আজ মনিরের জন্মদিন । সে ঠিক করেছে আজ সম্পূর্ণ নিজের মতো থাকবে । কাগজ কলম টেনে নিয়ে লিখতে শুরু করে । ওয়ার্ক টু ডু । মধুর ক্যান্টিন এ বন্ধুদের সাথে আড্ডা । মিডনাইট সান এ দুপুরের লাঞ্চ । মেজ আপার দেবরের বিয়ের বাজার করতে যাওয়া । বিকালে আনিকার সাথে ... নিউ মার্কেট...
মনির ওয়ার্ডরোব থেকে ধোয়া পাঞ্জাবি পাজামা বের করে । ইস্ত্রী করা । ধোয়া কাপড়ের তাজা গন্ধ ফুরফুরে ভাব তৈরী করে । সব কিছু নতুন নতুন লাগে । লাগুক । জন্মদিন বলে কথা । মনির ঘর থেকে বের হয় ঠিক দশটায় । হলের মুখে আট দশটা রিক্সা । সে পরিচিত একটা রিক্সায় উঠে । রিক্সা ড্রাইভার লোকমান । আই এ পাস । অভাবের কারণে লেখা পড়া হয় নি। থাকে ফুলবাড়ীয়া বস্তিতে। মনিরের কাছে প্রায়ই আসে। বিভিন্ন অজুহাতে টাকা নেয় । আজ ও সে নিশ্চয়ই কিছু চাইবে । মনির ঠিক করেছে না বলবে না ।
মধুর ক্যান্টিনের সামনে মিছিল । জাসদের । স্বৈরাচার - নিপাত যাক । শ্বেত প্রতিরোধ ভেঙে ফেলো । লাল প্রতিরোধ গড়ে তোলো । মনির হাসে । জাসদ এখনো সমাজতন্ত্রের কথা বলে । সমাজতন্ত্র তো কত আগেই ভূত হয়ে গেছে । তারপর ও এরা এসব নিয়ে সব মাতামাতি করে -কেন?
ভেতরে অনেক লোক । কিছু পুরানো ছাত্র নেতাও । আফজল ভাইয়ের সাথে দেখা । একসময়ের তুখোড় ছাত্র নেতা । মঞ্চ কাঁপানো । এখন ঠান্ডা মেরে গেছেন । মনির আশেপাশে চোখ বুলায় । তার বন্ধুরা সবাই এসেছে । জিসান, শওকত, হাসান ও আনিকা । আনিকা আজ সুন্দর করে সেজে এসেছে । খোঁপায় তাজা ফুল । সম্ভবত বেলি। হলুদ জমিনে নীল কাজ করা সালোয়ার কামিজ। হাতে সোনালী ব্রেসলেট। কপালে টিপ । কি রং ? ফিরোজা? নাহ অন্য কিছু । রোদের আলো আনিকার মুখে পড়ে তাকে আরো সুন্দর লাগছে ।
ফার্স্ট ইয়ারের কথা । কার্জন হলে ক্লাস । পুব দিকের গেট দিয়ে ঢুকতেই হাতে বাম পাশে সয়েল সাইন্স ডিপার্টমেন্ট । জালাল স্যার ক্লাস নিচ্ছেন । “থিঙ্ক এবাউট দা ট্রি লাইভস । ইট ফলস ইন গ্রাউন্ড গোস টু সয়েল টার্ন ইনটু হিউমাস.....” স্যার যাই বলেন মনির হুবহু তুলে ফেলে । খেয়াল করলো আনিকা । ব্যাস ক্লাস শেষে ধরে বসলো, “এই যে, তোমার ক্লাস নোট টা কি আমি পেতে পারি?”
“অফ কোর্স।” পাশেই ইউনিভার্সিটি ফটোস্ট্যাট। মনির কপি করে এনে আনিকার হাতে দেয় । আনিকা পার্স খুলতে খুলতে বলে, “কত হয়েছে?”
“কোনটা বলবো? ফটোস্ট্যাট না আমার মেধা?”
আনিকা হাসে। “ভারী মজার তো তুমি । আচ্ছা চলো কোথাও গিয়ে বসে ঠিক করি কত দেয়া যায়।”
তিন নেতার মাজারের পাশে গিয়ে বসে তারা । অনেকক্ষন কথা হয়।
“বাড়ি কোন জেলায়?”
