আশির দশকের শেষের দিকের কথা । টিউশনি শুরু করলাম কলাবাগানের এক বাসায় । ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্রী পড়াই । নাম টিপসি । টিপসির বাবা মিঠু ভাই দরাজ দিলের মানুষ । মাস শেষ হবার আগেই টাকা দিয়ে বলেন, “আপনি ছাত্র মানুষ । টাকা পয়সার টানাটানি থাকে । লজ্জা করবেন না । দরকার হলে আমাকে বলবেন । একটু আধটু বেশি দিতে আমার কোনো অসুবিধা নাই।”
আমি উনার প্রশ্রয়ের কখনোই সুযোগ নেয় নি । এরমধ্যে ম্যাপেল লিফ স্কুল এর পেরেন্টস ডে ।
মিঠু ভাই আমাকে বললেন, “আপনার ছাত্রীর তো রেজাল্ট দিবে চলেন যাই।”
আমি অভাজনের মতো মিঠু ভাইয়ের সাথে গেলাম ।
টিপিসির রেজাল্ট দেয়া হলো । সবগুলোতে এ প্লাস । মিঠু ভাই আধ পাগলের মতো সব কান্ড করতে লাগলেন যার একটা নমুনা হলো - সুং গার্ডেন নামের চাইনিজ রেস্তোরায় ছোটোখাটো অনুষ্ঠানের মতো করে আমাকে পাঁচ হাজার টাকা বোনাস দিলেন । তখনকার পাঁচ হাজার অনেক টাকা ।
আমি হিসাব করতে লাগলাম পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে কি কি পাওয়া যায়। বিশ হাজারটা নাবিস্কোর টফি পাওয়া যায় । ছোট থাকতে এই টফির প্রতি ছিল প্রচন্ড লোভ । ছোট চাচা চাকরি করতেন নাবিস্কোতে। বিসকুট চকলেট উনাদের ফ্রি । আমরা ওই ফ্রি থেকে কিছু ভাগ পেতাম । খুব অল্প পরিমানে ।
সে অল্পতে তৃপ্তি মিটতো না । মেটার কথা ও না । নয় ভাই বোনের সংসার । বাবা মা মিলে এগারোজন । এই ভাগাভাগির সংসারে অল্প জিনিসের অনেক কদর । আব্বা বলতেন, “অল্পেই সুখ, বেশিতে নাশ” । এই নাশের ভয়ে আমরা কখনো বেশির দিকে হাত বাড়াইনি । সে অতৃপ্তিটা এখন মিটিয়ে ফেললে কেমন হয়? মন্দ হয় না । কিন্তু মানুষ তো পাগল বলবে । থাক, টাকাটা বরং ব্যাঙ্ক এ রেখে দেই । ব্যাঙ্ক একাউন্ট খোলা হলো ।
এর মধ্যে কি কারণে জানি দেশের বাড়ি যাওয়ার দরকার । বাসে যাচ্ছি নোয়াখালী । উঠতে না উঠতেই শুরু হলো হিন্দি গান... চাইয়া দেন লানা রে, বাচু পান কি মোহো বাচ গো । এসব হিন্দি গানের অর্থ কখনোই কিছু বুঝতাম না । আর ভালোও লাগতো না । মাথা ধরে যাওয়ার মতো বীভৎস সাউন্ড । আচ্ছা, এরা হিন্দি গান ছাড়া অন্য কিছু দিতে পারে না? এ প্রসঙ্গে একদিন এক বাস ড্রাইভার কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “আচ্ছা ভাই আপনারা রবীন্দ্র সংগীত দেন না কেন?”
তার সাফ সাফ জবাব, “এই সব ডান্ডির সংগীত আমরা শুনি না।”
পেছন থেকে কে একজন বলে উঠলো, “এই মিয়া আপনি রবীন্দ্রনাথকে চেনেন?”
“চিনবো না কেন? কলিকাত্তার ফিলিম এর ডাইরেক্টর।”
আমি বেকুব বনে গেলাম । কি বলবো? এদের কিছু বলা মানে খামাখা কথা বাড়ানো ।
পথে বিরতি । মিয়ার বাজার । বাস থামলো এক দোকানের সামনে। দোকানের নাম পান্থশালা । ময়লা টেবিল চেয়ার । কাউন্টারের পেছনে বাঁধাই করা কোন এক দরগার ছবি । নিচে লেখা - দয়াল বাবা । দয়াল বাবার হোটেলে ড্রাইভার সাহেব ধুমছে খানা দিলেন । আমি পরাটা আর গরুর মাংস খেয়ে আবার গাড়িতে উঠলাম । ফেনী আসতে না আসতেই শোরগোল। কি ব্যাপার? পেছন থেকে এক মহিলা চিৎকার করে কাঁদছেন .... “ও বাবাগো...মাগো আমার সব সব গেলো গো ........”
