Table of Content

Mahbub Rahman
NA
NA
1 articles

সাগর বন্দী

লেখক: মাহবুব রহমান Category: প্রবন্ধ (Essay) Edition: Dhaboman - Eid 2017

বেশ কিছুদিন আগে দ্যা অল্টমার্ক এফেয়ার নামে একটা বই পড়ার সুযোগ হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার সত্যি ঘটনা নিয়ে লেখা। বইয়ের কাহিনী এমনিতেই চমৎকার, তার উপরে ছিল এক বিশেষ চমক। আজ সেই গল্পটা বলছি।

১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমন করে। হিটলার ভেবেছিলেন পোল্যান্ডের মিত্র ফ্রান্স ও ব্রিটেন চুপচাপ থাকবে। কিন্তু দুটো দেশই জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করে- ফলে কার্যত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এযুগের যুদ্ধ মানেই সর্বাত্মক- জলে, স্থলে, আকাশে। স্থলে ও আকাশে জার্মানি ভয়ঙ্কর হলেও সমুদ্রে তার অতটা দাপট ছিল না। প্রচলিত নৌযুদ্ধে ব্রিটেনের সাথে টক্কর দেয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই জার্মানি অন্য কৌশল ধরে। গড়ে তোলে ডুবো জাহাজ বা ইউ-বোটের বহর। এগুলোর কাজ ছিল বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলের পথে ওৎঁ পেতে থাকা, আর সুযোগ মত সেগুলি ডুবিয়ে দেয়া। অবশ্য শত্রুপক্ষের ডুবো জাহাজ বা যুদ্ধজাহাজ গুলিকে খুব সাবধানে এড়িয়ে চলা হত। এ প্রসঙ্গে দ্য বোট (ডাস বুট) বইটির কথা মনে পড়ছে- ওই নামে একটা সিনেমাও আছে।

ডুবোজাহাজ ছাড়াও কয়েকটি ক্রুজার শ্রেণীর যুদ্ধজাহাজ বানানো হয়েছিল, সেগুলি পকেট ব্যাটলশিপ নামে পরিচিতি পেয়েছিল। গ্রাফ স্পী ছিল এই শ্রেণীর জাহাজ- সবচেয়ে অগ্রসর প্রযুক্তিতে তৈরি, দ্রুতগামী, গোলাগুলির নিশানায় অব্যর্থ। এটাকে মোতায়েন করা হল আটলান্টিক মহাসাগরের দক্ষিণ ভাগে। ব্রিটেনের শক্তির মূলে ছিল তার বিশ্বজোড়া উপনিবেশ। খাদ্যশস্য থেকে শুরু করে সব রকমের পণ্য জাহাজে করে ইংল্যান্ডে যায়। সেই পণ্য প্রবাহ বন্ধ করতে পারলেই ব্রিটেনের শক্তি অনেক কমে আসবে। গ্রাফ স্পীর ক্যাপ্টেন ল্যাংসডর্ফ- তাঁর উপরে নির্দেশ ছিল যেন শত্রুর যুদ্ধজাহাজের সাথে কোন সংঘাতে না যায়, এমনকি সেটা যদি দুর্বলও হয়। আর মালবাহী জাহাজগুলি ডোবানোর আগে যেন তার লোকজনকে সরিয়ে দেয়া হয়।

সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে গ্রাফ স্পীর প্রথম শিকার হলো ক্লিমেন্ট নামে এক মালবাহী জাহাজ। ব্রাজিলের উপকূল থেকে খানিক দূরে ক্লিমেন্টের পথ আটকে দাঁড়ালো গ্রাফ স্পী। ক্যাপ্টেন আর চীফ ইঞ্জিনিয়ারকে বন্দী করা হল। বাকী সবাইকে লাইফবোটে চড়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে দেয়া হল। তারপর কামান দেগে ক্লিমেন্টকে ডুবিয়ে দেয়া হল। ক্যাপ্টেন ল্যাংসডর্ফ সবচেয়ে কাছের নৌ ঘাঁটি পেরাম্বুকোতে সংকেত পাঠালেন যেন ক্লিমেন্টের নাবিকদের উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনার পরপরই ব্রিটিশ সরকার দ্রুত সতর্কবার্তা জারি করেন।