মনির বলে, “নোয়াখালী।”
“আরে নোয়াখালীতে তো ছিলাম আমরা । ডিসি বাংলোয় । মাইজদী সার্কিট হাউসের সামনে বিরাট মাঠ । আমরা সবাই খেলতাম বিকালে সেই মাঠে। মাইজদীর অনেক মজার স্মৃতি আছে আমার।”
“কি ধরণের স্মৃতি?”
“শফিক আঙ্কেল নামে আব্বুর এক কলিগ ছিলেন। এ ডিসি। ভালো কবিতা আবৃতি করতেন । বিজয় দিবসের এক ফাংশনে আঙ্কেল কবিতা গেলেন ভুলে । রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী । ক’ লাইন তিনি নিজেই বানিয়ে বললেন। এটা নিয়ে পরে কি হাসাহাসি। আব্বু আঙ্কেলকে ডাকতেন ‘কবি শফিক’ বলে । কতদিন আগের কথা । পরে চাচা অন্য জায়গায় বদলি হয়ে যায়। আমরা ঢাকায় চলে আসি।”
মনির বলে, “আমরা মাইজদীতে কিংবা বেগমগঞ্জে থাকতাম।”
বিকালে আনিকার সাথে নিউ মার্কেট যাওয়ার কথা রাখতে পারে নি । মেঝো আপার দেবর একটা হাড় কিপ্টে । দুই হাজার টাকার জিনিস কিনতে চার ঘন্টা নষ্ট করল । যাই দেখে দাম শুনে বলে – “ওরে বাব্বা এ যে দেখি কয়লার আগুন । মনির ভাই চলেন মিরপুর । আরো সস্তায় পাওয়া যাবে।”
যাওয়া হলো মিরপুর । দামের খুব হেরফের হলো না । “বুঝলেন ভাই এরা সাক্ষাৎ ডাকাত। সহজে দাম ছাড়বে না । এর চালান আসে কিন্তু পুরান ঢাকা থেকে । বাবু বাজারের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীকে আমি চিনি । যদি একটা দিন সময় দেন তো.......”
মনির শীতল কণ্ঠে বললো, “ভাই আপনি ব্যবসায়ী ভাইদের নিয়ে সেরে ফেলেন । আমি আর সময় দিতে পারবো না।”
সোজা হাঁটা দিলো । দশ নম্বর গোল চক্করে এসে আনিকাকে কল করলো । ‘সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না ; দয়া করে আবার ডায়াল করুন।’ ধ্যাৎ, আজ কোন কাজই হলো না । আর কোথাও না, সোজা হলে । রুমে ঢুকে অবাক । টেবিলের উপর গোলাপের তোড়া । তিন চার রঙের গোলাপ । সাথে একটা কোলন আর একটা কার্ড.....
কোথায় গিয়াছো আজ তুমি এই বেলা
মাছ রাঙা ভোলেনিতো দুপুরের খেলা
শালিক করে না তার নীড় অবহেলা
উচ্ছাসে নদীর ঢেউ হয়েছে সফেন.....
মনিরের ভিতরটা আনন্দে লাফিয়ে ওঠে । প্রায়ই আনিকাকে নিয়ে এই অনুভূতি হয় । ইউফরিক থাকলে রাতে ঘুম হয়না । আজ হবে বলে মনে হয় না । কাল সকালে ক্লাস । সামনে মাস্টার্স ফাইনাল । এই সময়টা ক্লাস মিস দেয়াটা ঠিক হবে না । মনির ফ্রীজ থেকে ঠান্ডা পানি বের করে টেবিলের উপর রাখে । গ্লাসের পাশে বিন্দু বিন্দু পানি শিশিরের মতো । কানের কাছে একটা মশা । বিরক্তিকর । লাইট বন্ধ রাখলে মশা চলে যায় । মনির লাইট অফ করে দেয় । পুরো রুমটা অন্ধকার । জানালার ফাক দিয়ে সামনে হাই কোর্ট স্ট্রিট দেখা যায় । নিয়ন আলোয় হাটছে আট দশজন ছেলে । মনির তাকিয়ে থাকে । একটা এম্বুল্যান্স সাইরেন দিতে দিতে এগিয়ে যায় মেডিকেল কলেজের দিকে । বুকটা ধক করে উঠে । এই সমস্যাটা তৈরি হয়েছে আরিফ মারা যাওয়ার পর থেকে । ফিনান্স এর আরিফ । রেকর্ড মার্ক্স্ নিয়ে ফার্স্ট হয়েছিল অনার্সে । ভীষণ চুপচাপ একটা ছেলে । মনিরের সাথে পরিচয় সন্ত্রাস নির্মূল কমিটির মিটিং এ । কি শানিত কথা বার্তা .......`
