Table of Content

Fazlul Haq
NA
NA
5 articles

নীল কাব্য

লেখক: Fazlul Haq Category: ছোট গল্প (Short Story) Edition: Dhaboman - Eid 2017

 

আমরা ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে পড়ি । ক্লাস এইটে । দোতালায় সিঁড়ির বাম পাশের রুমটায় আমাদের ক্লাস । ক্লাস নিচ্ছেন বাংলা সাহিত্যের হুমায়ন কবির স্যার । লম্বা চওড়া ফর্সা মতো চেহারা । ক্লাসের বিশাল ব্ল্যাকবোর্ডের  সামনে দাঁড়ালে উনাকে নায়ক মনে হয় । আমরা এই নায়ক স্যারের ক্লাসে চুপ করে পড়া শুনছি। । মাথার উপরের ফ্যানের খট খট শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই ক্লাসে । আজ তিনি পড়াচ্ছেন ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লার পল্লী সাহিত্য । স্যার পল্লী অঞ্চলের একটি প্রবাদ দিয়ে শুরু করলেন-

কলা রুয়ে না কেটো পাত

তাতেই কাপড় তাতেই ভাত

আমরা ধরে নিলাম কলা দিয়ে ভাত খাওয়া জাতীয় কিছু একটা হবে । আসলে দেখা গেলো ব্যপারটা তা না । স্যার এই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা শুরু করবেন; ঠিক সেই মুহূর্তে পেছন দিক থেকে কে একজন “উহুঁ” করে  শব্দ করলো

স্যার বললেন, “এই তুমি এই দিকে আসো।”

পেছনের দু’ তিন জন মুখ চাওয়া চাওয়ী করলো । কাকে ডাকছেন বুঝা যাচ্ছে না । “এই মিডল ম্যান, তুমি।” 

সগীর ডেস্ক থেকে বের হয়ে স্যারের কাছে গেলো । 

“কি করছিলে ?”

“কিছু না মানে…”

“আমি তো দেখলাম তো ওকে কনুই দিয়ে গুতা দিচ্ছেলে।” 

“গুতা না স্যার নীচের থেকে পেন্সিল তুলতে.....তুলতে গিয়ে ধাক্কা লেগেছে,” সগীরের কথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে । হওয়ারই কথা । বাঘের সামনে পড়েছে । বাঘ বললেও ভুল হবে । ঘোগ । তার ক্লাসে বাঁদরামি । এতো বড়  দুঃসাহস !

স্যার সামনের ডেস্কের একজনের কাছ থেকে  ল্যাব খাতাটা তুলে নিলেন (খাকি কালারের ল্যাব খাতার সাইজও ছিল মার্কা মারা । হার্ড কাভারে মোড়া এই খাতা হাতে ধরলে ছোটোখাটো চেলা কাঠ মনে হতো )। তারপর  বিকট ভঙ্গিতে ধরলেন সগীরের কলার চেপে - যেন  পর্বতের সামনে মূষিক । আমরা সবাই দম বন্ধ করে দেখছি । পরের পনেরো মিনিট ...ঠিক হল আমরা পরিষ্কার করে বলতে পারবোনা ..... কিন্তু এক সময় দেখলাম খাকি খাতাটা গোল হয়ে কাগজের  বলের মতো হয়ে গেলো ।  বলটা স্যার ক্লাসেরকোনায় ডাস্টবিনে ফেলে বললেন- “তোমরা সবাই মনে রেখ। আমার ক্লাসে টালবালটি করলে  এই অবস্থা হবে।” 

টালবালটি তো থাক সেই থেকে আমরা স্যারের ক্লাসে আরো কাঁটা হয়ে গেলাম । কেউ কারোর দিকে তাকাই ও না । শক্ত হয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকি । স্যার মাঝে মাঝে ক্লাসে হাসির গল্প বলেন । আমরা সেই গল্প না বুঝেও হাসি । সে হাসি আমাদের এই কাঠের মতো শক্ত স্যারকে স্পর্শ করতো কিনা জানি না; শুধু এ টুকু জানি স্যার হাউসেও একই রকম । গম্ভীর একটা ভাব নিয়ে চলেন । যেহেতু প্রত্যেকটা স্যার কোনো না কোনো হাউসের সাথে জড়িত; স্যার ছিলেন ফজলুল হক এর  সাথে । হাউস মাস্টার । রাত বিরাতে  চলে আসেন হাউসে । চক্কর দেন । বেয়ারা  হামিদ  জড়োসড়ো হয়ে  স্যারের পেছন পেছন ঘুরে । স্যার হাউসের খোঁজ খবর নেন ।

“হামিদ তারপর বলো আজকে কি সমস্যা?”