গ্রাফ স্পীর উপদ্রব বন্ধ করার জন্য অক্টোবর মাসেই ব্রিটিশ ও ফরাসি নৌবাহিনী আটটি দল গঠন করে। এরমধ্যে ছিল বিমানবাহী রণতরী হার্মিস, ঈগল, আর্ক রয়াল। এছাড়া রিনোওন, ডানকার্ক, স্ট্রাসবুর্গ সহ আরো ষোলটি নানা রকমের যুদ্ধজাহাজ। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকবে ফোর্স জি, যার অধিনায়ক ছিলেন কমোডর হেনরি হারউড। তাঁর অধীনে ছিল দুটো ভারী ক্রুজার কাম্বারল্যান্ড ও এক্সিটার, এবং আয়াক্স ও একিলিস নামে আরো দুটো হালকা ক্রুজার। কমোডর হেনরি হারউড তাঁর বহর নিয়ে বিশাল সমুদ্র চষে বেড়াতে লাগলেন সেই দস্যু জাহাজের খোঁজে।

ওদিকে ঠিক যেদিন ইঙ্গ-ফরাসি বাহিনী গঠন হলো- সেইদিনই গ্রাফ স্পী তার দ্বিতীয় শিকার ধরলো। এবারের শিকার নিউটন বীচ নামে আরেকটি ব্রিটিশ মালবাহী জাহাজ। নাবিকদের অবশ্য ওই জাহাজেই থাকতে বলা হল, এবং সেটিকে কাছাকাছি থেকে অনুসরণ করার হুকুম দেয়া হলো। দু’দিন পর এশলি নামে আরেকটা জাহাজকে পাকড়াও করল গ্রাফ স্পী। প্রথমে সম্ভবত ক্যাপ্টেন ল্যাংসডর্ফ ভেবেছিলেন জাহাজ দুটিকে তাদের লোকলস্কর ও মালামাল সহ ধরে একেবারে জার্মানিতে নিয়ে যাবেন। কিন্তু দেখা গেল কাজটা সম্ভব না। কারণ অতদূর যাবার মতন জ্বালানী নেই, তাছাড়া এদের গতিও কম। তার উপরে আছে শত্রুর ভয়। তাই বন্দীদেরকে তুলে নিয়ে দুটো জাহাজকেই কামান দেগে ডুবিয়ে দেয়া হল। এরপরেই হান্টসম্যান নামে আরেকটি মালবাহী জাহাজ গ্রাফ স্পীর খপ্পরে পড়ল। এখন সমস্যা হল বন্দীদের থাকা নিয়ে। যুদ্ধজাহাজে এতজন অতিরিক্ত লোক রাখার জায়গা নেই।

অল্টমার্ক ছিল একটা ট্যাংকার, যার কাজ গ্রাফ স্পীকে জ্বালানি ও অন্যান্য রসদ-পত্র যোগান দেয়া। তাই বিভিন্ন সময়ে নির্ধারিত জায়গায় গ্রাফ স্পীর সাথে এর মোলাকাত হত। হান্টসম্যানকে পাকড়াও করে নিয়ে যাওয়া হল যেখানে অল্টমার্ক অপেক্ষা করছিল। হান্টসম্যান ও গ্রাফ স্পী থেকে সব বন্দীদেরকে অল্টমার্কে তুলে দেয়া হল। অল্টমার্কের ক্যাপ্টেন ড’ কে কড়া নির্দেশ দেয়া হল বন্দীদের দেখভাল করার জন্য। এরপর হান্টসম্যানকে ডুবিয়ে দেয়া হলো। সেটা অক্টোবরের ১৭ তারিখ।