‘শিক্ষাঙ্গণ থেকে রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হরে চার পাঁচ বছর । এটা জনগণের চাওয়া, আমাদের না । জনগণের ট্যাক্সের টাকায় আমরা পড়ি । তাদের সেই টাকা নষ্ট করার অধিকার আমাদের কেউ দেয় নি।’
মিটিং শেষে মনির কে বলে, “চা খাবে? ডাচ (ঢাকা ইউনিভার্সিটি স্নাক্স) এর এলাচ দেয়া চা । খুব টেস্ট । মজার কথা কি জানো; আমিই প্রথম ওদের বলেছি এই চা বানানোর কথা । এখন ভীষণ চলে।” আরিফের মৃত্যু হয় অকস্মাৎ । মিছিল যাচ্চ্ছিলো জহুরুল হক থেকে সলিমুল্লার দিকে । আরিফ সামনে । উদয়ন স্কুলের সামনের দিক থেকে হঠাৎ গুলি । বুকের একপাশে এসে লাগে । অ্যাম্বুলেন্স আসে । মেডিকেল নেয়ার পথেই আরিফ মারা যায় । কয়েকটা কাক চিৎকার জুড়ে দেয় সড়ক দ্বীপের গাছটায় । আরিফের মৃত্যুর পর অনেক দিন পর্যন্ত উদয়ণের সামনের রাস্তায় যায় নি । একদিন আনিকা ধরে বসলো – “চলো উদয়নে।” মুভি দেখাবে, দি টু ওমেন।
“পাগল হয়েছো? এক ওমেন নিয়েই পারি না ..দুইজন!”
আনিকা তখন ও ধরতে পারে নি । ধরতে পারলো অনেক পরে মনিরের এক খেরো খাতার শেষ পৃষ্টার লেখা থেকে: ‘আরিফ, আমি ওখানটায় যাই না তোর গুলিবিদ্ধ লাশ দেখবার ভয়ে । তুই চলে গেলি আমাকে একা করে।’
পরীক্ষা শেষ ।
মনির এর ধারণা এবার সে ফার্স্ট হতে পারবে না । ফার্স্ট ক্লাস পায় কিনা সন্দেহ । পরীক্ষা খুব খারাপ হয়েছে । সয়েল ফার্টিলিটির পাঁচ মার্ক্স্ এর একটা প্রশ্ন বুঝেই নি আন্দাজের উপর দিয়ে এসেছে । ঝড়ে বকের মতো । লাগলেও লাগতে পারে । এই করে কি ফার্স্ট হওয়া যায় ? তার মধ্যে শওকত বসেছে পিছনে । কিছুক্ষন পর পর “...দোস্ত এ আনসার টা কি?”
মনির বলে দেয় ।
“দোস্ত তারপরে কি হবে?”
“এই গরু তোকে কি আমি পুরাটা বলে দিবো?” বকা দিয়ে মনিরের মন খারাপ হয়। “আচ্ছা বল কি জানতে চাস?” পরের পরীক্ষায়ও একই অবস্থা । মনিরের মায়াই লাগে, শক্ত কিছু বলতে পারে না।
আনিকা পরীক্ষার প্রথম থেকেই রাগারাগি করছে । “তুমি ওর কোনো কথার জবাব দিবা না।”
“না দিলে ও পাশ করবে কিভাবে?”
“ওরে আমার বড় ভাই রে! সবার পাশ করানোর দায়িত্ব ওনার।” আনিকা শওকতকে গিয়ে ধরে । শওকত নির্বিকার । যেন এটা তার প্রাপ্য।
রেজাল্ট দেয়া হচ্ছে না অনেক দিন । স্যাররা বোধহয় প্রজেক্ট ট্রজেক্ট নিয়ে ব্যাস্ত । হঠাৎ একদিন ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান ডেকে পাঠালেন । মনির বসে আছে তার সামনের চেয়ারে । তাকে লাল চা দেওয়া হয়েছে। উপরে লেবুর সবুজ পিঠ ভেসে আছে । একটা পিরিচে দু তিনটা বিসকুট জাতীয় কিছু । কোন এক অজানা কারণে টিচাররা এ ধরণের বিসকুটই পছন্দ করেন। মনির চিন্তা করে কি কি কারণ হতে পারে ডাকার । এক, রেজাল্ট খুব খারাপ হয়েছে; দুই, সেকেন্ড ইয়ারের সয়েল ফিজিওলোজির খাতা দেখে দিয়েছে এটা জানাজানি হতে পারে । রেজিনা মেডাম ধরা খাবেন নিশ্চিত । সে ঠিক করেছে সত্যি কথা বলবে । স্যার হয়ত জিজ্ঞেস করবেন, “ফিজিওলোজিতে এতো বেশি নম্বর দিলে কেন?”
