মুসলমানদের প্রধান দুটি ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। সামনেই আসছে ঈদুল ফিতর। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মুসলমানগণ ঈদুল ফিতর উদযাপন করেন। এই দিনটি ধর্মপ্রাণ মুসলমানের কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যবহ এবং আধ্যাত্মিক সুষমামন্ডিত।
পবিত্র ঈদের দিন সকালেই মুসলমানগণ সমবেত হন মসজিদ বা ঈদগা ময়দানে ঈদের বিশেষ নামাজ আদায় করার জন্য। নামাজের পর শুরু হয় ঈদ উৎসব। কিন্তু এই উৎসবের চিত্রটি প্রবাসী বাঙ্গালীদের বেলায় কেমন হয়?
প্রবাসে ঈদ উৎসবের চিত্রটি একটু ভিন্ন মাত্রার হয় তাতে কোন সন্দেহ নেই। প্রথমেই আসা যাক রোজা প্রসঙ্গে। কানাডায় সামার টাইমে রোজা রাখতে হয় প্রায় ১৬/১৭ ঘন্টা! এখানে যারা রেস্টুরেন্ট বা মিল-ফ্যাক্টরীতে কাজ করেন, অথবা যারা ক্যাব চালান তাদের জন্য সামার টাইমটা খুব চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাড়ায় রোজা রাখার জন্য। অফিস আদালতে যারা কাজ করেন তাদের জন্য যে চ্যালেঞ্জিং এর মাত্রা কম তা বলা যাবে না। তবে তুলনা করলে এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে অফিস কর্মীদের বেলায় চ্যালেঞ্জিং এর মাত্রা কিছুটা কম। কিন্তু তারপরও যারা ধর্মপ্রাণ তারা এই চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করতে পিছ পা হন না। কষ্ট যতই হোক রোজা তারা রাখেন। আর যাদের মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতি বা বিশ্বাস কম তারা নানান অজুহাত ও খোঁড়া যুক্তি খুঁজতে থাকেন রোজা না রাখার পক্ষে। কিন্তু ঈদের দিন ঈদ উৎসবের পুরোটাই আবার তারা উপভোগ করেন।
আর যাদের ধর্ম বিশ্বাস একেবারেই নেই তাদের তো রোজা রাখার প্রশ্নই আসে না। তবে সামাজিকতা রক্ষার জন্য তারাও এই দিন অন্যান্যদের সঙ্গে ঈদ উৎসবে যোগ দেন ঠিকই। কেউ কেউ হয়তো ঈদ জামাতেও যোগ দেন।
কানাডার বড় বড় শহরগুলোতে বিশেষ করে টরন্টো, মন্ট্রিয়ল, অটোয়া এবং ভেঙ্গুভারেই প্রধানত মুসলমানদের বাস। এই শহরগুলোতে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু মসজিদও গড়ে উঠেছে। ঈদের জামাতগুলো প্রধানত এইসব মসজিদেই অনুষ্ঠিত হয়। মসজিদের বাইরেও অনুষ্ঠিত হয় ঈদ জামাত। টরন্টোতে সবচেয়ে বড় ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয় ডাউনটাউনে অবস্থিত এক্সিভিশন সেন্টারে।
টরন্টোতে অবশ্য বাঙ্গালীদের উদ্যোগে মসজিদের বাইরে খোলা মাঠেও ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে গত কয়েক বছর ধরে। বাঙ্গালী অধ্যুষিত ড্যানফোর্থের ডেন্টোনিয়া পার্কের মাঠে অনুষ্ঠিত হয় এই জামাত। মহিলারাও যোগ দেন এই জামাতে। গত বছর ডেন্টোনিয়া পার্কের ঈদ জামাতে প্রায় পাঁচ হাজার লোক অংশগ্রহণ করেন। মেইন স্ট্রিমের রাজনীতিকরাও এতে উপস্থিত হয়ে সকলের সঙ্গে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।
খোলা মাঠে ঈদের জামাতের সফলতা নির্ভর করে আবহাওয়ার উপর। কানাডায় আবহাওয়া একটি মূখ্য বিষয়। মানুষের জীবনযাপন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে এই আবহাওয়া। প্রতিদিন ঘর থেকে বের হওয়ার আগে এই আবহাওয়ার খবর নিয়েই বের হতে হয়।