সপ্তাহ খানেক পরে ট্রেভানিওন নামে আরেকটা জাহাজ ডুবিয়ে দিল গ্রাফ স্পী। এরপর ক্যাপ্টেন ল্যাংসডর্ফ চললেন ভারত মহাসাগরে। উদ্দেশ্য মিত্রবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ গুলোকে আটলান্টিক থেকে সরিয়ে নিয়ে আসা এবং তাঁর পরিকল্পনা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা। সেখানে আফ্রিকা শেল নামের একটা ট্যাংকার হল তার শিকার। নভেম্বরের শেষের দিকে আবারো আটলান্টিক মহাসাগরে ফিরে এল গ্রাফ স্পী। আবারো নতুন করে হামলা চালানোর জন্য রসদ-পত্র বোঝাই করা হল তাতে। এছাড়া একটা ভূয়া চিমনী ও কিছু নকল কামান বসিয়ে এর চেহারা বেশ খানিকটা বদলে দেয়া হল যেন দূর থেকে সহজে চেনা না যায়।

এবারে ডোরিক স্টার নামে একটা জাহাজের পিছু নিল গ্রাফ স্পী। ডোরিক স্টারের ক্যপ্টেন অবশ্য আগেই বিপদ বুঝতে পেরে সঙ্কেত পাঠাতে পেরেছিলেন। সেই সঙ্কেত পেয়ে কমোডর হারউড তাঁর তিনটি ক্রুজার নিয়ে প্লাটা নদীর মোহানার কাছে অবস্থান নিলেন। তাঁর অনুমান- ওখানেই হবে গ্রাফ স্পীর পরবর্তী অপারেশন। ডিসেম্বরের ৫ তারিখে টায়রোয়া নামে আরেকটি জাহাজ ডুবিয়ে দেয় গ্রাফ স্পী। পরদিন ১৪০ জন বন্দীকে অল্টমার্কে তুলে দিয়ে আবার শিকারে বের হয় গ্রাফ স্পী।

ডিসেম্বর ৭। গ্রাফ স্পীর শেষ শিকার হয় স্ট্রেনশাল নামে আরেকটি মালবাহী জাহাজ। সেই জাহাজে  কিছু গোপন নথিপত্র পাওয়া যায়। সেগুলোর উপর ভিত্তি করে ল্যাংসডর্ফ চললেন উরুগুয়ের মন্টেভিডিওর দিকে- বড় রকমের শিকারের আশায়। কিন্ত গ্রাফ স্পীর যে ছোট উড়ো জাহাজটি আকাশে চক্কর মেরে নজরদারি করত সেটা এসময় বিকল হয়ে পড়ে। ফলে বিশাল খোলা সাগরে গ্রাফ স্পীর নজরদারি বেশ সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।

ডিসেম্বর ১৩ ভোরে গ্রাফ স্পীর চৌকিদার জানালো যে দূরে একজোড়া চিমনীর ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। ল্যাংসডর্ফ ভাবলেন এটা হচ্ছে সেই বিরাট মালবাহী জাহাজ বহরের অংশ, যা শিকারের আশায় তিনি এদিকে ছুটে এসেছেন। কিন্তু অচিরেই বোঝা গেল ওটা আসলে ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ এক্সিটার, সাথে রয়েছে আরো দুটি ক্রুজার।  এটা হচ্ছে আমাদের পূর্ব পরিচিত কমোডর হারউডের সেই বহর, গ্রাফ স্পীকে ধরবার আশায় ওই এলাকায় ঘোরাফেরা করছিল। যদিও নির্দেশ ছিল সংঘর্ষ এড়িয়ে চলার, ল্যাংসডর্ফ কিন্তু এযাত্রা যুদ্ধই স্থির করলেন। তাঁর ছিল আধুনিক কামান আর ভারী বর্ম, কিন্তু চটজলদি এদিক ওদিক ছোটার ব্যাপারে ব্রিটিশ জাহাজ গুলো ছিল বেশি দক্ষ। শুরু হল সাগরের বুকে ভয়াবহ যুদ্ধ। গ্রাফ স্পী একই সাথে এক্সিটার ও আয়াক্সকে লক্ষ্য করে গোলা ছুঁড়তে লাগল। মাত্র আধ ঘণ্টার যুদ্ধে এক্সিটারের মারাত্মক ক্ষতি হলো। এক্সিটারের বিপদ দেখে অন্য জাহাজ দুটি গোলা ছুঁড়তে ছুঁড়তে গ্রাফ স্পীর আরো কাছে ছুটে এল। ল্যাংসডর্ফ ভাবলেন ওরা বুঝি টর্পেডো হামলা করতে যাচ্ছে, তাই তিনি ধূ্ম্রজাল ছড়িয়ে জাহাজ ঘুরিয়ে দূরে সরে গেলেন। সেই ফাঁকে এক্সিটার রক্ষা পেয়ে গেল- ইতোমধ্যে ওটার শুধু পেছনের এক সার কামান অক্ষত আছে- নাবিকদের ৬১ জন মারা গেছে, আর ২৩ জন আহত।

কিছুক্ষণ পরে এক্সিটার আবার ফিরে এল- এবার পেছনের কামান থেকে গোলা ছুঁড়তে ছুঁড়তে। গ্রাফ স্পীও পালটা জবাব দিল। আরো কিছু গোলার আঘাত হজম করে অবশেষে এক্সিটার রণে ভংগ দিল। আয়াক্সের অবস্থাও বেশ সঙ্গীন, তার পেছনের কামানগুলো অকেজো হয়ে গেছে। গ্রাফ স্পীও যথেষ্ট ভুগেছে- প্রায় ৭০ টি গোলা লেগেছে তার গায়ে, ৩৬ জন মারা গেছে, ৬০ জন মারাত্মক আহত। ল্যাংসডর্ফ নিজে দু বার স্প্লিন্টারের আঘাতে আহত হয়েছেন। একবার কিছুক্ষণের জন্য জ্ঞান হারিয়েছিলেন। এ অবস্থায় যুদ্ধ বেশিক্ষণ আর চালানো যায় না- দু’পক্ষই এবারে রণে ভংগ দিল। গ্রাফ স্পী ঢুকে পড়ল প্লাটা নদীতে, আর ক্ষতবিক্ষত ব্রিটিশ জাহাজ তিনটি নদীর মোহনায় থানা গেড়ে বসল।

মন্টেভিডিওতে জাহাজ ভেড়ার পর নিহতদের সৎকার আর আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা হল। যেসব বন্দী গ্রাফ স্পীতে ছিল তাদের ছেড়ে দেয়া হল। আন্তর্জাতিক আইনে সেখানে মাত্র তিন দিন থাকা যাবে, এরপর জাহাজটি উরুগুয়ে সরকারের হাতে থাকবে যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত। জার্মানির আশঙ্কা ছিল যে উরুগুয়ে সরকার ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের ওই জাহাজে তল্লাশি করতে দেবে। তাই বার্লিন থেকে ল্যাংসডর্ফ এর কাছে বার্তা এল- গ্রাফ স্পী যেন কোন ভাবেই শত্রুর হাতে না পড়ে। ল্যাংসডর্ফের সামনে তখন শুধু দুটি পথ খোলা- যেকোনো ভাবে শত্রুর অবরোধ ভেঙ্গে বেরিয়ে এসে আর্জেন্টিনার বুয়েনস আয়ার্সে চলে যাওয়া, অথবা প্লাটা নদীতেই জাহাজটি ডুবিয়ে দেয়া। ওদিকে ব্রিটিশ গুপ্তচরদের মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে দেয়া হল যে আরো শক্তিশালী নৌবহর এদিক পানে ধেয়ে আসছে। ল্যাংসডর্ফ তাঁর ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজ নিয়ে অবরোধ ভাঙ্গার ঝুঁকি নিলেন না। সিদ্ধান্ত হল গ্রাফ স্পীকে ডুবিয়ে দেয়া হবে।

১৭ ডিসেম্বর গ্রাফ স্পীর সব আধুনিক ও গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি আর কাগজপত্র নষ্ট করা হল। পরদিন জাহাজটিকে সরিয়ে নেয়া হল বন্দর থেকে দূরে গভীর খাতে। জাহাজের বিভিন্ন জায়গায় বিস্ফোরক বসানোর পর নাবিকেরা স্থানীয় একটি যানে চড়ে ফিরে এল বন্দরে। জাহাজ ডোবানোর ঘটনা দেখতে সেখানে হাজার হাজার জনতা ভীড় করেছে। সবার চোখের সামনে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ হল। বিরাট আগুনের শিখা আর ধোঁয়ায় ছেয়ে গেল চারদিক। প্রায় দু’দিন ধরে পুড়ল সেই জাহাজ, নদীর মোহনা কালো ধোঁয়ায় ঢেকে রইল।

২০ ডিসেম্বর। বুয়েনস আয়ার্সে এক হোটেলে বসে ল্যাংসডর্ফ দুটি চিঠি লেখেন- একটি তাঁর স্ত্রীকে। অন্যটি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার জন্য ক্ষমা চেয়ে হিটলারকে। তারপর জার্মান অভিজাত সামরিক শ্রেণীর রেওয়াজ মত সমস্ত মেডেল সহ পুরোদস্তর সামরিক পোষাকে সেজে, পিস্তলের গুলিতে আত্মহত্যা করেন। এভাবে শেষ হয় দক্ষিণ আটলান্টিকের ত্রাস গ্রাফ স্পী পর্ব। ঘটনাটা সেই সময় ব্যাপক সাড়া জাগিয়ে ছিল, সেই সময়কার পত্র পত্রিকায় তার প্রমাণ মেলে। এমনকি কলিকাতার এক জনপ্রিয় বাংলা দৈনিকে ‘জাহাজের জহরব্রত’ শিরোনামে খবরটি ছাপা হয়েছিল।

যাহোক- দস্যুর জীবন তো শেষ। এবারে খোঁজ পড়ল তার স্যাঙ্গাতের। ব্রিটিশ সরকার এরমধ্যে অল্টমার্কের কথা জেনে গিয়েছেন। সাগরে ভাসমান বন্দীশালা যেখানে প্রায় তিনশো ব্রিটিশ বন্দী রয়েছে। ওটাকে ধরবার জন্য সাজ সাজ রব উঠলো। অল্টমার্কের ক্যাপ্টেন ড’ ঘড়েল নাবিক, চোখে ধুলো দেয়ার জন্য ইতোমধ্যে জাহাজের রঙ ও নাম দুই পালটে দিয়েছেন। যদিও ট্যঙ্কারটির বিবরণ দিয়ে চারদিকে বার্তা পাঠানো হয়েছে, সমুদ্রের বৈরী আবহাওয়া, জাহাজের নতুন চেহারা আর ভাগ্যের সহায়তায় সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে অল্টমার্ক ছুটে চলেছে জার্মানির দিকে।

জাহাজে বন্দীদের দিন কেমন কাটছে? সাগরে ঘোরাফেরা করে যারা তারা সচারচর খুব সাহসী হয়। বন্দীরা বেশ শান্তভাবেই পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিয়েছে। এদের মধ্যে একদল ছিল ভারতীয় খালাসী। জার্মান নাবিকদের পরম কৌতূহলের বস্তু। এদের রঙচঙে পোশাক আর অপুষ্ট রোগা আকার আকৃতি দেখে প্রথমেই জার্মান নাবিকরা বেশ বিস্মিত হয়েছিল। এরপরে তাদের কাজকর্মও কেমন আজব। জাহাজের বাবুর্চি ক্যাপ্টেনকে জানালো যে ভারতীয়রা নিজেদের খাবার নিজেরাই রান্না করতে চায়।  ইংরেজের কোন সাতে পাঁচে তারা নেই। রান্নার অনুমতি পাওয়া গেল। খাসীর মাংস রান্না হচ্ছে- অচেনা সব মশলার গন্ধে চারদিক ভুরভুর করছে। পরম আগ্রহ নিয়ে জার্মান পাহারাদার তা দেখে আর বিভিন্ন সময়ে উপরওয়ালা অফিসারকে রিপোর্ট করে। জানা গেল, ওরা শুয়োরের মাংস খায় না। বাবুর্চির সুচিন্তিত মতামত- ওরা আসলে ইহুদী, ফ্যূরারতো আগেই বলেছিলেন।

আরেকদিন রিপোর্ট হলো- ভারতীয় মাল্লারা আরো বেশী চালের বরাদ্দ দাবী করছে। অল্টমার্কে অত চাল ছিল না, আসলে মানুষ যে এত চাল খায় এটাও তাদের কাছে নতুন বিষয়। যাহোক, এই মাল্লারা এসেছিল হান্টসম্যান থেকে। সেটিকে ডুবিয়ে দেবার আগে সেখান থেকে বেশ কিছু চাল ওরা নিজেরাই নিয়ে এসেছিল। উত্তেজিত বাবুর্চি ক্যাপ্টেনকে আরো জানায়- “যদি একবার দেখতেন হের কাপিটান! ফুটন্ত তেলের মধ্যে ময়দা ছেড়ে কি এক আজব পুডিং বানায় ওরা, আর বানানোর সময় যেমন অদ্ভুত সব ভঙ্গী করে! আমি এক টুকরো মুখে দিয়েই থুঃ করে ফেলে দিয়েছি। ওটাকে বোধহয় চাপাতি বলে”।

জাহাজের ডেকে যেদিন মাল্লাদের আসতে দেয়া হলো সেদিন ক্যাপ্টেন ড’ দু’জন অফিসার সহ তাদের দেখতে এলেন- অবশ্য দূর থেকে। খালাসীদের একদল মাদুর বিছিয়ে সারি বেধে দাঁড়িয়ে কি যেন করছে। ক্যাপ্টেন ড’ বহু দেশ ঘুরেছেন- সহকর্মীদের জানালেন যে ওরা মুসলমান, মক্কার দিকে মুখ ফিরিয়ে উপাসনা করছে। আবার কিছু লোক একটু তফাতে বসা, ওরা হচ্ছে হিন্দু। এবার জাহাজের ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলেন ভারতীয়দের সম্পর্কে তাঁর ধারনা কি। ডাক্তার সেদিনই ওদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেছেন। তাঁর মতে এরা খুবই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, সারাক্ষণই ধোয়ামোছা করে। এমনটা বোধহয় জার্মান বা কোন ইয়োরোপীয় আশা করেনি। আরো আশ্চর্য এদের লাজুক স্বভাব, কিছুতেই অন্যের সামনে নগ্ন হবে না। ডাক্তারী পরীক্ষার জন্য একরকম জোর করেই তাদের কাপড় খুলতে বাধ্য করা হয়েছিল।

ভারতীয় খালাসীরা অনেকদিন ধরেই আলোচনার বিষয় হয়ে থাকে। এদের সম্পর্কে সবচেয়ে বেশী লক্ষণীয় বিষয় ছিল এদের নির্বিকার ভাব। একটা যুদ্ধ চলছে, এরা বন্দী, যেকোনো সময়ে ভয়াবহ কিছু ঘটে যেতে পারে- কিন্তু এসব চিন্তা যেন তাদের মোটেই স্পর্শ করে না। এই ভাসমান জেলখানা থেকে কবে কখন মুক্তি মিলবে সে ব্যাপারেও কোন কৌতূহল নেই। জার্মানরা এমন ভাগ্যের হাতে সমর্পিত কোন জাতের মানুষ আগে দেখেনি।

ওদিকে ইংরেজ বন্দীদের নিয়ে ক্যাপ্টেন ড’ বেশ চিন্তায় আছেন। বন্দীদের সংখ্যা বিপদজনক রকম বেশী। যেকোনো সময় একটা বিদ্রোহ না ঘটে যায়। ইংরেজরা অবশ্য তাদের মতন সময় কাটাচ্ছে। তাস খেলে, গল্প করে, শরীর চর্চা করে। এরই মধ্য কয়েকজন একটা গোপন মেসেজ পাঠানোর ফন্দি করলো। অল্টমার্কের নামধাম সহ এর আনুমানিক অবস্থান এবং বন্দীদের কথা কাগজে লিখে বোতলে ভরে সেটা গোপনে সাগরে ফেলে দেয়া হল। কিন্তু জাহাজের চৌকিদার ওটা দেখে ফেলে, এবং সমুদ্র থেকে ওটাকে তুলে আনা হয়। ক্যাপ্টেন ড’ এই ঘটনায় ভয়ানক রেগে যান এবং দোষীকে খুঁজে বের করে গুলি করার হুমকি দেন। অনুসন্ধান অবশ্য বেশিদূর এগোয়নি। সাজা হলো বন্দীদের খোলা বাতাসে আনার জন্য বরাদ্দ সময় কমিয়ে দেয়া।

এভাবে অনেকদিন কেটে যাবার পর অল্টমার্ক ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি স্কটল্যান্ডের উত্তর সীমা ঘুরে অবশেষে নরওয়ের জলসীমায় ঢুকে পড়ে। এবার ক্যাপ্টেন ড’ বেশ নিশ্চিন্ত, আর কয়েকদিনের মধ্যেই জার্মানি পৌঁছে যাবেন, একেবারে তিনশো বন্দী সহ। কিন্তু ঘটনা এখানে নাটকীয় মোড় নিল। নরওয়ে তখনো নিরপেক্ষ দেশ, তাই জার্মান জাহাজকে এমনিতে ছেড়ে দিল না। ওর পেছনে দুটো টর্পেডো বোট মোতায়েন করা হল। নরওয়ে কর্তৃপক্ষ তিন বার ওটাকে থামিয়ে তল্লাশি করলেন, কিন্তু তেমন কিছু পাওয়া গেল না। বন্দীদেরকে জাহাজের একেবারে নীচের দিকের খোলে আটক রাখা হয়েছিল, সেখান পর্যন্ত আর দেখা হয়নি। তবে এতে করে মূল্যবান সময় নষ্ট হল।  ওদিকে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর তিনটি যুদ্ধজাহাজ নিয়মিত টহলদারিতে বেরিয়েছে। তাদের লক্ষ্য নরওয়ের উপকূলে নজরদারি করা। এরপরপরই ব্রিটিশ নৌবাহিনী অল্টমার্ক খবর জেনে ফেলে, আর সাথে সাথে ওটাকে ধরার জন্য সেই টহলদার বাহিনী ছুটে যায় সেদিকে। একসময় অল্টমার্কের পথ আটকে দাঁড়ায় ব্রিটিশ ডেস্ট্রয়ার কসাক ও ইন্ট্রেপিড।

ক্যাপ্টেন ড’ নরওয়েজীয়দের কাছে বার্তা পাঠাতে থকেন যে তার বেসামরিক জাহাজকে ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ বাধা দিচ্ছে, তাও আবার নিরপেক্ষ দেশ নরওয়ের জলসীমায়। এব্যাপারে নরওয়ের কিছু করা উচিত। কিন্তু সে বার্তা উপেক্ষা করা হয়। নরওয়ের উপকূল ঘেঁসে অনেকগুলো পাহাড় ঘেরা জলাশয় আছে, এগুলো ঠিক হ্রদ না, সমুদ্রের সাথে সরাসরি যুক্ত, যথেষ্ট গভীর। এগুলোকে ফিয়র্ড বলা হয়। শেষমেশ উপায় না দেখে ক্যাপ্টেন ড’ তার বিশাল ট্যাংকার জাহাজকে একটা ফিয়র্ডের ভেতরে ঢুকিয়ে দেন। পেছন পেছন নরওয়ের দুটো টর্পেডো বোটও সেখানে ঢুকে পড়ে এবং অল্টমার্কের দু’পাশে পাহারা বসায়। ব্রিটিশ জাহাজগুলোকে নরওয়ের জলসীমা ছেড়ে যেতে বলা হয়।  কিন্তু কসাকের ক্যাপ্টেন ফিলিপ ভিয়ান খালি হাতে ফিরে যাবেন না। ওদিকে ফিয়র্ডের ভেতরে জায়গা কম, তাই সব বিধি নিষেধ উপেক্ষা করে ভিয়ান একাই ঢুকে পড়লেন ভেতরে, এবং অল্টমার্কের একেবারে পাশে গিয়ে তাঁর জাহাজ ভেড়ালেন। দুই জাহাজের মধ্যে জোর ধাক্কা ধাক্কি হলো, এই সু্যোগে জনা চব্বিশেক নৌসেনা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে লাফিয়ে পড়লো অল্টমার্কের ডেকে।