“ছেলেপেলে ভালো করেছে নাম্বার দেব না, বলেন কি ? এটা তো মেধার অপমান স্যার।”
“তোমার অপমানের খেতা পুড়ি।” এ অংশে স্যার উত্তেজিত হয়ে উঠবেন । মনির মনে মনে দোয়া ইউনুস পড়ে । বড় মোক্ষম দোয়া ।
“তোমার পরীক্ষা কেমন হয়েছে?” মনির নিশ্চুপ । যা হোক একটা কারণ কাটা গেলো ।
“কি ব্যাপার এতো নারভাস কেন তুমি?” স্যারের মুখ হাসি হাসি ।
“স্যার আমার পরীক্ষা খুবই খারাপ হয়েছে।”
“খারাপ হবার কারণ কি?”
“কোন স্পেসিফিক কারণ নেই।”
“কারণ না থাকাই ভালো । কারণ থাকলে তুমি এতো ভালো করতে না।” স্যার হাত বাড়ান । “কংগ্রাচুলেশন! ইউ আর ষ্টীল ইন দা ফার্স্ট পজিশন।”
“থ্যাংক ইউ স্যার।” মনির চায়ে চুমুক দেয় । ঠান্ডা চা । তারপর ও ভালো লাগছে । বিসকুট খাওয়া হয় নি ।
“কাল কি তুমি একবার ভিসি সাহেবের সাথে দেখা করতে পারবে? ডিপার্টমেন্টে দুইটা পোস্ট খালি আছে।”
মনির সামান্য চিন্তা করে বলে, “পারবো।”
চেয়ারম্যান স্যারের রুম থেকে বের হয়ে কতক্ষন হাঁটাহাঁটি করে । উদ্দিশ্যবিহীন । বাবা কে জানানো দরকার। ইচ্ছা হচ্ছে না । মাঝেমাঝে সুখবর গুলোকে ধরে রাখতে ইচ্ছা করে ছোটবেলার মতো । ক্লাস ফাইভে বৃত্তির রেজাল্ট পেয়ে কাউকে বলে নি । সারাদিন চুপচাপ কেটেছে । রাতের বেলা হেড স্যার মিষ্টি নিয়ে হাজির । “কি রে বেটা, তুই তো কামাল করে দিলি!” আর কি লজ্জা মনিরের ।
মা জিজ্ঞেস করে, “তুই লুকিয়ে রাখলি কেন?”
“খুশি ধরে রাখতে আমার মজা লাগে।”
“তাই বলে এভাবে ? দুষ্ট!”
ভিসি স্যার ইন্টারভিউ নিলেন । সিন্ডিকেট ও নিলো । মনির আজ যাবে এপয়েন্টমেন্ট লেটার আনতে । রেজিস্ট্রার অফিসে গিয়ে শুনে স্যার দেশের বাড়িতে গেছেন কি এক আর্জেন্ট কাজে। আরো দু’ দিন লাগবে চিঠি রেডি হতে। বিরক্তিকর। এদেশের সব কাজে এরকম । মনির মেজো আপার বাসায় গিয়ে উঠে। ফোনের সুইচ অফ রাখে কয়েকদিন। এখন কারো সাথে যোগাযোগ করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। আনিকা খারাপ করেছে। বাকিরা আগের মতো।
এপয়েন্টমেন্ট লেটার নিয়ে সে সোজা সায়েদাবাদে যায়- নোয়াখালীর বাস ধরবে । মা বলবেন, “এতসব হলো আমাদের তো কিছু জানালি না!” মনির হাসবে। মায়ের সাথে এই খুনসুটি তার ভালোই লাগে । আজ মা তেমন কিছু বললেন না । তিনি মহা খুশি । হালকা নীল রঙের এক শাড়ি পরেছেন । চোখে কাজল দিলেন । মুখ ভর্তি পান। দাদা জর্দার সুগন্ধ ভেসে আসছে তার কাছ থেকে । পাড়ার মসজিদে আছরের আজান দিয়েছে । বাবা বললেন, “চল তোকে মসজিদে নিয়ে যাই । সবার থেকে দোয়া নিবি।”
“বাবা এভাবে আমি দোয়া নিতে পারবো না।”
মা ধমকে উঠেন। “আপনি কি পাগল হয়েছেন? মিষ্টি মুষ্টি ছাড়া এভাবে...”
