Table of Content

Anjuman Rosy
NA
NA
6 articles

প্রবাসে কাঁদে

লেখক: আনজুমান রোজী Category: ছোট গল্প (Short Story) Edition: Dhaboman - Eid 2017

 

টরন্টোর ভিক্টোরিয়া পার্ক ও ড্যানফোর্থ এরিয়া বলতে গেলে বাঙালি অধ্যুষিত্ এলাকা। এই এলাকা জুড়ে গড়ে উঠেছে অনেক বাঙালি বিপনি বিতান, যেখানে বাংলা শব্দে জ্বলজ্বল করছে সাইনবোর্ড। যার সবটুকুই বাংলা কায়দায় সাজানো। বাংলাদেশী রসনা বিলাসের  খাবার ঘরের আয়োজন থেকে শুরু করে দেশজ শাড়ি, কাপড়, অলংকার এমন কি দেশী শাকসবজি ও বিভিন্ন মাছেরও সম্ভার আছে, আছে বাংলা পত্রিকা ও ম্যাগাজিনের রমরমা ছড়াছড়ি। সেই সাথে সারা বছরব্যাপী চলতে থাকে বাংলাদেশের সাথে তাল মিলিয়ে সব জাতীয় উৎসব এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এ যেন এক ছোট্ট বাংলাদেশ। ওখানে গেলে ভুলেই যেতে হয় দেশের বাইরে কোথাও আছি। এখানে আছে হাকিম চত্বর, আছে টিএসসি, আছে শাহবাগ। প্রাণের ঢাকা শহরের সবটুকু প্রাণ যেন এখানে উপচে পড়ছে। সেই গালগল্প, হাসিঠাট্টা, হায় দোস্ত, হায় মামু আহ্বানে অন্তর ঢেলে একে অপরকে যেনো জড়িয়ে ধরে মনের অর্গল ঢেলে দিচ্ছে। তাই অনেক বাঙালি যারা বাংলাপাড়া থেকে বেশ দূরে থাকেন তারা মাঝে মধ্যে ওখানে ঢুঁ মারেন দেশজ স্বাদ নেওয়ার জন্যে। 

আলম প্রায়ই ছুটির দিন বাংলা পাড়ায় আসে। পাঁচচল্লিশ মিনিট ড্রাইভ করে এখানে আসে, বলতে গেলে বেশ দূরেই থাকে আলম। একটু এদিক সেদিক ঘুরে আর কিছু না করলেও বা না কিনলেও হাতে করে বেশ কয়েকটা বাংলা পত্রিকা নিয়ে যায়। মাঝে মাঝে চোখ বুলিয়ে দেখে বাংলার মানুষের আনাগোনা, শুনে কথোপকথন কিম্বা পরিচিত কারোও-কারোও সাথে একটু আধটু হাই হ্যালো করে অলস সময় কাটায়। বাংলা পাড়ায় মানুষের এতো  হৈ-হুল্লোড়, আনাগোনা ছাড়াও কিছু গোপন কান্নার ধ্বনি বাজে এখানে, তা হয়ত কেউ কেউ জানে কিন্তু অনেকেই দেখেওনা, বোঝেও না। সদ্য আসা ইমিগ্র্যান্ট বা রিফিউজি ক্যাটাগরিতে আসা মানুষের করুণ দৃশ্য প্রায়ই লক্ষ্য করা যায়। সম্পূর্ন বিপরীত একটি দেশে এসে এর ভাবগতির সাথে তাল মিলাতে গিয়ে অনেকে হোঁচট খেয়ে পড়ছে। আর তাদেরই শেষ নির্ভরযোগ্য অবস্থান হচ্ছে বাংলাপাড়া। অনেক মেধা আর পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়ে কানাডাতে পা দিলেও পরবর্তীতে এখানকার সংস্কৃতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেন না। আবার অনেকে এই বৈরি পরিবেশে কঠোর পরিশ্রম করে  নিজের জীবনবাজী  রেখে লক্ষ্যে পৌঁছাতে চায়। তাদের কেউ কৃতকার্য হয় আবার কেউ হা হুতাশ করে করে দিন কাটিয়ে দেয়। এমন কতকিছুই তো  আলমের চোখের সামনে দিয়ে ঘটে যাচ্ছে। আলম সেই মানুষ, যে কখনো আশা ছাড়েনা, একভাবে নাহলে অন্যভাবে চেষ্টা চালিয়ে যায় জীবনটাকে বেগবান রাখার জন্যে। তবে হ্যাঁ, আলম নিজের মতো করেই জীবন পাড়ি দিচ্ছে। কঠোর পরিশ্রম করে সাজিয়ে গুছিয়ে জীবনটাকে কানাডার আঙ্গিকে দাঁড় করিয়ে ফেলেছে। জীবন যুদ্ধে পরাজিত মানুষগুলো  ভাগ্যিস কানাডাতে এসে পড়েছিল। এইসব অপারগ, অক্ষম মানুষদের জন্য সরকার তিনবেলা খাওয়া , চিকিৎসা আর থাকার জায়গার ব্যবস্থা করে দেয়। এইটুকু নিয়েও অনেকে দিব্যি দিন গুঁজার করছে বটে কিন্তু সমস্যা হলো অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে, যা দেখে বা শুনে আলমের নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়।