মহিলার গয়নাগাটি সব চুরি হয়ে গেছে ব্যাগ থেকে । বাস থামলো । মহিলা কালো একটা ব্যাগ বের করে দেখালেন ভেতর থেকে কাটা । মহিলার সাথে থাকা আট দশ বছরের একটা বাচ্চা মাকে ধরে বসে আছে । কি অসহায় দেখাচ্ছে তাকে! আমার বুকটা কেঁপে উঠলো । ঠিক অনেক দিন আগের আমি.......
তখন ভাদ্র মাস । আকাশ পাতাল বৃষ্টি । তিন চার দিন ধরে টানা বৃষ্টি হলো । ঝম ঝম বৃষ্টির শব্দে ঘোরের মতো লাগে । আমরা খাই, দাই আর ঘুমাই । ওম দেয়া লেপের ঘুম সহজে ভাঙতে চায় না । ওদিকে স্কুল ও ছুটি । স্কুলের টিনের চাল ফুটা হয়ে যাওয়ার অজুহাতে ক্লাস হয় না । হেড স্যার বিরস মুখে ঘোষণা করলেন, বৃষ্টি যাওয়া পর্যন্ত স্কুল বন্ধ থাকবে ।
এক বৃষ্টির সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি ঘরের সবার মুখ ভীষণ গম্ভীর । ওদিকে আম্মার চোখে পানি । অল্প পরেই জানা গেলো গত রাতে আমার মায়ের সব গয়না চুরী হয়ে গেছে । আমার মা দীর্ঘ জীবনে যেসব আনন্দ বেদনার স্মৃতি জমা রেখেছেন সবই খোয়া গেলো এক রাতে । অনেক দিন আমাদের বাসায় এ কষ্টের মেঘ ঘুরে ঘুরে বেড়ালো। আর আমাদেরকে ক্ষত বিক্ষত করলো তিলে তিলে । সে সময় আমি আমার বন্ধু শংকরকে (প্রতিবেশী এক স্বর্ণকারের ছেলে ) নিয়ে নানা জায়গায় ঘুরেছি চোরাই সোনার খুঁজে । লাভ হয় নি । এর অনেক দিন পর পর্যন্ত আমার মা কোথাও বেড়াতে যেতে চাইতেন না - হাত কান খালি বলে ।
এই মায়ের ঘটনা আমাকে সে দিনের কথা মনে করিয়ে দিলো । বাসে বসেই ঠিক করলাম বোনাসের টাকাটা আম্মার গয়না কেনার জন্য দেব । হোক না অনেক দিন পর । আম্মা হয়ত ওই কষ্ট অত দিন ধরে রাখেন নি । না রাখুক । আমি যা করার করবো ।
চৌমহনী বাজার (নোয়াখালীর গেটওয়ে) বাস থেকে নেমে শংকরকে খুঁজে বের করলাম ।শংকর বিশাল দোকান নিয়ে বসেছে আলুপট্টিতে । আমি তার সাথে হিসাব নিয়ে বসলাম। চুড়ি, কানের দুল, গলার হার ... কোনটার দাম কেমন । কোন কম্বিনেশন টা বেশি ভালো হবে । শংকর লাল শালুতে তে বাঁধা অর্ডারের খাতায় কি সব জটিল চিহ্ন এঁকে হিসাব করলো । সব মিলে চার হাজার পাঁচ শ টাকা পড়বে । ঠিক আছে । পড়ুক । আমি অর্ডার করলাম। শংকর এই কাজ শেষ করলো সাত দিনের মাথায়। অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে।
নগন্য এ উপহার পেয়ে আমার বয়স্ক মা বাচ্চা মেয়েদের মত ঘুরে ঘুরে পরে দেখতে লাগলেন । হঠাৎ তার চোখ দুটো দেখলাম চিক চিক করে উঠলো । আমি বললাম, “আম্মা কাঁদছেন নাকি?”
“নারে বাবা। চোখে কি যেন পড়েছে।”
আমি কথা বাড়াই না । আমাদের উঠানের চারপাশে তখন সন্ধ্যার অন্ধকার জমতে শুরু করেছে । অন্ধকারের শূন্যতায় এক বিশাল সুখের ছবি - আমার বুকে আঁকা থাকলো চির দিনের জন্য ।