“স্যার সমস্যা তো অনেক, কোনটা বলবো?”

“একটা একটা করেই বলো।”

“দোতালার বাথরুমের পাইপ ফেটে গেছে।”

“সেটা ঠিক হবে কাল । আপাতত ওই পাশের বাথরুমের সব কল বন্ধ রাখো।”

“জ্বি আচ্ছা।”

“আর কিছু?”

“স্যার, ক্লাস টুয়েলভের কয়েকজন ভাই মিলা লাঞ্চ এর পর সিঁড়ির গোড়ায় বসে আড্ডা দেয়।”

“আড্ডার বয়স আড্ডাতো দিবেই তাতে তোমার সমস্যা কি?”

“সমস্যা আমার না, ক্লাস সেভেনের ক্যাডেটদের।”

“কি হয়েছে তাদের?”

“এইসব ক্যাডেটদের দিয়া গান গাওয়ায়। আজ এক পোলারে গান গাইতে বলছে। সে শুনে নাই। তারপর তারে  ধইরা কঠিন মাইর দিছে।”

“ছেলেটার নাম কি?”

 

“সাদিক।”

সাদিকের এই ঘটনা শুনে স্যার ভীষণ ক্ষেপা ক্ষেপলেন । হাউস ক্যাপ্টেন কে ডেকে কড়া ভাষায় শাসালেন - বন্ধ করো এসব ।

সেদিন থেকে এক মহা বিপ্লব ঘটে গেলো ফজলুল হক হাউসে । জুনিয়র ক্যাডেটদের এখন আর লাঞ্চের পর হয়রানি হতে হয় না । লাইটস আউটের পর (রাত দশটায়) কমন রুমে বসে সিনিয়রদের নোট কপি করে দিতে হয় না । স্যার তীক্ষ্ণ চোখে এই সব খেয়াল করতে লাগলেন ।

একদিন স্যার ক্লাসে আসলেন । ভীষণ মন খারপ করে ।পড়াতে পারছেন না। শুরু করেও থেমে যাচ্ছেন।  নাহিদ  আমাদের  ক্লাসে একটু সাহসী ধরনের । কলেজ ম্যারাথনে একবার ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে এমন শব্দ করলো  বাকি  প্রতিযোগীরা ভয় পেয়ে দূরে সরে গেলো; সেই থেকে ওর নাম হয়ে গেলো গন্ডার । আমাদের গন্ডার মামা সাহস করে জিজ্ঞেস করলো – “স্যার আপনার কি মন খারাপ?”

“হুম । তোমরা শুনতে চাও – কেন?”

 ছেলেপেলে হালে পানি পেলো। সমস্বরে বললো, “ইয়েস স্যার।”

 স্যার শুরু করলেন ।

“গত রাতে আমার বাসায় একজন গেস্ট এসেছেন -কুমিল্লা থেকে । প্রাইভেট কলেজের টিচার। আমাকে বলে কিনা তোমাদের তো কোন জীবন নাই । এই সব ছেলেপেলের জন্য জীবন দিচ্ছ, রাতদিন পড়ে থাকছো এই  কলেজ নিয়ে, আখেরে তোমাদের কি লাভ ?”

আমরা কেউ কোনো জবাব দিলাম না । চুপ । 

স্যার নিজে থেকে বলতে থাকলেন, “তোদের ছেলেরা কি ফার্স্ট সেকেন্ড  হয়? আমাদের ছেলেরা হয়।  আমরা  অনেক যত্ন  করে এদের গড়ে তুলি । আমাদের এ আনন্দ  তোরা কোথায় পাবি?”

এমন সময় বাইরে মিল্ক ব্রেকের ঘন্টা বেজে উঠলো । স্যার সংশয়গ্রস্তের মতো নীরবে বের হয়ে গেলেন ।

স্যারের এই নীরবে বের হয়ে যাওয়া আমাদের মনে কিছু প্রশ্ন রেখে গেলো যা আমরা বুঝতে পারলাম আরো পরে, পি সি মজুমদার স্যারের অঙ্ক ক্লাসে । মজুমদার স্যার কথায় কথায় বলেন “তাহলে পরে” । মুদ্রাদোষ ।

 “তাহলে পরে চালের দাম ২৫% বৃদ্ধি পেলে কত পার্সেন্ট খরচ কমালে সংসারে খরচের কোন হেরফের হবে না?”