কোনো এক ছুটির দিন বিকেলে আলম চা আর সিঙ্গারার অর্ডার দিয়ে ঘরোয়া রেস্টুরেন্টের এককোণে বাংলা পত্রিকা নিয়ে বসে। পত্রিকায় চোখ বুলিয়ে নিতেই দেখে অল্প বয়সী একটি ছেলে চা, সিঙ্গারা এনে টেবিলে রাখে। ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে আলমের কী যে হলো, বুকের ভিতর চিনচিন করে একটা ব্যাথা অনুভব করলো। এমনটা কখনই হয় না। কতবারই তো এসেছে। চুপচাপ বসে খেয়ে চলে গেছে। কিন্তু এই ছেলেটিকে দেখামাত্রই আলমের ভিতর এক অযাচিত মায়া জন্ম নিলো। সাথে সাথে জিজ্ঞেস করলো, “তোমার নাম কি?”

মাথা নীচু করে ছেলেটি জবাব দিলো, “শোভন।”

আলমের আরো অনেক কিছু জানতে ইচ্ছে হয়, কারণ ছেলেটির মুখে জুড়ে রয়েছে এক ভয়ানক করুণ ছায়া। ছেলেটির নিষ্পাপ নরম কোমল মুখের দিকে চেয়ে আলম আবার জিজ্ঞেস করলো, “তুমি স্টুডেন্ট?”

ছেলেটি আবারও সেই একই অবস্থায় দাঁড়িয়ে সংক্ষেপে জবাব দিলো, “না।” 

“তোমার ফ্যামিলি, মানে তোমার বাবা মা কোথায়?”

“দেশে, স্যার।” 

স্যার বলাতে আলম বেশ বিব্রতবোধ করলো। বললো, “স্যার নয়, আলম ভাই বলো। আমার নাম শাহ আলম।” শোভন মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে চলে যেতে চাইলে আবার আলম তাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কানাডাতে কিভাবে এসেছো? অর্থাৎ ইমিগ্রেন্ট হয়ে নাকি স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে?”

খুবই ইতস্তত অবস্থায় মাথা নীচু করে শোভন বলে, “কোনোটাই না।”

আলম বেশ অবাক হয়ে চোখের পলক না ফেলে জিজ্ঞেস করে, “তাহলে?” 

শোভনের চোখের কোনায় জল এসে ভিড় করে। আলম অভয় দিয়ে বললো, “কিছু মনে না করলে আমাকে সব খুলে বলতে পারো।”

এবার শোভন মুখ তুলে সরাসরি আলমের দিকে তাকিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো, “আমাকে দেশে পাঠিয়ে দিবেন? আমি মা'য়ের কাছে যেতে চাই।”

কথা আর না বাড়িয়ে  আলম তার ভিজিটিং কার্ড ধরিয়ে দিলো শোভনকে। বললো, “সময় করে কল করো।” দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে গেলো। শোভনের মুখের দিকে আর তাকাতে পারছিল না। 

ফোনে শোভনের সাথে আলাপ করে আলম পরে যা জেনেছিল  তা রক্ত হিম হওয়ার মতো কাহিনী ছিল। কোনো এক সাংস্কৃতিক দলের হয়ে এখানে এসে আর ফিরে যায়নি সে। সাংস্কৃতিক দল শোভনের মতো বেশ কয়েকজনকে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে এখানে এনে ছেড়ে দেয়। এদের অনেকেই নতুন দেশের বিষয় আশয় বুঝে উঠতে পারে না বলে ঘুরে ফিরে সেই বাংলা পাড়াতেই পড়ে থাকে। অবৈধভাবে থাকে বলে তাদের অনেকেই লুকিয়ে থাকে। কোনো রকমে ক্যাশে কাজ করে খাওয়ার যোগাড় করলেও থাকার জায়গা তাদের অনেকেরই হয় না। এদের জীবন যাপনের এই করুণ কাহিনী আলম আগেও শুনেছে কিন্তু তারপরও শোভনের বিষয়টা তাকে ভীষণ কষ্ট দেয়। তার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে, মাথা উঁচু করে যদি দেশ থেকে বের হতে না পারে তবে এভাবে চোরের মতো কেন আসা? কেন এভাবে অন্যদেশে এসে লুকিয়ে পালিয়ে থেকে নিজ দেশের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ণ করা? এখানে অর্ধাহারে অনাহারে থাকার চেয়ে নিজ দেশের আলো বাতাস খেয়ে মাথা উঁচু করে চলাটা কি শান্তির ছিল না? আলম মনেমনে ধিক্কার জানায় সেইসব প্রতারক জালিয়াতিদের যারা লোভ দেখিয়ে এমন নিষ্পাপ ছেলেদের অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে। তাদের বিচার হওয়া উচিৎ।

 

সে মনে মনে সংকল্প করে শোভনকে সে দেশে তার মায়ের কাছে ফিরে যেতে যথা সম্ভব সাহায্য করবে কিন্তু এমন তো কত শোভন পৃথিবীর আনাচে কানাচে করুণ মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের সবাইকে কে সাহায্য করবে? দেশের নেতা এবং রাজণীতিবিদদের দায়িত্ব হচ্ছে এই সব সম্ভাবনাময় তরুণদেরকে স্বদেশের মাটিতে সসম্মানে জীবন যাপন করতে সহায়তা করা। তারা কি তাদের সেট দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছেন?