ঘড়ির দিকে তাকাতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। যাহ, ক্লাসটা ফসকে গেল আজও।
শরীফ স্যার মানুষটা ভালো। হলের প্রভোস্ট হয়েও ফাঁকি দেন না পাঠে, গবেষণায়। স্যারের পড়ানোটাও বেশ মজার। অণু-পরমাণুর মত অদৃশ্য বিষয়ও চোখের সামনে ভেসে ওঠে। চকের গুঁড়োয় তৈরী বৃত্ত-উপবৃত্তে ঘুরতে থাকা কণাগুলোও যেন খুশিতে নাচতে থাকে স্যারের গল্প শুনে। নাচতে নাচতেই কোন ফাঁকে বোর্ডচ্যুত হয়ে টুপ করে ঢুকে পড়ে মগজে। পেট কাটা এইচ, সাই আর ফাই দিয়ে সাজানো জটিল সব সমীকরণও ‘জলবৎ তরলং’ করে তুলতে ওস্তাদ এই শিক্ষক। ইংরেজী, বাংলার মত নিখুঁত উচ্চারণে স্পেনীয় ভাষা বলে আমাদের মুগ্ধ করেন মাদ্রিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেভেরো ওচোয়া সেন্টার থেকে পড়াশোনা করে আসা আমাদের শরীফ স্যার।
স্যারের ক্লাসটা ধরব ভেবে রাতের আড্ডাপর্বের ষোলকলা পূর্ণ না করেই রুমে চলে এসেছিলাম কাল রাতে। দুই ছাত্রাবাসের মাঝখানের পুকুরের পাড়ে বসে রাতব্যাপী আড্ডা দেয়া আমাদের দস্তুর। মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে "ঘুম হইতে নামাজ উত্তম" শুনেই ক্লাস ধরার জন্য একটি ঘুমিয়ে নেয়ার কথা মনে হয়ে যায় আমার। রাতের আর অবশ্য ততটা বাকী ছিল না তখন। বাকীরা দল ধরে আবুলের ক্যান্টিনের দিকে যায় গরম পরোটা আর চায়ের টানে। আমি চলে আসি কক্ষে।
লাভ হয়নি তাতে; ঘুম ভাঙ্গল ক্লাসের সময় পার করেই। মাঝ সকালে সূর্যের আলো যখন হানা দেয় ঘরে, আলোর তাপে তেতে ওঠে বালিশ-বিছানা, ঘুম ভেঙ্গে যায় আমার রোজই। আজ ভাঙ্গে নি। মজলিশ সেরে মওত নিদ্রায় পেয়ে বসেছিল মনে হয়।
ঘুমেরও যে একটা দাবী থাকে শরীরের উপর সেটা বেশ ভালোমতোই টের পাওয়া যায় এভাবে ঘুম ছাড়লে। সচল হতে চায়না স্নায়ুগুলো সহজে, শিথিলতা ছাড়ে না পেশী। ফিরে ফিরে আসে স্বপ্নগুলো, হর্ষ কিংবা বিষাদের । বুঁজে আসতে চায় চোখের পাতা।
২
ঘুমের রেশ কাটে দূর থেকে ভেসে আসা শ্লোগানের আওয়াজে। নিদ্রালস মগজে আছড়ে পড়ে অস্ফুট ধ্বনিতরঙ্গ “নানা কম্পে নানা সুরে”। শব্দবিজ্ঞানের ক্লাসে ডপলার ইফেক্ট নিয়ে কথা হয়েছে সম্প্রতি। সহজেই বুঝতে পারি আমাদের কক্ষটি যে দালানে সেদিকেই এগিয়ে আসছে মিছিল। এই সকাল-দুপুরে মিছিল হবার তো কথা নয় আবাসিক হলে। তাহলে কি…?
বাসী মুখটা আরো শুকনো ঠেকছে। ভয় পাইনি তো? চৌকির পায়ার কাছে রাখা গ্লাসটা তুলে ঠোঁটে ছোঁয়ানোর আগেই ছায়া পড়ে পানিতে।
চান্দু। আমাদের ক’জনের বাবুর্চী কাম বাজার সরদার। রীতিমত হাঁপাচ্ছে দরজায় দাঁড়িয়ে।
"জলদি ভাগেন স্যার। আপনাগেরে খুঁজতাছে ওই দলের পোলাপাইন। মোটকা খোকনও হেগো লগে আছে।"
মোটকা খোকন চূড়ান্ত বিলা আমার উপর। এ’কথা হলের সবাই জানে। চান্দুও। চান্দুর সঙ্গী-সাথীদের অকারণ মারধর করত খোকন। ওদের দিয়ে ফাও খাবার আনাত হলের ক্যান্টিন থেকে। এসব অন্যায় বন্ধ করতে গিয়ে বারংবার ঝামেলা হয়েছে খোকনের আমাদের অনেকের সাথেই। ও বলে বেড়ায় আমিই নাকি নাটের গুরু।
৩
চান্দুর হাঁপানোর তীব্রতা দেখে বোঝার চেষ্টা করলাম, ও কতটা পথ দৌড়েছে?
ছোটঘরে ঘুরে আসা যাবে তো…দাঁত নে মেজে কি নাস্তা মুখে রুচবে…এলাকা ছাড়তে হতে পারে… ফ্যাকাল্টি বিল্ডিঙয়ের বাথরুমগুলোর যা অবস্থা…মোসলেম মিয়ার কাছ থেকে সুটকেসটা নেয়ার সময় নেই…সিগারেটের প্যাকেটটা গেল কই…মোটকা খোকনের কাছে মাল নেই তো…চাবি, আই,ডি, মানিব্যাগ, লাইটার…সব প্যান্টের পকেটে।
"দুই নম্বরটা দিয়ে তিন নম্বর খোল?" প্যান্টে পা গলাতে গলাতে চান্দুকে ডুপ্লিকেট চাবিটা খুলে দিই গোছা থেকে। অনেক চেষ্টা করেও গলার কাঁপুনি লুকোতে পারি না।
চান্দুরও হাত কাঁপে। সহজে ঢোকে না চাবি তালার ছিদ্রে। হলের পেছনের এই গেটটা খোলা হয় না সহজে। মরচে পড়েছে তালাটিতে। চাবি অনায়াসে ঢুকে গেলেও টাম্বলার ঘোরার আওয়াজ পাচ্ছি না। ভুল চাবি দেয় নি তো মোসলেম মিয়া?
৪
মিছিল ঢুকে গেছে হলে। উত্তেজিত কোরাস শোনা যাচ্ছে এখন স্পষ্টঃ
ধর শালারে, মার শালারে,
অর বাপেরে, অর মায়েরে।
কারা দৌড়ে আসছে…লাফিয়ে পড়ল কোন দরোজায়…কাঁচ ভাংছে কোথায় ঝনঝন শব্দে…
উফ, বুকের হাড্ডি-চামড়া ভেদ করে বেরিয়ে আসতে চাইছে আমার হৃৎপিণ্ড।
এক ঝটকায় চান্দুকে সরিয়ে দিয়ে জোরে মোচড় দিই চাবিতে। চিচিং ফাঁক। মোসলেমটা একেবারে আসল - এক নম্বর।
চান্দুও বেরিয়ে আসে পেছন পেছন। ওর “এক্তাদায়তু বেহাজালে” বাদ সাধি -
"তুই ত্থেকে যা। গেট খোলা দেখলে সন্দেহ করবে ওরা। বলবি বাজারে যাচ্ছিলি, পেছন দিয়ে, সামনে গণ্ডগোল দেখে।"
স্যাঙ্গাত চান্দুকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে ইতস্তত করি কিছুটা। মোটকা খোকনের সঙ্গীদের গগনবিদারী চিৎকারে দ্বিধা কেটে যায় মূহুর্তে।
চান্দুকে গেটের ভেতর দিকে একরক্ম ঠেলে দিয়েই ভোঁ দৌড়…
৫
দৌড়ে পৌঁছে যাই আবুলের ক্যান্টিনে। ডিপার্টমেণ্টের পেছনেই আবুলের দোকান। এজায়গাটা কিছুটা নিরাপদ। হামলাকারীরা ধাওয়া করে এদিকে এলেও চট করে ঢুকে পড়া যাবে স্যারদের কারো রুমে।
তিন্নিকে পাব ভেবেছিলাম। ক’টা টাকা নেয়া গেলে ভাল হয়। কদিন বাইরে থাকতে হয় ঠিক নেই।
খদ্দের নেই তেমন আবুলের দোকানে। আমাদের ছেলেদের কাউকেই দেখছি না। থার্ড ইয়ারের তিন চারজন মিলে আলাপ করছে আগের রাতের কোন টিভি নাটক নিয়ে।
"ওই ঢঙ্গী মেয়েটাকে নায়িকা করার দরকার কি ছিল?" মেয়েদের কেউ বলল।
"তুমি যাই বল, ওর হাসিটা কিন্তু বেশ সুন্দর" ছেলেদের কেউ জবাব দেয়।
ঘামে চুপচুপ গেঞ্জি গায়ে একমনে চপ ভেজে যাচ্ছে আবুল, যেমনটি ওর বাবা ভাজত কবছর আগেও। পরম যত্নে মশলা দেয়া পেঁয়াজের পুর ভরে বিস্কুটের গুঁড়ো মেখে আস্তে করে গরম তেলে ছেড়ে দিচ্ছে এক একটা চপ, তীব্রতাপে চিৎকার করে প্রতিবাদ জানাচ্ছে চপেরা, আবুল খুন্তি দিয়ে নেড়েচেড়ে কমানোর চেষ্টা করছে চপেদের দহনজ্বালা, পুড়ে অঙ্গার হওয়ার আগেই তুলে আনছে ওদের। সাজিয়ে রাখছে এক এক করে। পুরো ব্যাপারটা বেশ ছন্দোবদ্ধ। ছন্দ ছাপিয়ে ভাজা আলু-পেঁয়াজের গন্ধ নাকের ফুটোয় এসে লাগতেই মনে পড়ে যায় মোটকা খোকনদের তাড়া ছাড়া আর কিছুই খাওয়া হয় নি কাল রাতের পর। একটা চপ ভেঙ্গে মুখে দিই। জিহ্বার ডগা আর তালুর মাঝখানে চপের অর্ধেকটা ধরে রেখে ভাজা টোস্টের গুঁড়োর স্বাদ নেই বেশ খানিকক্ষণ ধরে। ধীরে ধীরে চিবুই, সময় নিয়ে।
৬
"তিন্নি ম্যডামে খোঁজ করতেছিল আপনেরে।" মিটিমিটি হেসে বার্তা দেয় আবুল। বিরক্ত হই কিছুটা। বেশী ডেঁপো ছেলেটা।
পরের পিরিয়ডের সময় হলে ক্লাস ধরতে গেল ছেলেমেয়েদের দল। মানিব্যাগ বের করে সবার চা-চপের দাম মেটাল যে ছেলেটি তার ফর্সা ধোপদুরস্ত কাপড়-জামা দেখে কাঞ্চনের কথা মনে পড়ে গেল। কাঞ্চন এদের নাম দিয়েছে – “পার্টি।”
“মাস্তি-পার্টি কও আর দলের পার্টি – পার্টি ধইরা পাত্তি নামাইতে না পারলে কিন্তু সব চাঙ্গে।” এমন সব শ্বেতসত্যের সরস বয়ান বন্ধু মহলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা দিয়েছে কাঞ্চনকে। সবাই ভালোবাসে ওকে। তবে কাঞ্চনের টানটা নাকি বেশী আমার দিকেই। বাকী সবার তাই ধারণা। আমি বুঝি না। আমি শুধু জানি, কাঞ্চনের চোখদু’টো অসম্ভব সুন্দর।
৭
ওঠা দরকার মনে হয় আমারও। কখন হল ছেড়ে ক্যাম্পাসের দিকে ছড়ায় উত্তেজনা কে জানে? কাঞ্চনদের ডিপার্টমেন্ট বিলদিঙ্গটা পাশেই। দেখি গিয়ে। ও হয়তো জানবে কীভাবে কোথা থেকে শুরু হল সব। চপের দাম খাতায় লিখে রাখতে বলি আবুলকে। সাথে থাকা ক’টি টাকা খরচ করতে চাই না এখনই।
কাঞ্চন দাঁড়িয়েছিল ওর ডিপার্টমেণ্ট বিল্ডিঙয়ের মুখেই। যেন আমার জন্যেই অপেক্ষা করছিল - "তাড়াতাড়ি রিকশায় ওঠো দোস্ত। এই এলাকা তোমার জন্য সেফ না। তোমারে পাইলে ছিইল্লা ফালাইবো।"
