ক’ দিন ধরে একটানা ভেজভেজা বৃষ্টির পর আজ আকাশ ফুড়ে বেরিয়ে আসে মিষ্টি রোদের খেলা। শীতের আমেজটাও ছড়িয়ে পড়ে আকাশে বাতাসে। শাওনের মনটা অনেকদিন পর ঝরঝরে হয়। কারণ একটা আছে। সেই কতকাল আগে রেইনির সাথ ডেটিং হয়েছিল, আজ অনেক কষ্টে সেইসব দিনগুলো মনের আঙ্গিনা ছুঁয়ে যায়। সে সব পাঠ চুকেবুকে গেছে সে অনেককাল। আজ হয়ত সে রকম একটি দিন ওর জীবনে ঘটতে যাচ্ছে। একটি টান টান উত্তেজনার দিন। জীবনের হাঁফ সেঞ্চুরী পার করে দিয়ে এমন করে শাওনের বুড়ো খোঁড়া জীবনে রোমাঞ্চ এভাবে ধরা দেবে ও ভাবতেও পারে নি। শাওনতো চায়নি এতসব। অরণী কার এক্সিডেন্টে মারা যাওয়ার পর আজ পাঁচটা বছর বুকের উপর হিমালয় চাঁপা দিয়ে অনিককে নিয়ে তার ব্যাথাতুর সময় সাগর পাড়ি দিয়ে ছুটে চলেছিল মৃত্যুদিনের দিকে। হঠাৎ কেমন একটা ঝড় এসে সব ওলট পালট করে দিয়ে গেল। বুড়ো হয়ে যাচ্ছে এই কথাটা ভাবতেও ওর বুকের ভেতরে কেমন একটা ক্ষতের জ্বালা নিমেষে ছড়িয়ে পড়ে। শাওনের বয়েসটা একেবারেই বোঝা যায় না। সে কথাটা ও জানে। বিশেষ করে ও যখন কাল প্রিন্টেড ক্যাজুয়াল শার্টের সাথে কালো ফুল প্যান্ট পরে বের হয় তখন অনেক মেয়েরই ঘুম হারাম হয়। এতসব ভীড়ের আকর্ষণ থেকে নিজেকে আড়াল করবার বিশেষ ক্ষমতাটা ও রপ্ত করেছে ভালই। তবুও জীবনে চলার পথে খানা খন্দের মাঝে এক আধবার পড়া থেকে নিস্তার পাওয়াটা হয়তো কঠিন ব্যাপার।
নেটে মাসখানেক আগে খেলার ছলে চ্যাট করতে করতেই কান্ডটা ঘটে যায়। মেয়েটা কবিতা লেখে তাই ভালো লেগে যায়। আর এই ভালো লাগাই বিপত্তির কারণ। একদিন ইলেক্ট্রনিক মেইলে পাঠায় কবিতা। কবিতাটা এতো ভালো যে মন ছুঁয়ে যায়। শাওন একটু আধটু কবিতা লেখে। কবিতা ওর ডায়রির মত। কবিতা ওর জীবনের জলছবি। জবাবে সেও একটা কবিতা পাঠায়। এভাবে নেটে ওদের আলাপ প্রগাড় হয়। দিনের শেষে কম্পিউটারের সামনে বসা ওর একটা নেশা হয়ে দাঁড়ায়। আগে একটা চাকরী করত। অরণী মারা যাবার পর এই কটা বছর নিজস্ব ব্যবসা নিয়ে ব্যাস্ত। ব্যবসায় সফলতাও এসেছে। একমাত্র ছেলে অনিকের বয়েস এখন চৌদ্দের কোঠায়। নবম শ্রেণীর ছাত্র। অনিকের দিকে চেয়েই শাওন সব ভুলে গেছে। তবু এক অসীম নিঃসঙ্গতা তাকে কুরে কুরে খায়। শাওনের জীবনে বিকেলের এই পড়ন্ত রোদের বেলায় সূর্য যেন নতুনভাবে উঁকি দেয়। এক নতুন ভালোবাসা তিরতির করে কাপায় খোঁড়া জীবনটাকে। এতদিন পর আবার নিজেকে মানুষ মনে হয়। মেয়েটার নামটা মনে হতেই বুকের মধ্যে ছলাত করে ওঠে ‘সেঁওতি’ – সেঁওতি শব্দের মানে সাদা গোলাপ। অনেকবারই শাওন সেঁওতিকে অনুরোধ করেছে ওর ছবি পাঠাবার জন্য। মেয়েটা ভারী লাজুক, ছবি পাঠাতে চায় না। ওর বয়েস ছাব্বিশের কোঠায়। ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের লেখা বিকেলের ফুল বইটা শাওন পড়েছে। উত্তম কুমার অভিনীত ছবিটিও সে দেখেছে। ওর বিকেল বেলায় যে এমন একটি ফুল কার্নিশের ধার ঘেষে বুকের একেবারে মধ্যেখানে উঠে আসবে আগে কখনও কল্পনাতেও ভাবেনি। আজ শুক্রুবার। গত রোববার একটা ইমেইল আসে। এই মেইলটা ওপেন করার আগেই দেখে সাব্জেক্টের ঘরে লেখা ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা’। শরীরের ভেতর দিয়ে কতকাল পর কতযুগ পর হাজার ভোল্ট ইলেক্ট্রিক কারেন্ট পাস হয়ে যায়। ভয়ে ভয়ে সে মেইল্টা ওপেন করেই দেখতে পায় ছোট একটা ম্যাসেজ। কবিতার ভাষায় লেখা চিঠি।
‘শাওন আমার, কি চাও তুমি
দীর্ঘসময় চাওকি তুমি দেহের আলাপন,
চার বেলাতে, চারটি ঠোঁটের দুষ্টু কাঁপন,
রক্তে তোমার ঝড়ের মাতন,
উষ্ণ সুখের জীবন যাপন?
সব কিছুই দিতে পারি, শর্ত তবে
হৃদকলমে চার শব্দে লিখতে হবে
আমি তোমার
শুধুই তোমার।
চিঠির পাদটিকায় লেখা থাকে, ‘তোমার একটা ছবি পাঠাও, তোমার ছবি পেলেই আমারটা পাঠাব।‘ চিঠিটা পাবার পর একটা মিশ্র অনুভূতি শাওনকে দোটানায় ফেলে দিল। সামনের দিনগুলোর কথা ভেবে পাওয়ার কি তীব্র আকাংখ্যা। এমন জৈবিক চাহিদাকে কেবল মুখে অস্বীকার করলেও বাস্তবে এড়ানোটা খুব কঠিন কাজ।
অনেক ক্ষেত্রে মানুষ এ সবের অভাবে জড় পদার্থে পরিণত হয়। শাওন মাঝে মাঝে নিজেকে কোন মহান স্থপ্তির তৈরি পাথুরে মূর্তি মনে করে। আজ যেন সেই মূর্তির শরীরে কেউ প্রাণের ছোঁয়া দিয়ে গেল। এদিকে সেঁওতির লেখা ‘শুধুই তোমার’ শব্দ দুটো পাঁচ টনি লরির মত ভারী হয়ে বুকের মাঝে চেপে বসেছে। ঠিক এই মুহূর্তে ভাবা কঠিন যে শাওন শুধুই সেঁওতির। বাতাসে শাওন বকুল ফুলের গন্ধ পায়। মনে হয় জলপাই রঙের জামদানী পরে, খোঁপায় বকুল ফুলের মালা জড়িয়ে পেছন থেকে চোখ দুটো চেপে ধরেছে অরণী। দীর্ঘশ্বাসের সাথে বেরিয়ে আসে, ‘সেঁওতি কি করে আমি তোমার? আমি তো আমার অরণীর। তোমাকে আমার অবশ্যি খুব ভালো লাগে কিন্তু কি করে শুধু তোমারই হই?’ শাওনের মাথাটা গরম হয়ে যায়। বাথরুমের ঢুকে শাওয়ারের নীচে অনেক্ষণ শরীরটাকে শীতল করে নেয়। তখন অনেক রাত। অনিক তার রুমে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। কেয়ারটেকার রহমতুল্লাহও কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। ওর কাছে হঠাৎ মনে হয় এই বিরাট পৃথিবীতে সে ছাড়া আর কেউ জেগে নেই। বাইরে সজোরে বৃষ্টি পড়ছে। সিঁড়িতে পঙ্কজ কুমার মল্লিকের গাওয়া গান বাজছে ‘আজই ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার পরাণ সখা বন্ধু হে আমার’। শাওন ভাবে, মানুষের জীবন তো থেমে থাকে না। ঢেউয়ের পর ঢেউ যেমন সমুদ্রকে জীবন্ত রাখে তেমনই নতুন ঢেউ – এর মত সেঁওতিও ওর জীবনটাকে দোলায়িত করবে।