বাবা শুধু বললেন, “ও, ভুল হয়েছে।”
বাবার ‘ও ভুল হয়েছে’ এখনো গেলো না । তিনি ভুল করেন আর স্বীকার করেন, এ যেন এক মহা আনন্দের ব্যাপার । এই নিয়ে মায়ের এক গোপন দুঃখ আছে । মনির তাকে প্রায়ই বুঝায় – “দেখেন মা, সব মানুষ তো এক রকম হয় না । বাবার মতো এতো বড়ো মনের মানুষ ক’ জন আছে?”
মা কিছু দিন সহ্য করেন । ব্যাটারীর মতো চার্জ থাকে তারপর আবার....
আনিসকে পাঠানো হলো মিষ্টি আনার জন্য । আনিস মনিরের দুই বছরের ছোট । বাবা বার বার সাবধান করলেন, “দেখে আনবি । বাসি টাসি যেন না হয় । বাসি হলে তোর হাড্ডি গুঁড়া করে ফেলবো।”
বাবার উৎসাহ দেখে মনে হচ্ছে আজ মহা ঝামেলা করবেন। তিনি মহা ঝামেলা করলেন । খাসি জবাই দিলেন । দই বসালেন দিখু ময়রাকে দিয়ে । বাসার আশে পাশের মানুষকে দাওয়াত করলেন । ছেলের বিশ্ববিদ্যালয় এ চাকরি হয়েছে । এ খুশি তিনি সবার মাঝে ছড়িয়ে দেবেন।
থানা থেকে খবর এসেছে স্বরাষ্ট্র সচিব আসছেন - সঙ্গে তার পরিবার। রাতে তিনি সার্কিট হাউসে থাকবেন । আনিকা টেলিফোন করলো “কি ব্যাপার পালিয়ে গেলে কেন উল্লুক? আমাকে একবার ফোন করার ও দরকার মনে করো নি ? এতো খারাপ তুমি । আমার রেজাল্ট টা ও জানতে চাও নি ?”
“আমি সবার রেজাল্ট জানি।”
“জানলে ফোন করোনি কেন?”
“আমি ফোন করলে তোমার রেজাল্ট ভালো হয়ে যেত?”
“না, কিন্তু আমার ভালো লাগত।”
“তাহলে সরি।”
“সরি মানে? এতো সহজে ছাড়ছি তোমাকে ? বাবাকে বললাম, বাবা বললেন ‘চল আজ রাতেই ও বেটাকে একটা ধোলাই দেই । ফাজিল কোথাকার আমাদের না বলে গেলো কেন?’ ”
“আমার বাড়ি আসার কথা জানলে কিভাবে?”
“কিভাবে আবার? মেঝো আপার কাছ থেকে।”
আনিকা ফোন কেটে দেয় ।
বহুলোক জমা হয়েছে বাসার সামনের মাঠটায় । থানা পুলিশের লোকই বেশি । ডাক বাংলো থেকে তার টেনে টিউব লাইট জ্বালানো হয়েছে কয়েকটা । তার আলোয় দিনের মতো ফর্সা চারিদিক। আনিকার বাবা আসলেন দলবল নিয়ে । ঘন্টা খানেক থেকেই চলে গেলেন । বাবার সাথে কি কথা হলো জানা হয় নি । আনিকা থেকে গেছে তার বোনদের চাপাচাপিতে । মনির অনেক রাত পর্যন্ত ঘুমাতে পারে নি বাসার হৈ চৈ এ । গভীর রাতে আনিকা এসে তার হাত ধরে বলে, “চলো হাঁটতে যাই।”
“কোথায়?”
“তুমি যে গল্প বলছিলে তোমাদের এখানে কমলার দীঘি আছে সে দীঘিতে।”
“মাথা খারাপ! এতো রাতে?”
“চলো না প্লিজ কিচ্ছু হবে না।”
কমলার দীঘির পাড়ে দু’ জন মানব মানবী হাত ধরাধরি করে হাঁটছে । দীঘির পানি ঝকঝকে চাঁদের আলোয় থৈ থৈ করছে । বহুকাল আগে কমলা নামের এক রুপসী রাজ কন্যা তার স্বামীর সাথে হাত ধরাধরি করে হাঁটতো এই দীঘির পাড়ে । এক পূর্ণিমা রাতে দীঘির পানি তাকে টেনে নিয়ে যায় চির দিনের জন্য । এখনো মানুষ তাদের ছায়া দেখে মাঝে মাঝে ।