কাঞ্চনের উদ্বেগে আমার উৎকণ্ঠা ফিরে এল। ফ্যাকাল্টি গেটে রিকশা দাঁড়ানোই ছিল। রিকশায় মেইন ক্যাম্পাসে যেতে যেতে কাঞ্চনের মুখে শুনলাম পুরো ঘটনা।
৮
উগ্র সাম্প্রদায়িক একটি দলের পক্ষে মিছিল করার জন্য হলে বাইরের ছেলেপেলেদের গোপনে হলে জড় করছিল মোটকা খোকন, ছাত্র সংগঠনগুলোর সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী অলিখিত সমঝোতা উপেক্ষা করে। কদিন আগে এদের একজনকে হাতেনাতে ধরে ফেলে আমাদের ছেলেরা। চড়-থাপ্পড় দিয়ে হল থেকে বের করে দেয়ার সময় জ্বলন্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়েছিল ছেলেটা।
আমার ভেতরটা কেঁপে ওঠে সেই দৃষ্টিতে। মনে হয়, চোখের আগুনে তুর পাহাড়ের মত ছাই হয়ে যাচ্ছে আমার হাড্ডি-মাংস, চুল-নখ। সেই ছাই রূপর পাত্রে পৌঁছে যাচ্ছে হলের তৃতীয় তলায়, মোটকা খোকনের কক্ষে, নামাজের সময়সূচীর বড় পোস্টার সাঁটা দরোজার ঠিক সামনে। মোটকা তার সুন্নতী দাঁতনের ডগায় সেই ছাই মাখিয়ে মেসওয়াক করতে করতে হেঁটে যাচ্ছে কোণার কমন বাথরুমের দিকে। মেসওয়াক শেষে থুঃ থুঃ করে সুন্নতী দাঁতের ময়লা মেশানো কুফরি ছাই হলের বাথরুমের বেসিনে ছুঁড়ে দিচ্ছে মোটকা। বেসিনের নল বেয়ে জল আর দেহভস্ম ধেয়ে চলেছে বুড়িগঙ্গার পানে।
হল থেকে তাড়িয়ে দেয়া হলেও ক্লাস করতে বাধা দেয়নি কেউ খোকনকে। বিজ্ঞান অনুষদের মূল বিদ্যায়তনে জায়গা হয়নি খোকনের বিভাগের। একটু দূরের এনেক্স বিল্ডিংয়ে নিজ শ্রেণীকক্ষে নিয়মিত ক্লাস করে যাচ্ছিল ও।
৯
সকালে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্র সংগঠনটি এনেক্স বিল্ডিংয়ে মিছিল বের করতেই সেই মিছিলে ঢুকে পড়ে খোকন। ছুপা মৌলবাদী হলেও শক্তিশালী এই ডানপন্থী সংগঠনটির মিছিলে ওকে দেখেনি কেউ আগে। কোথা থেকে কী হচ্ছে কেউ বুঝে ওঠার আগেই মিছিল থেকে স্লোগান ওঠে -
খোকন ভাই বাইরে কেন?
ব্যর্থ প্রভোস্ট জবাব চাই
এরপর খোকনই নাকি সবাইকে পথ দেখিয়ে হলে নিয়ে আসে। এপর্যন্তই কাঞ্চন জানে। মূল ক্যাম্পাসে গেলে হয়ত জানা যাবে, এর পেছনে কারা? তাদের প্রস্তুতি কতটা? ক্ষয়ক্ষতি কতটা হল আমাদের ছেলেদের।
১০
রিকশা দুই ক্যাম্পাসের মাঝামাঝি জায়গায় পৌঁছুতেই তিন্নির দেখা মিলল। একাডেমীর গেটে বসে চা খাচ্ছেন উনি। সাথে এক দঙ্গল ছেলে মেয়ে।
হা-হা-হি-হি…টিভিওয়ালা-ওয়ালীরা কাল রাতে কে কেমন করল সেই আলাপ করছেন নিশ্চয় এনারা…আমার কি হল না হল তাতে কার কি…‘মোটকাকে হল থেকে তাড়িয়েছ, এবার ঠ্যালা সামলাও। আমি কি আমার পড়াশুনা, বন্ধু-বান্ধব, সিনেমা-নাটক বাদ দিয়ে মোটকাবধে নামব তোমার জন্যে?’