 আমাদের ক্লাসের কাশিফ বানরের বানর । বলে  উঠলো- “স্যার ঘুষ খাবে।  ঘুষের  টাকা থাকলে সংসারের খরচ আর কমাতে হবে না।”

 কাশিফের কথায় পুরো ক্লাস হেসে উঠলো ।

 স্যার ধমকে  উঠলেন, “এই ছেলে কি যা তা বলছো ? ঘুষ খাওয়া তো মহা পাপ। তাহলে পরে?”

 আমরা বুঝে গেলাম আমাদের স্যাররা এইসব মহাপাপের ভয়ে বাইরের জগৎ এড়িয়ে চলছেন । আর এখানে পড়ে রয়েছেন মানুষ গড়ার এক মহান শিল্প নিয়ে । তাদের এই আনন্দ খাটো করে দেখার অধিকার কারো নেই ।

ক্লাসে যখন এসব জটিল কথাবার্তা  চলছে তখন দেখি বাবুল হোসেন স্যার ( কিছুটা একরোখা আমাদের এ শিক্ষক) সাহান ভাই কে করিডোর  দিয়ে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন । সাহান ভাই করুণ স্বরে বলছেন “স্যার আমি দেখে লেখি নাই”।

কে শুনে কার কথা । স্যার ‘নো’ ‘নো’ করছেন ।

সাহান ভাই আমাদের এক বছরের সিনিয়র । খুব মজা করে কথা বলতে পারেন । নিষ্পাপ একটা চেহারা । সারাক্ষন মুখে হাসি লেগেই থাকে । দেখলে মনে হয় এক মজার জগৎ থেকে পথ ভুলে চলে এসেছেন আমাদের কাছে -তার এই অবস্থা ? আমাদের বুকটা ধুক করে উঠলো । নকল টকলের কেস না তো ? তাহলে তো সোজা আউট । আমরা মনে মনে দোয়া দরুদ পড়তে লাগলাম । আমাদের ক্লাসের আব্দুল্লাহ খবর নিয়ে আসলো সাহান ভাই পাশের  জনের  খাতা  থেকে কপি করতে গিয়ে ধরা পড়েছেন ।

পুরো কলেজ জুড়ে শুনশান নীরবতা । মাঝে মাঝে ওস্তাদের বাঁশির আওয়াজ শুনা আওয়াজ যাচ্ছে । এক  সময়  দেখি সাহান ভাইকে কোয়ার্টার গার্ডে নেয়া হচ্ছে, সাদা পোশাকে । কি কষ্টকর চাহনি !

কবির স্যার তখন বাসায় । সকাল থেকেই কোন এক কারনে তিনি বাসায় রয়েছেন । খবর পেয়ে দৌড়ে আসলেন কলেজে। সেখান থেকে প্রিন্সিপালের অফিস । প্রিন্সিপালের সাথে তার গলায় গলায় ভাব। তিনি বললেন, “ স্যার,  সবাই যেহেতু বলাবলি করছে আমার মনে হয় কেস টা আর একবার রিভিউ হওয়া দরকার । আপনি একবার কনসিডার করুন।”

প্রিন্সিপাল চালাক লোক । অতো ঝুট ঝামেলায় গেলেন না । ক্যাডেট দু’ একজন আউট হলেই ভালো । অন্যদেরকেও শিক্ষা দেয়া যাবে । এমনিতেই ক্লাস টুয়েলভ বাড়াবাড়ি করছে । পেছন থেকে তাকে গাধা টাধা ডাকে । এর একটা বিহিত হওয়া দরকার ।

“দেখুন কবির সাহেব, আমি আপনার আবেগ বুঝি বাট আই ক্যান নট গো বিয়ন্ড রুলস।”

প্রিন্সিপাল রুলের বাইরে গেলেন না । অবলীলায় বের করে দিলেন শাহান ভাইকে ।

এখনো স্পষ্ট মনে আছে বসন্তের এক নিদাঘ দুপুরে আমরা শাহান ভাইকে চলে যেতে দেখলাম চির দিনের জন্য। সবার চোখে নীরব কষ্ট । অনেকের চোখে পানি । 

এফ সি সি (ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ) - র ইট বালুও হয়তো সেদিন কেঁদেছিলো। কিন্তু সেই কান্না নির্ঘাত ছদ্ম কাঠিন্য নিয়ে থাকা আমাদের স্যারদের তুলনায় কিছুই না । তারা হয়তো কেঁদেছিলেন অনেক দিন.. অনেক রাত…তাদের নাড়িছেঁড়া ধনের জন্য । কত আপন সে সম্পর্ক ....