কম্পিউটারে মাই পিকচারস ফোল্ডার হাতিয়ে নিজের একটা সুন্দর ছবি সেঁওতিকে পাঠায়। সঙ্গে কোন চিঠি নয়। রবীন্দ্রনাথের গানের দুটা লাইন ‘আমি তোমারই সঙ্গে বেধেছি আমারও প্রাণ’। এরপর সময়ের চাকা ঘোরে, কেটে যায় আরোও কটা দিন। বৃহস্পতিবার মেইল ওপেন করেই ‘শুভ সংবাদ’ জীবন পালটে দেয়ার খবর। মেইল পড়ে ওর আনন্দ আর ধরে না। সেঁওতি কোন ছবি পাঠায়নি। একেবারে ডেটিং এর প্রস্তাব। ও লিখেছে শুক্রুবার ঠিক তিনটায় ও কফি হাউসে আসবে। পরনে থাকবে আকাশী নীল জর্জেট শাড়ি। আকাশী রংটা শাওনের খুব পছন্দ।
আজ শাওনের জীবনের আর এক শুভ লগ্নের সূচনা হতে যাচ্ছে। আজ বিশ্বে যেন সবচেয়ে আনন্দের এই দিনটি ‘শুক্রুবার’। সকাল থেকেই চলে প্রস্তুতিপর্ব। অনিককে সকালেই ছোট আপার বাসায় দিয়ে আসে। ছোট আপার বাসা ওর বাসা থেকে খুব কাছে। শাওন থাকে ধানমন্ডি পুরাতন ৩১ নং রোডে। আর ছোট আপার বাসা ধানমন্ডি রোড নং ১২/এ। ছোট আপা খুব উদার মনের মানুষ। ওখানে ওর ছেলেমেয়েদের সাথে অনিকের সময় ভালোই কাটবে। হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকাতেই চমকে ওঠে শাওন। এখন বেলা একটা। আর মাত্র দু’ঘন্টা বাকী সেই শুভ মুহূর্তের। বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। জুলফীর কাছে চুলগুলো রুপালী বর্ণ ধারন করেছে। সকালেই খুব সযত্নে চুলে নিজ হাতেই ডাই করেছে। মসৃণভাবে শেভ করেছে। তারপর শাওনের প্রিয় সেন্ট ব্রুট মেখেছে। ওল্ড স্পাইস শেভিং লোশনের গন্ধে সারা ঘর মৌ মৌ করে। কেন যেন আজকে প্যান্ট শার্ট পরতে মোটেই ইচ্ছে হয় নি। প্যান্ট শার্ট পরেও অতটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। হেমন্ত প্রায় শেষ। হাল্কা শীতের আমেজে মন ভরে ওঠে। কালো রঙের পাঞ্জাবী পরে নেয়। বুকের কাছে হাল্কা সুতার কাজ। আয়নায় নিজেকে কয়েকবার দেখে নেয়। চুলটা ঠিক ঠাক করে।নিজের চোখে নিজেকে বেশ দেখায়।
মনটা এমনই চাঙ্গা হয় যে বাতাসে ভাসতে ইচ্ছে হয়। ভাবে সেঁওতি দেখতে যেন কেমন। তবে যে বর্ণনা পেয়েছে তাতে একেবারে অপ্সরী না হলেও আকর্ষণীয়তো হবেই। মনে মনে কল্পনায় কত ছবি আঁকে। তার ভাবনা থেকে বাস্তবের দূরত্বটা হয়ত তেমনটা নয়। ভাবে কি কথা দিয়ে শুরু করবে আলাপচারিতা। না, ও শুরু করবে না, শুধু অপলক চেয়ে থাকবে। ওর ধ্যানমগ্নতা হয়ত সেঁওতিই ভাঙবে। কোকিল কন্ঠে কথা বলে উঠবে। শান্ত বিকেলে বুকের মধ্যে ছড়িয়ে দেবে বসন্তের উত্তাল হাওয়া। এতসব ভাবতে ভাবতে ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই উঠে দাঁড়ায়। না, এবার বেরুতে হবে।
