন সম্পর্কে বিশ্বাসী।  আর আমি  সম্পর্কটা দাঁড় করিয়ে রাখি এক  বিশ্বাসের উপর। 

-বিশ্বাস তো আপেক্ষিক। 

-ব্যাসিক বিশ্বাস বলে একটা কথা আছে। যে বিশ্বাসে কখনো চির ধরে না।

-আমাকে ট্রাই করে দেখতে পারেন।

কণ্ঠে শ্লেষ এনে পলা বলে,

-হৃদয়, শরীর কি কাদামাটির দলা  যে ইচ্ছেমতো শেপ দেয়া যায়? 

-তা দেয়া যায় না।  তবে আপনাকে আমার ভালো লেগেছে।

-আমারও ভালো লেগেছে।  কিন্তু আপনার নিজের উপর কন্ট্রোল নেই। 

-কিভাবে বুঝলেন?

-ঐ যে নতুন নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া! মন তো একটাই, তাইনা!  আমার এসবে ভীষণ ভয়। সেজন্য আপনার প্রস্তাবটা গ্রহণ করতে পারছি না।

কথাটা বলে পলা কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে কফিশপ থেকে বের হয়ে যায়।

 সম্পর্ক ভাঙ্গাচোরার  মধ্য দিয়ে পলা আর যেতে চায় না। একেকটা সম্পর্ক ভাঙ্গে আর হৃদয়টা দুমড়েমুচড়ে যায়। সম্পর্ক তো বিশ্বাসের উপর ভর করে চলে, সেইসাথে চলে বোঝাপড়া এবং সমঝোতা!  বিশ্বাস ভাঙ্গার জন্য তো নয়! যদিও সম্পর্ক ভাঙ্গার মধ্য দিয়ে নিজেকে চেনার, বোঝার সুযোগ ঘটে এবং একাকী চলার পথ খুঁজে পাওয়া যায় বটে, তারপরও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে বেশ বেগ পেতে হয়! অনেকটা  আহত নদীর মতো জীবন ঠিকই এঁকেবেঁকে বয়ে যায়। এখন পলা একাকিত্বের মধ্যে জীবনযাপন করে। সুখ খুঁজে বেড়ায় নিজের মতো করে। হয়তো এজন্যেই শোভনের প্রস্তাব পলার ভালো লাগেনি! হৃদয়ের আকুতিও এক ঝটকায় উবে যায়।

পলা তার ঝরঝরে জীবনে অযথা উটকো যন্ত্রণা বয়ে  আনতে চায় না। এমনকিছু ভাবতে ভাবতে গাড়ি পার্কিং এর জায়গায় চলে আসে। গাড়ির পাশে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। দীর্ঘনিঃশ্বাস নেয়। বিকেলটা বেশ সুন্দর,  নরম। মিষ্টি বাতাস বইছে। নীল আকাশে সাদা মেঘগুলো ভেসে বেড়ায়। পলা ভাবে, 'আমিও কি মেঘের মতো!'

এদিকে শোভন কফিশপ থেকে বেরিয়ে ইতস্তত দাঁড়িয়ে পলাকে দেখতে থাকে।