রাগ হচ্ছে কেন আমার? তিন্নি আমার কে? ওর খালা আমার হাতে চিঠিটা না দিলে কোনদিন হয়তো দেখাই হতো না ওর সাথে। আমি তো লিখিনি সেই পত্র…আমি কেবলই বাহক… আমি লিখব চিঠি? পাগল নাকি? সেই চিঠি…সর্বনাশা সেই পত্র…
তিন্নির খালারা আর আমরা একই শহরের মানুষ না হলে, দুর্ঘটনায় খালাদের পুরো পুরিবার হঠাৎ করে "বাপ গিয়েছে স্বর্গে, দাদার লাশ মর্গে" অবস্থায় না পড়লে, কিংবা তিন্নিদের বাড়ী ক্যাম্পাস এলাকায় না হলে পত্রবাহক হওয়ার দরকার পড়ত না হয়তো আমার সেবার। ভিন শহর থেকে নিয়মিত ডাকেই বোনের চিঠি পৌঁছুত তিন্নির মায়ের কাছে। সেই চিঠি… সর্বনাশা সেই পত্র।
ওর নিজের ডিপার্টমেন্টের সেরা ছাত্রছাত্রীদের অন্যতম তিন্নিকে খুঁজে বের করেছিল কাঞ্চন। তিন্নিকে দেখে আমি অবাক হয়েছিলাম। কাঞ্চনের চেয়েও সুন্দর চোখ হয় কারো সেই প্রথম জানলাম আমি। আমার মুগ্ধতা দৃষ্টি এড়ায়নি কারুরই। যাচ্ছেতাই অবস্থা থেকে আমাকে ঊদ্ধার করার জন্যে চিঠিটা আমার হাত থেকে নিয়ে তিন্নিকে হস্তান্তর করেছিল কাঞ্চনই। সেই চিঠি… সর্বনাশা সেই পত্র।
এরপর কথা হয়েছেই বা কদিন? একসাথে বসা হয়েছে মাঝে সাঝে আবুলের দোকানে, ক্যাফেটরিয়ায়, ক্যান্টিনে। অধিকাংশ সময়ই অন্য আরো অনেকের মাঝে, কখনও তিন্নির সহপাঠী, কখনও আমার সহযোদ্ধা। ক্যাম্পাসে একা ঘোরা হয় না আমার। তিন্নির সাথেও ক্লাসের ছেলেমেয়ে থাকে সব সময়ই। থাকারই কথা। মাথাটা ভালো ওর, চোখজোড়ার মতই।
আমার চোখ দুটোও নাকি দেখতে বেশ। তিন্নি বলেছে একদিন। আশ্চর্য, কোন মেয়েকে কোন ছেলের চোখের সৌন্দর্য নিয়ে কথা বলতে শুনিনি, আমার তো নয়ই। আচ্ছা, টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনের ঢংয়ে কোন মেয়ে যদি কখনও প্রশ্ন করে আমায়, "বলুনতো, আপনার চোখের সৌন্দর্যের রহস্য কী?" কী উত্তর দেব আমি?
হুম… র-হ-স্য… কোন রহস্য না থাকাটাই মনে হয় মামাদের মত লোকেদের সবচেয়ে বড় রহস্য। জোর করেই তিন্নির দিক থেকে ঘুরিয়ে নিলাম চোখগুলো।
"টাইনা চালাও" রিকশাওয়ালাকে ধমকে দিলাম বিনা কারণেই। রিকশাওয়ালা পেছনে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসল। কী যে বোঝে এরা, কেন হাসে, কখন, বোঝার কোন উপায় নেই। আমার মত রহস্যবিবর্জিত মানুষের পক্ষে তো নয়ই।
১১
রিকশা ভাড়া মেটায় কাঞ্চন। আপত্তি করিনা আর আজ।
মেইন ক্যাম্পাসের ক্যাফেটরিয়ায় আমাদের সংগঠনের টেবিলে ছেলেদের ভিড়। চঞ্চলতা। ফিসফাস। আমাকে দেখেই দৌড়ে এল অন্য হলের ছেলেরা।
"ভাই, আপনে ঠিক আছেন তো। সবাই কইল আপনে রুমে ঘুমায়ে আছলেন। আপনার রুম তো ভাইঙ্গা চুরমার করছে শুনছি।"
