সরীসৃপ

লেখক: মাক্সুদা আইরীন মুকুল Category: ছোট গল্প (Short Story) Edition: Dhaboman - Eid 2022

 

ঝট করে চোখ খুলে গেল সেতুর।তীব্র একটা আর্তনাদ করতে গিয়েও মুখে হাতচাপা দিয়ে সামলে নিল নিজেকে। ঘুম থেকে ধড়মড়িয়ে লাফিয়ে উঠে বসলো বিছানায়।সমস্ত শরীর ভিজে চুপসে একাকার, সদ্য নেয়ে উঠলো যেন। একবার ভাবলো, এতরাতে সে কি শাওয়ার নিলো? না তা কিরে হবে? থরথরিয়ে কাঁপছে শরীর। ট্রেমর আছে ওর। হাত কাঁপে প্রায়শঃ। সন্ধ্যার ঔষধটা মিস হয়নি তো আজ? চোখ বুঁজে বুঝতে চাইলো কি ঘটছে।

মনের পর্দায় ভেসে উঠলো - সেই ছবি। স্বপনে-জাগরণে, সর্বদা সর্বত্র বারে বারে আসতে থাকে যেই ছবি —টিভির স্ক্রলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখানো বড় কোন দু:সংবাদ যেন।কি জীবন্ত! আহ্! ভয় পেয়ে তার ছিপছিপে লম্বা শরীরটা কুন্ডলী পাকাতে পাকাতে যেন ছোট্ট একটা বলের মত হয়ে যায়। এখনও ভয়ে বুকটা তিরতির করে কেঁপেই চলেছে।আজকাল আর নিতে পারে না সে এসব। বড় ক্লান্ত বোধ করে!সেদিন টয়লেটে গেছে, আর অমনি মনে হলো টয়লেটের পানিতে মাথা উঁচিয়ে বসে আছে শান্ত, স্হির সরীসৃপটি।

দৌড়ে বেরিয়ে আসতে গিয়ে ফিরে তাকায়। “না কিছু না...কিছুই নেই এখানে...” নিজেকে প্রবোধ দেয় বারবার। একবার এর মনস্তাত্তিক ব্যখ্যার সন্ধানে গুগল করে দেখেছিলো, এই যে চোখের সামনে সর্বদা কোন কিছু বিশেষতঃ একই প্রাণী বারবার দেখা অথবা দিনের শুরু থেকেই অযথা ভয় পাওয়া, এসব নাকি এ্যাংজাইটি থেকে হতে পারে। তাহলে কি এটাই সত্যি যে একধরনের দুশ্চিন্তা থেকেই ঘুমে নির্ঘুমে সবসময়ে রক্ত হিম করা স্থির, নির্বাক দৃষ্টি মেলে থাকা সর্পটি তাকে সম্মোহিত করে রাখে।

কতবার ভেবেছে, ওর এই দুশ্চিন্তা কি অহেতুক, সাময়িক? কিছু সময়ের জন্য কেবল স্থবির করে দেয় তাকে। আর এই কিছু সময় টুকুই ফিকে হওয়া আবছা নীল রঙে মুড়িয়ে তাকে জাগতিক সব চাওয়া পাওয়া, আনন্দ হাসির হট্টগোল থেকে সরিয়ে নিয়ে যায় দূরে, বহুদূরে। অসীমের সেই ঘেরাটোপে আটকে থাকা ডানা ঝাপটানো পাখির মত রিক্ত সে আবার ফিরে আসে তার পরিচিত সীমানায়। ফিরে তো তাকে আসতেই হয়। সে যে জীবন বড় ভালোবাসে। ঘর, ঘরের মানুষ, এই পৃথিবী, এর যাবতীয় রূপ-রস-গন্ধ সবই যে তার বড় প্রিয়।

কবে থেকে এর সূচনা এখন আর তা মনে করতে পারে না সে। হয়তো অনেকদিন থেকেই ঘটছে, সবার অজান্তে, একটু একটু করে। সর্বানন্দনাশীর এই  সাক্ষাৎ তো আজ নতুন কিছু নয় ।নইলে পাশে পরম নিশ্চন্তে ঘুমিয়ে থাকা মানুসটিও তো কতবার মন মাথার যুক্তিপূর্ন কথার মারপ্যাঁচে বুঝাতে চেয়েছে এ নিছকই তাঁর অলস মনের কল্পনা। ভালোবাসার ভেলায় সব ভুলে সে প্রজাপতির মত ডানা মেলে উড়েছে ঘরময়। আবার কখনও হরেক রকমের, হরেক বর্ণের, নির্গন্ধ-সুগন্ধী ফুল ফুটিয়েছে বাড়ীর আঙিনায়।