এরপর সংক্ষিপ্ত গোলাগুলি ও হাতাহাতি লড়াই। অচিরেই অল্টমার্কের নাবিকেরা আত্মসমর্পন করল। কয়েকজন আবার লাইফবোটে করে পালাবার চেষ্টা করছিল, গুলি করে সেগুলো ছেঁদা করে দেওয়ায় আর পালানো হলো না। ধূর্ত ক্যাপ্টেন ড’ প্রথমে নিজেকে নরওয়েজীয় পাইলট বলে চালাতে চেয়েছিলেন। যাহোক, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার পর বন্দীদের ব্যাপারে জানতে চাইলেন ভিয়ান। ক্যাপ্টেন ড’ পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন নীচে। ঢাকনা খোলা হোল, ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ভিয়ান হাঁক দিলেন- “এনি ইংলিশ ম্যান ডাউন দেয়ার?” ভেসে এল কোরাস- “ইয়েস উই আর অল ইংলিশ ডাউন হিয়ার”। “দেন কাম অন আপ, দ্যা নেভি ইজ হিয়ার!” বন্দীদের মুক্ত করে কসাক দ্রুত সরে গেল। জার্মান কাউকে অবশ্য বন্দী করা হয়নি। তবে লড়াইয়ে জনা আটেক জার্মান হতাহত হয়েছিল।

অল্টমার্ক জার্মানিতে ফিরে আবারো যুদ্ধে যোগ দেয়। অবশেষে ৩০ নভেম্বর ১৯৪২ সালে জাপানের ইয়োকোহামা বন্দরে এক বিরাট বিস্ফোরণে এটা ধংস হয়ে যায়। আর যেদিন জার্মানি মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করে সেদিন ক্যাপ্টেন ড’ আত্মহত্যা করেন।

কাহিনী এখানে শেষ, এবারি আসি সেই চমকের কথায় যার আভাস লেখার শুরুতে দিয়েছি। বইটাতে বেশ কিছু ছবি আছে, তার মধ্যে একটা মুক্তিপ্রাপ্ত ভারতীয় খালাসীদের ছবি। চেহারা দেখেই আমি কেমন চমকে গেছি, এই চেহারা এই পোশাক- সবই খুব চেনা। বইয়ের পরিশিষ্ট অংশে তাদের নামের তালিকা দেয়া আছে। সেখান থেকে কয়েকটি নাম তুলে দিলামঃ

ওয়াসিউর রহমান, আনা মিয়া, আলি আহামদ, আমির আলি, সুলতান আহমদ, সায়িদ আহমদ, উমুর মিয়া, মুনশী মিয়া, রেজাউদ্দিন, বাদশা মিয়া, শরাফত আলি, রিয়াজ উল্লাহ, ছমেদ আলি, জাবুরুল্লা, মাসি মোল্লা, কমর আলি, ইউসুফুল্লা, শমশের উল্লাহ, ফরাসাত উল্লাহ, ইদ্রিস উল্লাহ, লুক্মান উল্লাহ, খুরশিদ আলি, মুন্সুর আলি, রমজান আলি, নঈম উল্লাহ, ইয়াসিন উল্লাহ, রিয়াসত উল্লাহ, হারিস মিয়া, মফিজ আলি, সেকান্দর মিয়া, কালা মিয়া, সানাউল্লাহ, প্রমুখ।

আমার বিশ্বাস এঁরা আসলে বাংলাদেশের মানুষ। সিলেট চট্টগ্রাম নোয়াখালী বরিশাল প্রভৃতি অঞ্চলের মানুষ অনেক কাল থেকেই সদাগরী জাহাজে কাজ করেন- একথা অনেকেরই জানা। কিন্তু এমন ঐতিহাসিক ঘটনায় জড়িত থাকার কথা আমি আগে শুনিনি। জানিনা সেই সাহসী মানুষগুলো তাঁদের সেই অবিস্মরনীয় অভিজ্ঞতার কথা কাউকে বলে গেছেন কিনা। এঁদের উত্তর প্রজন্ম খুঁজে বের করতে পারলে হয়তো জানা যেত। কোন ইতিহাসের ছাত্র এটকে গবেষনার বিষয় হিসাবে নেবেন এই আশা রইল।

তথ্যসূত্রঃ

THE NAVY'S HERE!': THE ALTMARK AFFAIR (1955) by Willi Jackson and Robert. Frischauer

Seizing The Altmark, MILITARY HERITAGE January 2011, pp. 52-57

https://en.wikipedia.org/wiki/Altmark_Incident