টরন্টোতে মুসলমানদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বলা যায় দ্রুতই বাড়ছে। সেই সাথে বাড়ছে মসজিদের সংখ্যাও। বাঙ্গালী অধ্যুষিত ড্যানফোর্থের কেন্দ্রস্থলে এখন তিনটি মসজিদ রয়েছে। আশেপাশে আরো নতুন নতুন মসজিদ গড়ে উঠছে। জুম্মার দিন এবং ঈদের দিন এই মসজিদগুলোতে স্থানসংকুলান হয়না। ফলে তিন থেকে চারটি জামাতের আয়োজন করতে হয়। কিন্তু তারপরও এত ভিড় হয় যে তা সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠে পরিস্থিতি। ফায়ার কোড মানা হয় না। মসজিদের ভিতর উপচে পড়া ভিড়ে কোন দুর্ঘনা ঘটলে পরিস্থিতি তখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এ বিষয়ে কারো কোন উদ্বেগ আছে বলে মনে হয় না।
টরন্টোতে ঈদের দিনটি নিয়েও প্রায় প্রতি বছরই একটি সমস্যা তৈরী হয়। একদল শুক্রবার ঈদ উদযাপন করেন তো অন্য দল শনিবার ঈদ উদযাপন করেন। বাঙ্গালীদের মধ্যেও একই পরিস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ফলে টরন্টোতে প্রায় প্রতি ঈদেই ঈদ উদযাপন হয় দুই দিন। কেউ কেউ অবশ্য বলেন- মন্দ কি, দুই দিনই আনন্দ উৎসব করা গেল।
টরন্টোতে ঈদের আনন্দ উপভোগ করা সময় সময় একটু কঠিনই হয়ে দাড়ায়। যদি উইক ডে’তে ঈদ হয় তবে অনেকেই ছুটি ম্যানেজ করতে পারেন না। অথবা স্বামী ছুটি ম্যানেজ করতে পারলেও স্ত্রী তা পারেন না। বা তার উল্টোটিও হয়। অর্থাৎ স্ত্রী ছুটি ম্যানেজ করতে পারলেও স্বামী তা পারেন না। অপর দিকে রয়েছে ছেলে-মেয়েদের স্কুল। টরন্টোতে ঈদের দিনে স্কুল কলেজ বা ইউনিভার্সিটি বন্ধ থাকে না। তবে কোন ছাত্র বা ছাত্রী ইচ্ছে করলে অনুমতি নিয়ে ক্লাসে অনুপস্থিত থাকতে পারে।
অবশ্য টরন্টোর মুসলমান ছাত্র-ছাত্রীরা ঈদের দিন অনুষ্ঠানিক ছুটি না পেলেও নিউইয়র্কের মুসলমান ছাত্র-ছাত্রীরা এ সুযোগ পেয়ে আসছে। ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক নগরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোতে প্রথমবারের মতো মুসলমান নাগরিকদের জন্য ঈদের ছুটি ঘোষণা করা হয়। উল্লেখ্য যে, তার আগে ডেমোক্রেটিক পার্টির মেয়র প্রার্থী বিল ডি ব্লজিও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এই বলে যে, মেয়র নির্বাচিত হলে তিনি মুসলমানদের দুই ঈদে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটির ব্যবস্থা করবেন।
বর্তমানে নিউইয়র্ক পাবলিক স্কুলগুলোতে দুই ঈদে সাধারণ ছুটি থাকে। উল্লেখ্য যে, আগে থেকে ইহুদি ও খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের উৎসবে ছুটি ছিল। নিউইয়র্কে মুসলমান অভিবাসীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় ঈদে স্কুল ছুটি রাখার দাবি জোরালো হয়ে ওঠেছিল সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। কিন্তু নিউইয়র্কের সাবেক মেয়র মাইকেল ব্লুমবার্গ ধর্মীয় উৎসবের নামে স্কুল বন্ধ রাখার বিরোধিতা করে আসছিলেন।