অনেক আগে বন্ধুদের চানাচুর-চটপটির আড্ডার খলখল হাসির কলতান থেকে হঠাৎ হঠাৎ মন সরে যেত নীলের ওপারে ঘন কুয়াশায়। মেঘের গভীরে উঁকি দিত একটি

সাদা টুপি, সাদা আলখাল্লা আর সর্পিল নকশাখচিত চিকন বেতের গা ঘিনঘিন করা ছবি। এ সবকিছুই নীল-বিষাদে তাকে ঘিরে ধরতে চাইতো বারে বারেই। আর একে আলিঙ্গন করেই অনেক এবড়ো খেবড়ো পথ পেরিয়ে আজ সে পরিপূর্ন একজন মানুষ। কর্মক্ষেত্রে সার্থক আর ছেলে-পুলে স্বামী নিয়ে আজ তার আনন্দধাম পূর্ণ।তবে এতটা সহজ তো ছিল না সবকিছু।

সেই ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে।দুরন্তপনা, খেলা-ধুলা আর দৌড়ঝাপে দিনগুলি ছিল রূপকথার গল্পের মত। এই রূপকথার গল্পের আনন্দে ছেদ পড়া শুরু হয় যখন খেলার মাঠে, বাড়ীর সামনে, যত্রতত্র এক জোড়া চোখ তাকে প্রতিনিয়ত অনুসরণ করতো, অন্ধকারে গা ছমছম করা কেমন এক অনুভূতি হয়ে। তখন বয়স কতই বা তার? এই বারো বা তেরো ।

একদিন সদা ছটফটে কিশোর সে বেণী দুলিয়ে একদৌড়ে চারতলার দরজা খুলে নাচের তালে তালে তরতরিয়ে নেমে যাচ্ছে নীচে। একেবারে নীচের সিঁড়ির কোণায় অন্ধকারে একটি আবছা অবয়ব নিজেকে আড়াল করে ভূতের মত দাঁড়িয়ে। দৌড়ে নামতে গিয়ে একটি শক্ত থাবার হ্যাঁচকা টানে থমকে যাওয়া। মুখের কাছটায় সিগারেটের কটু গন্ধ, ভারি নি:শ্বাসের ওঠা-নামা। অন্ধকারে এগিয়ে আসা একজোড়া চোখের কুৎসিত চাহনি। এরপর যে কি হয়ে গেল তা সে আজও বুঝতে পারে না।

নিস্তব্ধতার দেয়াল চিরে দূর্গতিনাশিনীর দশ হাতের মত সমস্ত শক্তিতে তার নরম হাতের শক্ত পাঁচ আঙ্গুলের পাতাসমেত… ঠাশ..ঠাশ।

আঘাতটা ছিটকে দূরে সরিয়ে দেয় লোলুপ দৃষ্টিটিকে। ঘুরে দাঁড়িয়ে মুখে বিজয়ীর হাসি নিয়ে ফের দৌড়। একবারও পেছন ফিরে তাকায়নি সে সেদিন। এরপর যতবারই চারতলার সেই সিড়ি ভেঙ্গে দৌড়ে নেমেছে ততবারই নীচের সিঁড়ির কোণায় এসেই থমকে গেছে পা। প্রথমদিকে ভীষন ক্রোধে পেট থেকে বিষাক্ত কিছু উগরে দেয়ার মত সমস্ত শরীর গুলিয়ে উঠত। চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পেত সে অন্ধকারের বলয় থেকে উঠে আসা সাপের মত আঁকা-বাঁকা ক্ষিপ্তগতি একটি হাত আর চেনা মানুষের অচেনা হিংস্র দু’টি চোখ।

হয়তো সেখান থেকেই শুরু...সেতু আজ ভাবে। সেদিন সে জয়ী হয়েছিল ঠিকই!

তবে অশুভ ছায়ার প্রতাপ কি রয়ে গিয়েছিলো কোথাও?

তবে কিসের এই শঙ্কা-সংশয় আজ তার? পাশে শুয়ে থাকা চিরআপন মানুষটির ঘুম জড়ানো কন্ঠের প্রশ্নে সংবিৎ ফিরে পায় সেতু।

“এত রাতে জেগে বসে আছো? আজও কি সেই সাপ খোপের স্বপ্ন দেখলে নাকি?”

সেতু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। শুনতে পেল যেন, ঘুমঘুম প্রশ্নের  সাথে গলায় শ্লেষ্মা মিশ্রিত হিসহিসে একটা আওয়াজের অনুরণন!