বড় বাঁচা বেঁচেছি আজ। উফ আর একটু পর ঘুম ভাঙলে কি যে হত? মোটকা খোকন আমাকে রুমে তালা দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিত নিঃসন্দেহে।
"বস বহেন।"
একজন উঠে জায়গা ছেড়ে দিতে টেবিলে বসে বাটার টোস্টের অর্ডার দিলাম। সাথে অমলেট। ক্যাফেটরিয়ার পেছনেই বিজনেস ফ্যাকাল্টি। ওদের বাথরুমগুলো বেশ ভাল। সকাল থেকে চেপে চেপে পেট ব্যথা হয়ে আছে। এবারে আরামে মুক্ত হওয়া যাবে।
১২
বাটার টোস্ট শেষ করার আগেই খবরটা পেলাম - "উইকেট একটা পড়ছে তোমগো।"
পাশের টেবিলে খবর নিয়ে এসেছে কেউ ক্যাম্পাসের আমামদের দিকটা থেকে।
বিজনেস ফ্যাকাল্টিতে যাওয়া হল না আর। ক্যাফেটরিয়ার কাউণ্টার থেকে ফোন করলাম হলের প্রভোস্ট অফিসে।
"তোমার সানচো পান্থা গন।" শরীফ স্যারের নিঁখুত স্পেনীয় উচ্চারণ বুঝতে পারি না আমি শুরুতে।
“মানে…”
“চান্দু, তোমাদের চান্দু গুলি খেয়ে মরেছে মিস্টার ডন কিহোত্তে দে লা মাঞ্চা……”
প্রভোস্টের শেষ শব্দগুলো কানে গেলেও মগজে পৌঁছায়না আমার। মনের পর্দায় ভেসে ওঠে হলের পেছনের গেটে ছেড়ে আসা চান্দুর অবাক, বিহ্বল চাহনি। দৌড়ে পালানোর সময় একবারও পেছন ফিরে তাকাইনি আমি। চান্দু কি আমায় ডেকেছি্ল? ওর চোখদু’টো কি ছলছল করছিল? চান্দুর চোখগুলো কি কাঞ্চনের চোখের চেয়েও সুন্দর…তিন্নির চোখের চেয়েও…
"সিটির পোলাপাইনরে খবর দাও। আর মেডিকেলে কাউরে পাঠাও লাশ আনতে।" কোনমতে কথা ক’টি বলে পালিয়ে এলাম সবার সামনে থেকে। কাঞ্চন এলো পিছুপিছু।
১৩
ব্যবসা প্রশাসনের দালানটা এখনো নূতন। সবকিছু ঝকঝকে তকতকে রাখে এরা। অন্য বিভাগের ছেলেমেয়েদের ঢুকতে দেয় না দারোয়ানরা। পার্টি করে যারা তাদের অবশ্য আটকাতে পারেনা। তিন্নিকে নিয়েও একদিন এসেছিলাম এদের নূতন ক্যন্টিনে আমি আর কাঞ্চন। ভেবেছিলাম মুগ্ধ হবে। হয়নি। বিস্মিত হয়েছে। শ্লেষের স্বরে বলেছে, "সার্বজনীন ক্যান্টিন চাই, নেতা সাহেব।"
১৪
বাথরুমে ঢুকে চোখের জল আটকে রাখতে পারিনা। পানির কল খুলেছিলাম আগেই। চান্দুর মুখটা ঘুরে ঘুরে আসতেই থাকে মনে। চোখজোড়া কেমন মায়াবী, কী গভীর দৃষ্টি। আশ্চর্য, এতদিন মনে হয়নি কেন…আমাদের হলের জীবন অচল…আরেকজন চান্দু পাব কি করে… চান্দুর মত এত ভাল একটি ছেলে আর হয়… কি জবাব দেব চান্দুর বাবাকে মাসের শুরুতে ওর বেতনটা নিতে এলে… ওর বাড়ীতে মনে হয় একটা ছেলেকে পাঠানো দরকার…কিছু টাকা-পয়সাও তো দিতে হবে…পার্টি অফিসে কাউকে পাঠানো দরকার।
১৫
ক্যাফেটরিয়ায় ফিরতেই দেখি সবাই প্রস্তুত। মাথায় লালশালু বেঁধে নিয়েছে সবাই।
স্লোগান ধরে কাঞ্চন, “চান্দু ভাই মরল কেন?” ধ্বনিত হয় সবার কন্ঠ, “কর্তৃপক্ষ জবাব চাই।”
চান্দু ভাইয়ের রক্ত…
বৃথা যেতে দেবনা …
ইত্যাকার ভাষাহীন নানা ধ্বনিতে মুখরিত হয় ক্যাম্পাস।