নিউইয়র্কের পাবলিক স্কুলগুলোতে ঈদের দিন ছুটি ঘোষণা করার পর টরন্টোতেও অনেকে উৎসাহিত হয়ে উঠেছিলেন বিষয়টি নিয়ে। কিন্তু সেটি আপাতত সম্ভব হচ্ছে না। এরকম সম্ভাবনার ধারে কাছেও নেই টরন্টো। এ কথা জানিয়েছেন হিউম্যান রাইটস ল’ইয়ার এবং ন্যাশনাল কাউন্সিল অব কানাডিয়ান মুসলিম’স হিউম্যান রাইটস কমিটির প্রধান মিহাদ ফাহমি। সিবিসি নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি আরো জানান, কানাডার হিউম্যান রাইটস ল কোন স্কুলকে অনুমতি দেয়নি ছাত্র-ছাত্রীদেরকে জরিমানা করার জন্য যদি তারা ধর্মীয় উৎসব বা পার্বনের দিন স্কুলে না আসে। ছাত্র-ছাত্রীরা ঐরকম পরিস্থিতিতে স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে ছুটির জন্য আবেদন করতে পারে। শুধু ছাত্র-ছাত্রীরাই নয়, স্কুলের শিক্ষকগণও ধর্মীয় উৎসব বা পার্বনের জন্য ছুটির আবেদন করতে পারেন। ফাহমি’র মতে এখানে স্কুলগুলোতে মুসলমানদের জন্য সাধারণ ছুটি ঘোষণার প্রয়োজন নেই কারণ, ছাত্র-ছাত্রীরা ইচ্ছা করলেই ঐ বিশেষ দিনগুলোতে স্কুল থেকে ছুটি নিতে পারে।
এই ছুটি সংক্রান্ত ঝামেলার কারণে টরন্টোতে উইক ডে‘তে ঈদ হলে বাঙ্গালী মুসলমানরা ঠিক মত তা উপভোগ করতে পারেন না। আর যদি ঈদ শীতের দিনে হয়, রাস্তাঘাট তুষারে আবৃত থাকে তখনও আনন্দ উৎসবে বিঘœ ঘটে। আবার কোন কোন পরিবার আছে যারা একদিন কাজে না গেলে মর্টগেজ পেমেন্ট, ক্রেডিড কার্ড পেমেন্টে ইত্যাদি নিয়ে উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠেন।
এগুলো বাদ দিলে আরেকটি যে সমস্যা প্রবাসীদের হয় তা হলো, উৎসব আনন্দের দিনে আত্মীয় পরিজনদের কাছে না পাওয়া। কানাডায় অধিকাংশ বাংলাদেশীর বাবা-মা, ভাই-বোন বা অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন দেশে থাকেন। এমন দিনে তাদের ছাড়াই ঈদ আনন্দ উপভোগ করতে হয়। সেই আনন্দ উপভোগে কিছুটা শুণ্যতা থেকেই যায় যা পূরণ করার একটা ব্যর্থ প্রয়াস প্রবাসীরা করে থাকেন টেলিফোনের মাধ্যমে। আজকাল অবশ্য স্কাইপ বা ঐ জাতীয় আরো কিছু প্রযুক্তি যোগ হয়েছে যোগাযোগের ক্ষেত্রে। এটিও আনন্দ উপভোগে কিছুটা সান্ত¡না অবশ্যই যোগায়। কিন্তু ষোল আনা কি আর হয় তাতে?
তারপরও বলবো, প্রবাসীরা ঈদ আনন্দ উপভোগ করেন। ষোল আনা না হোক, তার কাছাকাছিতো অবশ্যই। দেশের আত্মীয় পরিজনদের অভাব মিটান এখানকার প্রতিবেশী ও পারিবারিক বন্ধুদের মাধ্যমে। প্রবাসে একটি অলিখিত রীতি হলো, ‘তোমার নিকটতম প্রতিবেশী তোমার সবচেয়ে বড় আত্মীয়।’ কারণ, কোন আপদ বিপদ হলে সেই সবচেয়ে প্রথম এগিয়ে আসবে। হাজার হাজার মাইল দুরের আত্মীয় বন্ধুরা দুরত্বের কারণে প্রাথমিকভাবে কিছুই করতে পারে না।
এই প্রবাসে ঈদ উৎসবসহ পূজা পার্বন বা অন্যান্য অনুষ্ঠানে বাঙ্গালীদের মধ্যে যে আতিথেয়তা লক্ষ্য করা যায় তা নিঃসন্দেহে প্রশংসা করার মত। উপলক্ষ্য যাই হোক, বাড়িতে মেহমান আসলে মনেই হয় না যে সে অনাত্মীয় কেউ। কিংবা কেউ কারো বাড়িতে গেলে যে ধরণে আপ্যায়ন পান তাতে করে খুব সহজেই মনে হতে পারে যে, তিনি কোন আত্মীয়ের বাড়িতেই বেড়াতে গিয়েছেন।
যদি আবহাওয়া ও অন্যান্য বিষয়গুলো অনুকুলে থাকে তবে উৎসব আনন্দে সবাই মেতে উঠেন এই প্রবাসে। বাড়িতে বাড়িত ঈদের রান্না, ঈদের সাজগোজ, অতিথি আপ্যায়ন, ঈদের জামাত, ঈদ মেলা, ঈদ পূনর্মিলনি এসব কোনটাইতো বাদ যায় না প্রবাসীদের জীবন থেকে। বাঙ্গালী অধ্যুষিত ড্যানফোর্থে ঈদের দিন ঘুরতে গেলে মনেই হবে না যে আমরা বিদেশে আছি। বড়জোর মনে হতে পারে আমরা গুলশান বনানীর কূটনৈতিক জোনে আছি যেখান বাঙ্গালীদের মধ্যে কিছু বিদেশীর আনাগোনাও লক্ষ্য করা যায়।
সব মিলিয়ে বলবো, প্রবাসে ঈদ উৎসবে আনন্দের পাল্লাটাই ভারী। নিরানন্দের পাল্লা অনেক হালকা।
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক, প্রবাসী কণ্ঠ