যথারীতি সিনেমার নায়কদের কায়দায় হাতে তুলে নেয় রজনীগন্ধার তোড়া। মেইন ডোরে তালা লাগায়। আজ আর কোন ড্রাইভার নয়, নিজেই ড্রাইভ করবে। কালো রঙের টয়োটা ভিস্তায় চড়ে বসে। বেশ বড় সড় গাড়ী। লং ড্রাইভের জন্য খুব আরামদায়ক। মনে মনে পরিকল্পনা করে ওকে নিয়ে প্রিয় জায়গা সোনারগাঁয়ে যাবে একদিন। আজ আর যাওয়া হবে না। পরিচয়পর্বেই অনেক সময় কেটে যাবে। শাওন ৩১ নং রোড দিয়ে না বের হয়ে ৩২ নম্বর রোড দিয়ে রওনা দেয়। ধানমন্ডী লেকের আশেপাশে ঘিরে চমৎকার একটা বিনোদনকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। আজ যে দিকেই তাকায় সোনা রঙ ছড়ানো। সূর্যটা কিছুটা পশ্চিমে হেলে পড়ে। চারদিকে কোমল উত্তাপ ছড়ায়। শাওন এসি বন্ধ করে গাড়ির গ্লাস নামিয়ে দেয়। ততক্ষণে গাড়ীয়া বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ফেলে কিছুটা এগিয়ে যায়। ডানদিকে চোখ পড়তেই দেখে লেকের ধার ঘেঁষে জোড়ায় জোড়ায় কপোত-কপতি বসা।
মনের আরশীতে ভেসে ওঠে সেঁওতির ছবি। গাড়ির সিডিরমে বাজায় বন্যার গাওয়া রবীন্দ্র সঙ্গীত ‘চোখের আলোয় দেখছিলেম চোখের বাহিরে, অন্তরে আজ দেখব যখন আলোক নাহিরে’। গানের ভেতরে এতই মজে যায় যে কখন কফি হাউসের সামনে পৌঁছে যায় বলতে পারে না। গাড়িটা পার্ক করে। ধীর লয়ে দুরু দুরু বক্ষে কফি হাউসের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। সেই কবে ওর বন্ধু রিঙ্কুর সাথে কফি হাউসে এসেছিল ঠিক মনে নেই। সেতো ছাত্র জীবনের কথা। তখন এলিফ্যান্ট রোডের এই কফি হাউসটা কেবল কফি হাউসই ছিল। স্প্রেসো কফি, কোল্ড কফি খেতে খেতে মচমচে গরম আড্ডার কথা ভোলার নয়। দরজাটা পেরিয়ে কফি হাউসে ঢোকে। ঢুকতেই মনটা ভরে যায়। গতানুগতিক চাইনিজ রেস্টুরেন্টের মৃদু আলোর চেয়ে আলো কিছুটা প্রখর। পরিবেশটা মনোহর। সুন্দর একটা হাল্কা বাজনার সুরে মন মাতাল হয়। বেয়ারা বেশ বিনয়ের সাথে সালাম দেয়। শাওন এক কোনায় একটা টেবিল বেছে নেয়। একটু দূরে কয়েকজন বসে আছে জোড়ায় জোড়ায়। খুব একটা ভীড় নেই দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। ঘড়িটা একবার দেখে নেয়। ঘড়ির কাঁটা তখন আড়াইটায়। আর মাত্র আধ ঘণ্টা। অপেক্ষার সময় বড় দীর্ঘ। ওয়েটার কাছে আসে। বলে, ‘স্যার অর্ডার কি এখন দেবেন?’ ও বলে ‘আমার একজন গেস্ট আসবে, অর্ডারটা একটু পরে দেই।‘
চোখটা নিবদ্ধ কফি হাউসের দরজায়। সময়ের কাঁটা কিছুতেওই নড়তে চায় না। মাত্র আধ ঘন্টা সময়কে অসীম মনে হয়। হঠাৎ হৃৎকম্পন্টা বেড়ে যায়। হৃদপিন্ডের আওয়াজটা প্যারেড গ্রাউন্ডের ড্রাম বিটের মত, কানের পর্দা যেন ফেটে যায়। আশেপাশের মানুষের কথার শব্দ দূরে বহুদূরে মিলিয়ে যায়। কফি হাউসের দরজা প্রথমে আকাশ নীলে ছেয়ে যায়। তারপর কফি হাউস। যেন আকাশের সমস্ত নীল এক নিমেষে ঢুকে পড়ে কফি হাউসের ভেতরে। সেই আকাশ জমিনে ফুটে থাকে এক সেঁওতি। হাতে তার লাল গোলাপের তোড়া। রাশি রাশি লাল গোলাপের মাঝে কিছুক্ষণের জন্য ডুবে যায় শাওন। সেঁওতি ওর হাতে লাল গোলাপ বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘আপনি কখন এসেছেন?’ এক সুরেলা কন্ঠে বেজে ওঠে বিথভেনের সিম্ফনি। এবার সম্বিত ফিরে পেয়ে উঠে দাড়ায় শাওন। মুখোমুখি হয় সেঁওতির। ওর হাতে তুলে দেয় রজনীগন্ধার তোড়া। শাওন কিছু বলার আগেই সেঁওতি একটা চেয়ার টেনে বসে। মুখোমুখি বসে শাওন। গভীর দৃষ্টিতে সেঁওতির চোখে চোখ রাখে। নিখাদ চেহারা। তরতাজা। একটা ফুটন্ত গোলাপ। সেঁওতি আবার কথা শুরু করে, “কেমন আছেন?” পরিবেশটা সহজ করতে চায়। উত্তরে শাওনের মুখে কথা সরে না। এই কন্ঠস্বর, দেহারা আদল যেন কতযুগের চেনা। সেঁওতিকে এক দন্ডের জন্যও অপরিচিত মনে হয় না। আজকাল শাওনের কি হয়েছে, খুব পরিচিত জনের নামও হঠাৎ মনে করতে পারে না। শাওন বলে,’কি খাবে বল? মেনু দেখে সিলেক্ট কর। অর্ডার দিয়ে দেই। তারপর না হয় কথা বলা যাবে।’ সেঁওতি বলে ‘আপনার পছন্দের খাবার আজ খাব, কাজেই সিলেক্টতো আপনি করবেন।’
শাওন নিজের পছন্দ মত বেছে বেছে খাবারের অর্ডার দেয়। থাই স্যুপ ওর খুব পছন্দ। টম ইয়াম গাই সুপের অর্ডার দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওয়েটার স্যুপ পরিবেশন করে। স্যুপ খেতে খেতে কথা শুরু হয়। সেঁওতি প্রথম বলে, ‘আপনার একটা খবর আছে।’ আমার খবর? চমকে ওঠে শাওন। বলে, ‘আমার আবার কি খবর?’ ‘না, মানে একটা চিঠি।‘ এই বলে সেঁওতি সাদা খামে জড়ানো একটা চিঠি শাওনের হাত তুলে দেয়।
সাদা খামের উপর স্পষ্ট অক্ষরে লেখা ‘শাওন’। হাতের লেখাটা খুবই পরিচিত। এতকালের স্মৃতি হাতড়েও ঠিক বুঝে উঠতে পারে না কার লেখা এ চিঠি? মনে পড়েও যেন আবার মনে পড়ে না। স্মৃতির চাকা বেশ কয়েক বছর ঘুরে যায়। এ লেখা তার কত আপন, কত কাছের। এ লেখা চাইলেই কি ভুলে যাওয়া যায়, চাইলেই কি মুছে ফেলা যায়? মস্তিস্ক এখন শরতের আকাশের মতই পরিষ্কার। এ যে রেইনির হাতের লেখা। ভুমিকম্পের মত সমস্ত ঘর সমস্ত টেবিল, সব কিছু কাপতে থাকে। সেঁওতির চেহারা মুহূর্তে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। ছোট একটা চিঠি। পরিষ্কার হয়ে ভেসে অঠে চোখের সামনে।
‘শাওন’
তুমি বাংলাদেশেই আছ। তারপর আবার ঢাকাতেই। কি আশ্চর্য তাই না? এতকাল তোমার কোন খোঁজ পাইনি। খোঁজ নেবার হয়ত চেষ্টা করিনি। কে হায় হৃদয় খুড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে? তুমি জীবনানন্দের কবিতা ভালো আবৃত্তি করতে। এখন কি কর? আজ অনেক অনেক লিখতে ইচ্ছে করছে। শক্তি পাচ্ছি না। হাত কাঁপছে। নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। সেঁওতি আমার একমাত্র মেয়ে। ওকে আকড়েই এতোকাল বেঁচে ছিলাম। আর চাইলেও বাচতে পারবো না। তুমি যেদিন সেঁওতির কাছে তোমার ছবিটা পাঠালে, ও আমাকে তখনই দেখিয়েছে। সেঁওতির কাছে সব কিছু পরিষ্কার হল। আমি সেঁওতিকে দিয়ে চিঠিটা তোমার কাছে পাঠালাম। এই বিদায় বেলায় তোমাকে দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। বিদায় বেলা বললাম এই জন্য কারণ আমার বিদায়ের নোটিশ মাস খানেক আগেই ডাক্তার দিয়ে দিয়েছে। বিষাক্ত ক্যান্সার আমার সমস্ত ফুসফুস ছেয়ে ফেলেছে। আর মাত্র কিছুদিন। আমি আর লিখতে পারছি না। আমার চোখ বর্ষার আকাশের মত বার বার মেঘে ছেয়ে যাচ্ছে। আমি সত্যি আর পারছি না। পারলে একবার এসো।
রেইনি
চিঠি শেষ করেই সেঁওতির দিকে চোখ পড়তেই শাওনের বুকের ভেতরটা ভেঙে খান খান হয়। নিজের অজান্তেই কতকাল পরে গড়িয়ে পড়ে চোখের জল। সেঁওতিকে মনে হচ্ছিল একটা প্রাণহীন শিলাখন্ড। ওর মুখে কোন কথা নাই। শাওন কথা শুরু করল। ওয়েটারকে ডেকে বল্ল, ‘আমাদের অর্ডারটা ক্যান্সেল করা যায়? আমার শরীরটা খুব খারাপ লাগছে, আমাকে এখনই বাড়ি যেতে হবে।’ ওয়েটার বল্ল, ‘অসুবিধা নাই, আমি বিল নিয়ে আসছি।’ শাওন বিল পরিশোধ করে উঠে দাঁড়াল।
সেঁওতি তখনও জড় পদার্থের মত বসে আছে। শাওন সেঁওতির হাত ধরে টান দিতেই সম্বিত ফিরে পায়। বলে,’চলুন যাওয়া যাক’।
শাওন জিজ্ঞেস করে,’তোমার মা এখন কোথায়?’
‘সেন্ট্রাল হাসপাতালে। এখান থেকে কাছেই।‘
শাওন সেঁওতিকে নিয়ে গাড়িতে ওঠে। কফি হাউস পেরিয়ে বাটা সিগনালের মোড়, তারপর গাড়িটা… না না এখন শাওনের কাছে গাড়ি মনে হয় না। কাল দৈত্যটা বিকট আওয়াজ করে সেন্ট্রাল হাসপাতালের দিকে ছুটে চলে। ভেতরে নির্জীব দুটি প্রাণী। কারও মুখে কথা নেই। পৃথিবীর তাবৎ ভাষা এসে যেন ওদের চোখে জমা হয়েছে। ওরা এখন নিজেদের হৃতপিন্ডে ড্রামের বিটের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। দূরে বহুদূরে আকাশের সীমানায় স্বপ্নের কফি হাউস ক্রমশ মিলিয়ে যায়।
এ যাত্রার শেষ কোথায়? কফি হাউস থেকে এ যেন এক অনন্ত যাত্রা।